(কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই নাকি আসমানী কিতাবগুলোর জন্যে নতুন কিছু নয়। কারণ সব নাকি হাজার-হাজার বছর আগে রচিত সেই ধর্মগ্রন্থগুলোয় উল্লেখ করা আছে। হিন্দু এবং খ্রিষ্টান ধর্মবিদেরা আগে এমন দাবি করতো। তবে বহু বছর ধরেই তাদের সেই স্থান সগর্বে দখল করে রেখেছে ইসলাম।
পাকিস্তানের "ডন" পত্রিকায় প্রাসঙ্গিক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
লেখাটি ধর্মকারীর জন্যে সানন্দে অনুবাদ করে দিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন babble.
মূল রচনা এখানে।)
ফতেহউল্লাহ খানের নতুন বই, ‘গড ক্রিয়েটেড দ্য ইউনিভার্স’ হাতে পাবার জন্য আমার হাত রীতিমত নিশপিশ করছে। বইটির রিভিউ পড়েই বুঝেছি এটা নিশ্চিত আরো একটা বই, যেখানে সকল বৈজ্ঞানিক সত্য কীভাবে আসমানী কিতাবে আগে থেকেই লেখা আছে, সে বিষয়ে বড় বড় কথা থাকবে।
সেই যে কবে ফরাসি ডাক্তার মরিস বুসাইল্লি (Maurice Bucaille) সৌদি রাজপরিবার থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খেয়ে ‘ইসলাম, বাইবেল ও বিজ্ঞান’(১৯৭৬) নামে এক বই লিখেছে, তারপর থেকেই অনেকের ধারণা, পবিত্র গ্রন্থ থেকে বৈজ্ঞানিক সত্য ‘প্রমাণ’ করাতে বুঝি মুসলমানদের একচেটিয়া দখল। অবশ্য সেই ‘পবিত্র কিতাব’-এর এতসব বৈজ্ঞানিক চমৎকারিত্ব দেখে অভিভূত হওয়ার পরেও মরিস বুসাইল্লি নিজেই খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করেনি।
খুব কম লোকই জানে যে, মুসলমানদের অনেক আগেই কিছু হিন্দু এবং খ্রিষ্টানধর্মবিশারদ তাদের নিজেদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে কীভাবে বৈজ্ঞানিক সত্য লুকিয়ে আছে সে বিষয়ে দাবি তুলেছিলো। তারা এটা করেছে ১৮ এবং ১৯ শতকে, আর মুসলিমরা এ কাজ শুরু করেছে বিংশ শতাব্দীতে এসে।
জহানেস হেইনরিকের ‘সাইন্টিফিক ভিন্ডিকেশন অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি ‘(১৮৮৭) আর মোহন রায়ের ‘বৈদিক ফিজিক্স: সাইন্টিফিক অরিজিন অফ হিন্দুইজম’(১৯৯৯) বই দুটো দেখলেই অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসেও এসব ধারণার বিবর্তনের একটা চিত্র পাওয়া যায়। কতজন মুসলিম ‘বিজ্ঞানী’যে এসব আসমানী কিতাব থেকে বৈজ্ঞানিক তথ্য উদঘাটনের জন্য কঠোর সাধনা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। মজার ব্যাপার হলো, বাগগাদ আর পারস্যে এই এদের পূর্বসুরীরাই অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে সত্যি সত্যিই পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক পদ্ধতিতে মানুষের মনোদৈহিক ঘটনাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছে।
ইসলামের প্রাচীন কালের সেই মহান চিন্তাবিদরা কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তরের জন্য আসমানী কিতাবের দ্বারস্থ হয়নি। বরং তাদের জন্য আশেপাশের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করার ঐশ্বরিক আদেশই যথেষ্ট ছিলো যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার অনুপ্রেরণা হিসাবে। তারা তাদের বৈজ্ঞানিক অবদানের জন্য শুধু মুসলিম না বরং পুরো মানবজাতির কাছেই প্রশংসার পাত্র ছিলো।
কিন্তু হায়! ১৯৭০-এর শুরুর দিকে মুসলিমবিশ্বে ধর্মনিরেপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পতন হয়। আর এর পরেই তেলসমৃদ্ধ রাজতন্ত্রের কবলে পড়ে ইসলামিক রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা এমন হয়ে যায় যে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রীদের আগ্রাসনের হাতিয়ার ভাবতে শুরু করে।
যদিও স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই ধনী মুসলিম একনায়কেরা ছিলো পশ্চিমা পুঁজিবাদী দলে কিন্তু খুব দ্রুতই তারা প্রচুর প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণা উৎপাদন করে ফেলে এবং পশ্চিমা আর মার্ক্সিস্ট দু’দলকেই আক্রমণ করে বসে। এর সাথে যোগ হয় আরেকটা ধারণা যে, বিজ্ঞান হচ্ছে ইসলামকে অবমাননা করার জন্য ইহুদি-নাসারাদের ষড়যন্ত্র।
এই রক্ষণশীল শক্তিগুলো অনেক আরব এবং বেশকিছু পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীকে (প্রচুর অর্থ-প্রতিপত্তির বিনিময়ে) নিয়মিত আমন্ত্রণ জানাতো বই লেখার জন্য যেখানে লেখা থাকবে কীভাবে গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের হাজার বছর আগেই মুসলিম পবিত্রগ্রন্থসমূহে সেসব কথা বর্ণিত আছে।
এই যে আচরণ – যার উৎপত্তি একধরনের হীনমন্যতাবোধ থেকে এবং আধুনিক পশ্চিমা এবং বামপন্থী জাতিগুলোকে অবজ্ঞা করার বাসনা থেকে- দিনে দিনে তাদের অদূরদর্শিতাকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে, সেই সাথে পুরো মুসলিম বিশ্বের চিন্তা-চেতনাকেই একেবারে পঙ্গু করে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী যেমন জিয়াউদ্দিন সরদার, পারভেজ হুদভাই, এবং বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত যেমন মুহাম্মাদ আখন্দ হতাশা ব্যক্ত করেছেন মুসলিমদের এসব বইপুস্তকের ব্যাপারে, যেগুলো মানুষকে নিরুৎসাহিত করে গবেষণাগারে কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে। অনেককেই এই বুঝ দেওয়া হয়েছে যে, বিজ্ঞানে যা কিছু জানার আছে তার সবই ইতিমধ্যে তাদের আসমানী কিতাবে লেখা আছে।
যুক্তিবাদী মুসলিম পণ্ডিতরা বিংশ শতকের শুরু থেকেই বলে আসছেন যে, এই পবিত্র গ্রন্থটা পুরোপুরি বিজ্ঞানের আর আইনের বই হতে পারে না। বরং তাঁদের মতে এটা মুসলিমদের জন্য একটা দিক নির্দেশনা যেখানে ঈশ্বর তাদেরকে মুক্তচিন্তার অধিকার দিয়েছেন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন নৈতিক এবং পরিক্ষণনির্ভর জ্ঞান অর্জনের।
ইরানি লেখক ভালি রেজা নাসর ঠিকই বলেছেন যে যদিও বেশির ভাগ মুসলিমই পশ্চিমা বিজ্ঞানকে খুব দ্রুতই আয়ত্ব করতে পারে, তবুও তারা একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে স্রেফ অস্বীকার করে চলেছে। এতে অবাক হবার কিছুই নেই যে, বেশির ভাগ পাকিস্তানী জানেই না, তাদের দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ডক্টর আবদুস সালাম কোন অবদানের জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই বিগ ব্যাং থিওরির কথা কীভাবে তাদের পবিত্র গ্রন্থে আগে থেকেই লেখা ছিলো, সে বিষয়ে হারুন ইয়াহিয়া বা মরিস বুসাইল্লি মত ভণ্ডদের কথা ফটাফট কোট করতে পারবে।
এইসব ভণ্ডামি ছাড়াও, কীভাবে জ্বিনদের থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে, তার উপরও বিস্তর বই পুস্তকও লেখা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এমনকি জিয়াউল হকের আমলে ১৯৮০-র দিকে একটা পুরো অধিবেশনই আয়োজন করা হয় যেখানে বিজ্ঞানী নামধারী কিছু ভণ্ডকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিলো ‘স্বর্গের বিস্তার’ নির্ণয় করার জন্য, এবং জ্বিন ধরে কীভাবে জ্বালানি সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে, সে বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য।
তাহলে আর এতসব বিজ্ঞানের বই-পুস্তক পড়ে কী লাভ, পরীক্ষাগারে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রকৃতি আর প্রাণিজগত নিয়ে গবেষণারই বা কী দরকার; বসে বসে আসমানী কিতাব পড়লেই হয়! বলা তো যায় না সময় পরিভ্রমণ বা লেজারগান তৈরির কোনো তত্ত্ব হয়তো পাওয়া যাবে তাতে। আবদুস সালাম, আইন্সটাইন, স্টিফেন হকিং বা অতীতের সেই মহান মুসলিম বিজ্ঞানীদের কথাও ভুলে গেলেই চলে। শুধু সব রকম জ্বালানি সমস্যা সমাধানের জন্য পড়শী জ্বিনটার সাহায্য নিতে হবে, ব্যস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন