হিন্দু ধর্ম বিষয়ে কোনও পোস্ট দেবার আগে যে কোনও সংশয়ে বা প্রশ্নে ধর্মকারীর অবৈতনিক হিন্দুধর্মবিদ কৌস্তুভ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিই। একটু অনুরোধ করলে সেই পোস্টগুলোর জ্ঞানগর্ভ ভূমিকাও লিখে দেন তিনি। যেমন করেছেন এই পোস্টের জন্য। ফলে বিশিষ্ট ভূমিকাবাজ হিসেবেও তিনি তাঁর আসন পোক্ত করে ফেলেছেন।
খ্রীষ্টজন্মের হাজারদুয়েক বছর আগে আর্যরা হইহই করে ঢুকে পড়ল ভারতে, এশিয়া মাইনর থেকে উত্তর-পশ্চিমের পথ ধরে। সেখানে সিন্ধু সভ্যতার দ্রাবিড় গোষ্ঠীকে ঠেলে সরিয়ে দিল মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে। উত্তর আর পশ্চিম ভারতে ধীরেসুস্থে জমিয়ে বসল, দ্রাবিড়দের সঙ্গে কিছু মিশ্রণের মাধ্যমে কিছু কিছু সংস্কৃতিকে আত্তীকরণ করে নিল। তার মধ্যে ছিলেন একজন দেবতা – পশুপতি, আর একজন দেবী – প্রকৃতি। কালে কালে পশুপতি শিব এবং প্রকৃতি কালী হয়ে আর্যদের ধর্মপুস্তকেও জায়গা করে নিলেন, পরস্পর বিয়ে-থা দিয়ে দেওয়া হল তাঁদের। এমনিতে আর্যদের সব দেবদেবীই ফর্সা, এঁরাই কালো রয়ে গেলেন। অবশ্য একজন ফর্সা দেবী, যিনিও প্রকৃতির স্ট্যাটাস পেতেন মোটামুটি, তাঁকে কালীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল। এদিক থেকে বৈদিক ধর্মের সুবিধা – একই দেবতার হাজার রূপ, এক এক রূপে এক এক কর্ম। তারা, দুর্গা, পার্বতী, বৈষ্ণোদেবী, অনেক রকম রূপে ফর্সা দেবীটিই মূলত প্রচার পেতে লাগলেন, কালো দেবীটি কেবল ভয়ঙ্করী রূপে চণ্ডী নামে কিছু কিছু জায়গায় খাতির পেলেন। অবশ্য একটা আলাদা ভাগ তৈরী হয়ে গেল যারা এই দেবীর অনুসারে কিছু জটিল ক্রিয়াকলাপ করতে লাগলেন - হিন্দুধর্মে তার নাম হল তন্ত্র, আর এই তন্ত্র যুক্ত হয়ে বৌদ্ধধর্মের একটা ধারা হয়ে উঠল বজ্রযান।
অনার্যদের মধ্যে কিন্তু আদিম দেবী হিসাবে কালীর নানা ফর্মই পুজো পেতে লাগল। মধ্য আর পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের মধ্যে সেই অভ্যাসই দেখা যায়, আর্য দেবদেবীদের সেখানে খাতির নেই। ভারতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলাতেই দ্রাবিড় রক্তের ভাগ বেশী। 'বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার' প্রবন্ধ-সিরিজে বঙ্কিম দেখিয়েছেন, বাংলায় ‘খাঁটি রক্তের’ আমদানি প্রথমে করলেন ধর্মপ্রাণ বল্লাল সেন, আর্য্যাবর্ত থেকে কয়েক ঘর ব্রাহ্মণ এনে। তাদের মধ্যে দিয়েই কুলীন বামুন ইত্যাদি অভ্যাসের চল বাংলায়। তারা গুচ্ছে গুচ্ছে বংশবিস্তার করতে লাগল, গণ্ডা গণ্ডা বিয়ের মাধ্যমে। কিছুদিন পর কয়েক ঘর বৈশ্য এল, যাদের থেকে কায়স্থ ইত্যাদিদের বংশপ্রচলন। নইলে, ভারতের অধিকাংশ স্থানে উচ্চকুলশালী ব্রাহ্মণেরা এমনিতে সংখ্যালঘু; এখানে হয়ত তাদের অনুপাত বৈশ্যদের তুলনায় একটু বেশীই হবে।
যাহোক, কালীর রবরবা কিন্তু বাংলায়, বিশেষত একটু ‘নিচু জাত’ যারা, তাদের মধ্যে রয়েই গেল। কালীর একটু আদিম, একটু হিংস্র, একটু রাগী, একটু ভয়ঙ্করী রূপ – একটা ফ্যান্টাসিই এসে গেল অনেকের মধ্যে, এমন কি ব্রাহ্মণদেরও। যেমন সাধক রামপ্রসাদ, সাধক কমলাকান্ত, সাধক বামাক্ষ্যাপা। এরকম অনেকেই হয়ে উঠলেন তান্ত্রিক। কালীর এই রূপটা ডাকাতদেরও খুব পছন্দ ছিল, বলাই বাহুল্য। তারা ডাকাতি করতে বেরোবার আগে, মা কালীর পুজো দিয়ে, নরবলি দিয়ে, সাফল্যের প্রার্থনা করে বেরোত। ও হ্যাঁ, একটু বলি না হলে কি এমন রণচণ্ডী দেবীর ইমেজে পোষায়? নরবলি হলে তো আরোই ভালো। কত জমিদারবাড়িতে, কত মন্দিরে পটাপট বলি হতে লাগল মায়ের চরণে, সেই বলিনিঃসৃত টাটকা রুধিরস্রোত দিয়ে মায়ের চরণসেবা, মায়ের স্নান, ভক্তদের অঙ্গলেপন, মাথার টীকা, খর্পর (মাথার খুলি) করে সাধকদের সেই পবিত্র তরল পান – কত প্রয়োজন বলির। আর যাকে বলি দেওয়া হচ্ছে, তারও তো একেবারে সটান স্বর্গযাত্রা বাঁধা। তা হাজার হোক, একটু সাফল্য-ধনদৌলত-সুখশান্তির আশা সবারই থাকে – রাজা, জমিদার, পুরোহিত, প্রজা, গরিবগুর্বো – আর এমন কাঁচাখেকো দেবতাকে তুষ্ট না করে উপায় আছে?
ধর্মবিশ্বাস মানুষের সুস্থ চিন্তাশক্তিকে নিশ্চয়ই বিকল করে দেয়। এছাড়া অন্য কোনও বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না এর পরের ছবিগুলোয় দেখানো ঘটনার ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন