বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০১১

দেবদাসীদের সম্মানিত পতিতাবৃত্তি


হিন্দু ধর্ম বিষয়ে আমার জ্ঞান ঈর্ষণীয় পর্যায়ের কম বলে দেবদাসী প্রাসঙ্গিক এই ডকুমেন্টারি-পোস্টে ভূমিকা লিখে দেবার অনুরোধ করেছিলাম সাম্প্রতিককালে ধর্মকারীর অন্যতম সক্রিয় পাঠক কৌস্তুভ-কে। তিনি অতি অনবদ্য ও সারগর্ভ একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয় বলে বেহেশতে যাবার কোনও সুযোগ তাঁর নেই। থাকলে আমার ভাগের কয়েকটা হুর তাঁকে উপহার দিতাম 

অনেকে বলেন, পৃথিবীর আদিমতম পেশা হল পতিতাবৃত্তি। আরেক প্রাচীন পেশা হল ধর্মব্যবসা। দুয়ে মিলে মানব-ইতিহাসের আদি যুগ থেকেই নানা সভ্যতায় পুরোহিতরা চালু করেছিল মন্দিরে মন্দিরে এক শ্রেণীর সম্মানিত বারাঙ্গনা রাখার প্রথা, শাসকদলের অনুমোদনেই। হেরোডোটাসের লেখায় আছে প্রাচীন ব্যাবিলনিয় সভ্যতায় মন্দিরকে রতি-মন্দিরে পরিণত করার কাহিনী। ফিনিশীয়, আর্মেনীয়, পারস্যের সভ্যতাতেও রয়েছে প্রাচীন যুগে মন্দিরে পুরোহিতদের আয়োজনে কুমারী মেয়েদের সাথে অপরিচিত পুরুষদের মিলন-আয়োজনের বর্ণনা এবং, উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, এগুলি ছিল ওই মহিলাদের জন্য সামাজিক কর্তব্য বা বিশেষ সম্মানের ব্যাপার।

ভারতেও প্রাচীন যুগ থেকেই হিন্দুধর্মে চলে আসছে দেবদাসী প্রথা। এই মহিলারা মন্দিরের ভরণপোষণে থেকে ঈশ্বরের দাসী হিসাবে দেববিগ্রহের সেবা, মন্দিরের কিছু কাজকর্ম, এবং নিয়মিত নৃত্যগীত করে দেবতা ও সমবেত ভক্তদের চিত্তবিনোদন করতেন। তবে, দুষ্ট লোকে বলে, মন্দিরের পুরোহিতবর্গের ক্ষুধাতৃষ্ণার মত আরেকটি জৈবিক চাহিদাও... তাছাড়া মহারাজ বা অন্যান্য ধনী ভক্তরাও যখন মন্দির পরিদর্শনে আসতেন, তখন তাঁদের ‘সবরকম’ সুখসুবিধার ব্যবস্থাও দেখতে হবে তো।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও দেখা যায় দেবদাসীদের উল্লেখ। তবে এটি ধর্মের কারণে একপ্রকার সম্মানিত পতিতাবৃত্তি বলে, উনি সাধারণ পতিতাদের জন্য রাজকর এবং আইনকানুনের উল্লেখ করে দিলেও দেবদাসীদের জন্য তেমন কিছুর প্রয়োজন বোধ করেন নি, অথবা সরকারের ক্ষমতা অতদূর বিস্তৃত নয়... কে না জানে, ধর্মের স্থান ক্ষত্রিয় শাসকদেরও উপরে।

মন্দিরগুলিতে অনেক পিতামাতা মানত হিসাবে, বা স্রেফ অভাবের তাড়নাতেই, তাদের শিশুকন্যাকে দান করে যেত দেবদাসী করার জন্য। কখনও রাজারা যুদ্ধ জয়ের পর খুশি হয়ে বা নানান কারণে মন্দিরে দান করতেন দেবদাসী। কি কখনও পুরোহিতরা নিজেরাই পছন্দসই মেয়ে পেলে ধরে নিয়ে আসতেন – আইনের হ্যাপা বড় ছিল না। কোনো কোনো মহিলা অবশ্য নিজের ইচ্ছাতেই, ভক্তিতে বা কেবল আশ্রয়ের আশাতেই আসতেন মন্দিরে। 

সারা ভারত জুড়েই দেবদাসী প্রথার চল থাকলেও বিশেষ রবরবা ছিল দাক্ষিণাত্যে। সেখানে রাজারা এক এক পুণ্য অনুষ্ঠানে কয়েকশ দেবদাসী দান করতেন মন্দিরে। ইয়েলাম্মা বলে এক দেবী ছিলেন দেবদাসীদের ঈশ্বর। সেই সময়েও অবশ্য অল্প কিছু লোক এই প্রথায় অসন্তুষ্ট ছিল, পরে বৃটিশ সরকারের কাছেও এ প্রথা বিলোপের আবেদন করে অনেকে ‘হিন্দুবিরোধী’ ব্যঙ্গে খ্যাত হন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কিছু কিছু রাজ্য আইন করে এ প্রথা রদ করতে থাকে।

কিন্তু তাঁরা একটা জিনিস ভাবার প্রয়োজন মনে করলেন না, যে এই মেয়েগুলির এবার কী হবে। তাদের সংসারে কেউ নেবে না, জীবিকাও তারা কিছু জানে না। কেউ কেউ মন্দিরে আশ্রয় পেল, কিন্তু পুরোনো কলঙ্ক বিধায় তাদের অনেক মন্দিরই খেদিয়ে দিতে চাইল। উপায়াভাবে অনেককেই নেমে পড়তে হল সম্পূর্ণ পতিতাবৃত্তিতে, অনেকে হয়ে রইল বড়লোকের রক্ষিতা। দেবদাসী প্রথার আদিকথা ও এই আশ্রয়চ্যুত মহিলাদের দুরবস্থা নিয়ে ১৯৮৩’তে নারায়ণ সান্যাল দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’ ও ‘সুতনুকা কোন দেবদাসীর নাম নয়’ বলে। তবে শোনা যায়, দক্ষিণ ভারতে এদিক-ওদিকে এখনও ওই মহিলারা উপায়ান্তর না দেখে, জীবিকার খোঁজে, বুভুক্ষু মানুষের চাহিদা মেটাতে, সমাজের চাপে, এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন এই পেশা। এখন ধর্মের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ অল্পই, তবে কিছু বেশী সম্মানের আশায় তাঁরা দেবদাসী নামটা ছাড়েন নি।

প্রায় আধাঘণ্টার ভিডিও দেখুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন