নিজে উদ্যোগে "কিছু প্রশ্নের জবাব" পোস্টের ভিডিওটির ট্র্যান্সক্রিপ্ট অনুবাদ করে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন আরিফুর রহমান।
নবীজির ছবি অঙ্কন দিবসের প্রয়োজনীয়তা ও লক্ষ্য বিষয়ে যাদের মনে কোনও প্রশ্নের উদয় হয়েছে, তাদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য।
মে ২০১০, বিশ তারিখ, দুনিয়াজুড়ে পাবলিক 'এসো আকি মুহম্মদ দিবস' সাড়ম্বরে পালন করলো, এই দিনে সবাইকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে নিজেদের অঙ্কিত মুহম্মদের ছবি জমা দিয়ে দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল করতে।
যেমনটি ভাবা হয়েছিলো, এই দিনটি সবাই আনন্দের সাথে মেনে নেয় নি, মুসলিমরা তো নয়ই, কিছু কিছু অমুসলমিও। এই অমুসলমিদের বিবিধ আপত্তি বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে তারা হয় দুর্বল যুক্তি নিয়ে এসেছে অথবা তাদের আপত্তি ভুল তথ্যের ওপর দাড়িয়ে। এই লেখায় 'এসো আঁকি মুহম্মদ' দিবসের সমালোচনা সমুহের ওপর আলোকপাত করা হবে, এবং আশা করা যায় মুহম্মদকে কেন আঁকবো সে বিষয়ে ধোঁয়াশা দুরীভূত হবে।
সর্বপ্রথমে আমরা রেসিস্ট বা জেনোফোবিক আক্রমন বিষয়ে শুরু করতে পারি। এই অভিযোগখানার ব্যাপারে ইহাই বলা যায় যে কিছু ব্যাক্তি আদতেই রেসিস্ট দৃষ্টিকোন থেকে ইসলামের সমালোচনা করে থাকেন, যা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। অবশ্যই এ ধরনের আচরন ঘৃন্য ও আমাদের সতর্ক নজর দাবি করে। তবে এটাও ঠিক নয় যে ইসলাম বিষয়ে সব ধরনের অভিযোগই রেসিজম বলে চালিয়ে দেয়া যায়।
ইসলামের সমালোচনা করার অসংখ্য কারন আছে, যেমনি কারন আছে যেকোনো ধর্মেরই সমালোচনা করার। আর এই সমালোচনা কোনভাবেই গুরুত্ব হারায় না যদি কিছু রেসিস্ট ক্রিমিনাল ধর্মের সমালোচনার আড়ালে তাদের রেসিস্ট বক্তব্য প্রচারের অপচেষ্টা করে।
আদতে ইসলামের পোঙ্গা মারতে হলে রেসিজমের কোনো প্রয়োজনই নাই। রেসিস্টরা ইসলামের পোঙ্গা মারতেই পারে, তাতে ইসলামের পোঙ্গা মারা রেসিজম হয়ে যায় না।
একই ভাবে কিছু বদলোক যদি মুহম্মদকে আঁকার উৎসবে সামিল হয়, তাতে উৎসবটা বদলোকের উৎসবে পরিনত হয় না। তারা যে কারনেই সমর্থন করুক না কেন, তারা আদতে বদ।
আবার অনেকে বলবেন এই উৎসবটা শিশুসুলভ খোঁচাখুচি, কোনো সত্যিকার বক্তব্য নাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। বাস্তব হলো, দিনটা একটা প্রতিবাদের দিন হিসেবেই পালিত হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে মোহাম্মদের ছবি আকার বিরোধীদের ভীতিজাগানিয়া আক্রমনাত্মক আচরনের বিরূদ্ধে। তাদের এই জঙ্গীপনা সৃষ্টি করেছিলো এক অদ্ভুত ঘন ভীতির আবহ, যেখানে মানুষ ও কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদের ছবি আঁকা বা ইসলামের সমালোচনা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলো, ‘না জানি কি হয়’ এই আতংকে। আতংকেই তারা সিঁটিয়ে গিয়েছিলো, মনোভাব প্রকাশ করার যে স্বাধীনতা, তাতে একগোলা কালি ঢেলে দেয়া হয়েছিলৌ। সমস্যাটা গভীর হয়ে পড়ছিলো, কারন শুধুমাত্র ইসলাম নয়, যেকোনো ধর্মের সমালোচনা করাই এক প্রকার শারিরীক ক্ষতির ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিলৌ। এটা বেশ চিন্তার বিষয়।
মুহম্মদ অঙ্কন দিবসের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো গন হারে মুহম্মদকে আঁকার মাধ্যমে এই ভীতির আবহ থেকে বিশ্ব মনন কে মুক্ত করা। এই যে সার্বক্ষনিক হুমকি মাথার ওপর, তার অপব্যাবহার শুরু হয়েছিলো বিভিন্ন দিকে। সারা বিশ্বে সকলে মিলে মুহম্মদকে বিভিন্নভাবে এঁকে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, যে আমরা ভীত হতে পছন্দ করি না। কার্টুন আঁকলে হুমকি দেয়ার চর্চাটাকেও আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি দৃঢ়ভাবে।
কোনটা বেশি ক্ষতিকর? কাউকে শারিরীক ভাবে আহত করা? নাকি তার ধর্মানুভূতিতে সুরসুরি দেয়া? ধর্মানূভুতিতে সুরসুরি দিলে গায়ে হাত তোলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না, এটাই দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
অনেকে বলেন, মুহম্মদকে আঁকলে সকল মোহামেডিয়ানেরই দিলে চোট লাগে, সুতরাং আমাদের ক্ষ্যান্ত দেয়া উচিত। শুনে বোঝা যায়, তারা মূল বিষয়টাই অনুধাবন করতে পারে নাই। কারো ছবি আঁকলে তাতে আহত হবার হাস্যকর কথাটা যে ফালতু হয়ে গেছে (সবসময়ই ফালতু ছিলো আসলে) সেটা তাদের কি করে বোঝানো যায়? ‘মুহম্মদের সবচে শিশুতোষ ছবিটা আঁকাটা নাকি চরমতম অপরাধ’ এই হাস্যকর বক্তব্য মেনে নেয়ার জন্য বলাটাই তো বালখিল্যতা।
আবার অনেকে বলেন, কোনটা অপমানজনক আর কোনটা নয়, এটা নির্ধারন করার আমরা কে? আমরা কে তাদের সংগে ভিন্নমত পোষন করার? আমরা আসলে কে? আসলে, আমরা হলাম সেই জনগোষ্ঠী যাদের বলা হচ্ছে রয়েসয়ে কথা বলতে যাতে ধার্মিকদের আঁতে ঘা না লাগে। আচ্ছা!! তারা যদি ধর্মানুভূতির সূচক রচনা করতে পারে, তাহলে সেই একই যু্ক্তিতে আমরাও তো তাদের সেই সূচক ধরে টান দিতে পারি, তাই না? শুধুমাত্র ধর্মীয় বলেই যেকোনো বিশ্বাস বুঝি সমালোচনার উর্ধ্বে উঠে যায়?
তারপরে, তোমরা কোথায় ছিলো তোমাদের অনুভূতির চাঙ্গড় নিয়ে, যখন ধাপে ধাপে খ্রীস্টানত্বের পশ্চাৎদেশ মথিত হচ্ছিলো গতো কয়েকবছর ধরে? ক্যাথলিক চার্চকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর তরিকা যখন ইন্টারনেটে প্লাবিত হচ্ছিলো, তোমাদের মুহম্মদ প্রীতির আদলে ধর্মবাজি তখন কোথায় ছিলো? ধর্মের পোঙ্গা মারা যদি অপরাধই হয়, তখন তোমরা কেন ঘুমুচ্ছিলে?
কিছু আছেন যারা বিজ্ঞের মতো বলেন, ‘আসলে মুসলামনদের জন্য এই বিশ্বাস খুবই গুরুত্ব রাখে, তাদের তাই ছেড়ে দেয়া উচিত’। আচ্ছা, আমি যদি বিশ্বাস করি তাদের এই বিশ্বাস ভুয়ো, তাহলে সেইসব বিজ্ঞ কি আমার বিশ্বাসও সন্মান করতে বলবেন না? এটা তো পরিষ্কার, কে কতো শক্তভাবে বিশ্বাস করে তার সাথে বিশ্বাসটার বাস্তব হবার কোনো সম্পর্কই নেই! কিছু আবাল আছে, তারা অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসে বিশ্বাস করে, তাতে কি সেটা সত্যি হয়ে যায়? বা সন্মানের যোগ্য হয়ে যায়? অন্ততঃ সমালোচনার থেকে বাঁচার জন্য এই বিশ্বাসের পোক্ততা কোনো কাজেই আসে না।
সত্যি বলতে, আমার যদি কোনো বিশ্বাস থাকেই, আমি বরং সমালোচনাকে স্বাগতঃ জানাবো, কারন আমি জানি সমালোচনার আগুনে পুড়ে আমার বিশ্বাস আরো খাঁটি হবে। আমি মোটেও দাবি করবো না, যে তারা যেনো আমার বিশ্বাসকে আহত না করে। বরঞ্চ সবারই উচিত সমালোচনাকে ধারন করা, তাকে যৌক্তিক মর্যাদা দেয়া।
অনেকে একটা হাস্যকর যুক্তির অবতাড়না করেন। বলেন, যে বিশ্বাসীর অস্তিত্ব এতোটাই ওতোপ্রোত ভাবে তার বিশ্বাসের সাথে জড়িত, যে তার বিশ্বাসের ভুল ধরিয়ে দেয়া একার্থে তাকে নির্মম ভাবে আঘাত করার মতোই, যার সত্যিকার কোন ফল নেই।
এই সমস্যাটা তো আসলে বিশ্বাসীর, সমালোচকের নয়। এছাড়াও বিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন খুবই সম্ভব। ধর্ম পরিবর্তনকারীদের দেখুন, প্রত্যাগত ও বিচ্ছিন্নদের দেখুন। তারা তো বিশ্বাসের বদল হয়েছে বলেই পরিবর্তিত হয়েছে? আর যেটা একজনের জন্য সম্ভব, তাত্বিকভাবে সেটা যে কারো জন্যেই প্রযোজ্য।
এছাড়াও, যুক্তিপূর্ণ ও প্রমাণ পাবার পরেও যদি কারো বিশ্বাসের পরিবর্তন না আসে, তাহলে তারাই তো এই অপরিবর্তনীয়তার জন্য দায়ী। আমাদের কোনো ঠেকা পড়ে নাই, তার বিশ্বাসের কারনে তাকে রক্ষা করে তারপরে সমালোচনা করার। বিশেষ করে যখন তারা সমালোচকদের প্রতি সহিংস হয়ে ওঠৈ। অজ্ঞতার দৃঢ় প্রস্তরের কেউ যদি তার বিশ্বাস ধরে বসে থাকে, সেটা আমাদের দোষ হয় কি করে?
অনেকে আবার মানবতাবাদীর ভেক ধরে বলেন, মুহম্মদের ছবি আঁকলে মুসলিমদের অধিকার খর্ব হয়। যদিও কোনো মুসলিমের স্বাধীনতার সাথে মুহম্মদের ছবি আঁকার কোনো প্রকার সম্পর্কই নেই। কেমনে কি! কারো বিশ্বাসের বিপরীতে যায় এমন কিছু সামনে পড়লেই যদি কারো অধিকার নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়, তাহলে তো সমস্যা। কারন সমালোচনা থেকে মুক্ত থাকার কোনো অধিকার কাউকে দেয়া হয় নাই। তোমার ধর্মকে সন্মান করতে গেলে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি খর্ব করতে হয়, তাহলে তো চলবে না। মোহম্মদের ছবি আঁকায় কারো কোনো অধিকার খর্ব হয়েছে বলে জানা নাই।
আরেক দল বলেন, জেনেশুনে সংঘর্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুহম্মদের ছবি আঁকার মাঝে এক ধরনের দায়িত্বহীনতা আছে। এরা এটাও বলেন, যে ছবি আঁকার কারনেই পাকিস্তানকে খোমাখাতা আর য়্যুটুব বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কি হাস্যকর যুক্তি! আরে বাবা, মোহাম্মদের ছবি আঁকার নিষিদ্ধতাকে তুলোধুনো করতেই না এই প্রতিবাদ দিবস, সেটাকেই আবার কারন হিসেবে দেখানো মানে জেগে জেগে ঘুমানো।
এটা তো পরিষ্কার, পাকিস্তানের জনগনকে খোমাখাতা আর য়্যুটুব থেকে বঞ্চিত করার দায়টা পাকি-সরকারের ওপরই বর্তায়। এটা দিবস-পালকারীদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টার অর্থ দাড়ায়, পাকি সরকার খোমাখাতা বন্ধ বিষয়টার দায়িত্ব নিতে চাইছে না। কি হাস্যকর। আমাদের যদি আমাদের কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যায়, তাহলে তাদের কাজের জন্য তারা দায় নিবে না কেন? নিজেদের পদক্ষেপের ওপর কি তাদের কোনো নিয়ন্ত্রনই নাই?
আসলে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের কাছে মানবজাতির যে প্রত্যাশা, মানে দায়িত্ববোধ, যৌক্তিকতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মুসলিমদেরকে এর অযোগ্য বিবেচনা করা বরং মুহম্মদ আঁকার চেয়ে বেশি অপমানকর। মুহম্মদ অংকন দিবসের বেশিরভাগ সমালোচনার শুরুটাই হয় এই ধারনা থেকে যে মুসলমানেরা এক ধরনের নীচু জাতের প্রাণী। তাদেরকে মানবজাতির পরিনত, যোগ্য ও সমান মর্যাদাসম্পন্ন সদস্য হিসাবে বিবেচনাই করা হয় না। এটা মোটেও ঠিক না।
কিছু আছেন, যারা খ্রীস্টান বা অন্যকোন ধর্মের সমালোচনায় দোষ খুঁজে পান না, যদিও ইসলাম নিয়ে কিছু বললে তাদের আবার গা জ্বলে। শুধুমাত্র ছবি এঁকেই যে ধুন্ধুমার লেগে গেলো তাতে এধরনের দ্বৈতরথও দেখা গেলো। প্রমান হলো যে দিবসটার প্রয়োজন ছিলো। অনেকগুলি বিষয় আলৌকিত হলো। যার প্রয়োজনও ছিলো।
আশা করি আগামী বছর আবারও হবে মুহম্মদ আঁকা ইদের দিনে দেখা, আপনাদের সবার সাথে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন