লিখেছেন কৌস্তুভ
শারদীয়া ১৪১৭’র আনন্দবাজার পত্রিকায় স্বাতী গুহ লিখছেন – “বঙ্কিমচন্দ্র, মহেন্দ্রলাল, রামেন্দ্রসুন্দর, সকলেই ডারউইনের বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করেছিলেন। কোনও একটি ‘আদি কারণ’ ছাড়াই সৃষ্টি হতে পারে, কোনও নিগূঢ় উদ্দেশ্য ছাড়াই জীবজগত চালিত হতে পারে, তা উনিশ শতকের ইউরোপ-প্রভাবিত মনীষার কাছে নিতান্ত অযোগ্য ব্যাখ্যা বলে মনে হয়েছিল।”
লেখিকা উৎসনির্দেশ করেন নি, তাই বলতে পারছি না, বঙ্কিম কোথায় ডারউইনের বিরোধিতা করেছেন। ওনার লেখালিখির এক বড় অংশই এখনও অবধি পড়েছি, কোথাও তো স্মরণ হয় না। ওনার বিজ্ঞানরহস্য অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধসংগ্রহের ‘কত কাল মনুষ্য?’ প্রবন্ধে উনি বাষ্পাবস্থা থেকে সূর্য্য আদি পৃথিবীর সৃষ্টি, ভূগর্ভ থেকে ফসিল স্তর অনুসারে জীবের উৎপত্তি ও লোপের ইতিহাস নির্ণয়, যে ভাবে আলোচনা করেছেন তাতে তো তাঁকে এই মতের বিরোধী বলে মনে হয় না। নিজেই বলছেন, “অতএব মনুষ্যের সৃষ্টি সর্ব্বশেষে”।
উনি কিন্তু এই প্রসঙ্গে বাইবেলে মানুষ সৃষ্টির উপাখ্যানকে খোঁচাতে ছাড়েন নি। আর সেই সঙ্গেই সনাতন ধর্মের কাহিনীর দিকেও ঝোল টেনেছেন। ওনাকেই উদ্ধৃত করি –
“খ্রীষ্টানদিগের প্রাচীন গ্রন্থানুসারে মনুষ্যের সৃষ্টি এবং জগতের সৃষ্টি কালি পরশ্ব হইয়াছে। যে দিন জগদীশ্বর কুম্ভকাররূপে কাদা ছানিয়া পৃথিবী গড়িয়া, ছয় দিনে তাহাতে মনুষ্যাদি পুত্তল সাজাইয়াছিলেন, খ্রীষ্টানরা অনুমান করেন যে, সে ছয় সহস্র বৎসর পূর্ব্বে। এ কথা খ্রীষ্টানেরাও আর বিশ্বাস করেন না। আমাদিগের ধর্ম্ম-পুস্তকের কথার প্রতি আমরাও সেইরূপ হতশ্রদ্ধ হইয়াছি। বিজ্ঞানের প্রবাহে সর্ব্বত্রই ধর্ম্ম-পুস্তকসকল ভাসিয়া যাইতেছে। কিন্তু আমাদিগের ধর্ম্ম-গ্রন্থে এমন কোনো কথা নাই যে, তাহাতে বুঝায় যে, আজি কালি বা ছয় শত বৎসর বা ছয় সহস্র বৎসর বা ছয় বৎসর পূর্ব্বে এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃজন হইয়াছে। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে কোটি কোটি বৎসর পূর্ব্বে, অথবা অনন্ত কাল পূর্ব্বে জগতের সৃষ্টি। আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানেরও সেই মত।”
হিন্দু ধর্ম্ম-গ্রন্থ বলতে উনি ঠিক কোন কোন বই বোঝাচ্ছেন সে কথা পরিষ্কার করে বলেন নি, কিন্তু স্পষ্টতই এখানে বঙ্কিমকে ‘চেরি-পিকিং’ এর দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। ‘কোটি কোটি বছর আগে জগতের সৃষ্টি’ সংক্রান্ত অন্যান্য গল্পগাছাগুলি রূপক বলে (অন্যত্র) উড়িয়ে দিয়ে ‘ইউরোপীয় বিজ্ঞানেরও তাই মত’ বলে চালিয়ে দিলেন। তাই এর মাঝে বিষ্ণুর নাভিপদ্ম, কূর্মের পিঠে পৃথিবী এসব তো চেপে গেলেনই, আর কোটি বছর আগে পৃথিবী সৃষ্টি হলেও আধুনিক বানরজাতি এবং মানুষ এসেছে যে মাত্র হাজার কি লক্ষ বছর আগে, সেসবের কোনো বিবেচনা যে ওই সব বইতে নেই সেসব নিয়েও কথা তুললেন না। অবশ্য বঙ্কিম কট্টর ধার্মিক মানুষ, সনাতন ধর্মের পুনর্জাগরণে উৎসাহী, ওনার থেকে আর কতই বা বেশী আশা করা যায়।
গত শতকের মধ্যভাগে বিখ্যাত ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী হল্ডেন ভারতে এসে ভারতীয় ভাবধারা এবং হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। উনিও ‘সনাতন ধর্মের আলোকে’ সব বিচার করতে লাগলেন নতুন নতুন আঙ্গিকে। পেশাভিত্তিক যে উৎস ছিল বর্ণপ্রথার, সেটাকে সমর্থন এবং কিছু বিতর্কিত অংশও ওনার পছন্দ হতে লাগল। আমার অন্য একটা লেখা থেকে একটুখানি –
‘ভারতের আলোকে ডারউইন’ বিষয়ক একটা প্রবন্ধে একটা মজাদার কথা বললেন উনি। বললেন, যে ডারউইনকে তাঁর মত ছড়িয়ে দিতে হয়েছিল খ্রীষ্টীয় ভাবসম্পন্ন সমাজে। আর বাইবেলের গল্প বলে, এই জগতের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বর বিশেষ যত্ন নিয়ে শুধু আমাদেরই সৃষ্টি করেছিলেন, বাকি জীবজন্তু-গাছপালা সব তুশ্চু, আমাদের সেবার জন্যই তৈরী। তাই বিবর্তনের পথে এদের আর আমাদের সম্পর্ক মেনে নিতে লোকের এত অসুবিধা হয়েছিল। ডারউইন যদি ভারতে জন্মাতেন, ওনার এত অসুবিধা হত না, কারণ ভারতীয় দর্শন বলে, সব জীবই ঈশ্বরের সৃষ্ট, তাঁর প্রিয়, জীবে সেবাই আমাদের ধর্ম, তাদেরও সম্মান করা উচিত। আর বাঁদরকে তো আমরা পুজোই করি, তাই তারা আমাদের পুর্বপুরুষ মেনে নিতে কোনো সমস্যাই হত না। ইন্টারেস্টিং!
সম্প্রতি বাবা রামদেব নামক এক নতুন উৎপাত খুব চালু হয়েছে। সেই ব্যক্তি টিভিতে তার নিজস্ব ধর্ম-চ্যানেলে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে দাবি করে, সে যোগ দ্বারাই ক্যান্সার ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দিতে সক্ষম। জাকির নায়েকের মতন এ’ই এখন মিডিয়ায় সনাতন হিন্দুধর্মের মুখপাত্র। কিন্তু এহেন লোকের ধর্মভাবনা বা ডারউইনভাবনা কোনোটাতেই আমি আগ্রহী নই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন