মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০১১

ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে


লিখেছেন কৌস্তুভ

কল্‌কত্তা হাওয়াই অড্ডা অর্থাৎ কিনা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে রাত আড়াইটেয় প্লেনে উঠলাম। ফ্রাঙ্কফুর্ট-বোস্টন। প্রবল ঘুম পেয়েছে, কিন্তু প্লেনে ঘুম আসে না, তাই কিংকর্তব্য ভাবছি। যাত্রী বোর্ডিং চলছে, আইল সিটে বসে স্থূলাঙ্গী বধূ থেকে স্থূলাকৃতি লাগেজ সবার গুঁতো খাচ্ছি। এমন সময় এক মাঝারিউচ্চতাবিশিষ্ট ছোটকরেছাঁটাগাঢ়সোনালীগোঁপদাড়িওয়ালা শ্বেত(তামাটে)’আঙ্গ মাঝবয়সী ব্যক্তি আমার লাগোয়া উইন্ডো সীটটায় সুড়ুৎ করে বসে পড়ে তীব্রবদগন্ধযুক্তওষ্ঠাধরে আমার দিকে এক আশিভাগ-করুণা-বিশভাগ-বিষাদ মিশ্রিত স্মিত হাস্য ভাসিয়ে দিলেন। অতএব দ্রুতই অনুমান করলাম, (১) ইনি আমেরিকান, (২) মুমিন ব্যক্তি, (৩) ব্যাটার উদ্দেশ্য সুবিধার নয়। 

নিজে থেকেই আলাপ শুরু করলেন। আমি কোথায় যাব, কী করি। আমি খবর্দার কোথাও ইউনির নাম করি না – বস্টনে গোবেষণা করি, এইটুকুই। তা বেশ, কী পড় খোকা? বললাম, বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স। নামে কেউই বোঝে না, তাই এক লাইনে টীকাও জুড়ে দিতে হয়। কিন্তু উত্তরের জবাবে ওনার যেমন নির্লিপ্ত মুখচ্ছবি দেখলাম, তাতে (১) এবং (২) সম্পর্কে প্রতীতি জোরদার হল। 

কথাবার্তা একতরফা হলে অসামাজিক দেখায়, তাই এবার কিছু খেজুরে প্রশ্ন করা শুরু করলাম। হে মহান বৈদেশিক অতিথি, এই নগণ্য শহরে আপনার পদধূলি পড়ল কী প্রকারে? উত্তর শুনে মেজাজটা যেমন গরম হয়ে গেল, তেমনই (২) ও (৩) সম্বন্ধে আমার গণনা যে নির্ভুল ছিল তা প্রমাণিত হয়ে গেল। উনি ভারতে এসেছেন ধর্মপ্রচারে! 

অর্থাৎ আমরা যখন চেষ্টায় আছি বিদেশ থেকে কিছু শিক্ষাদীক্ষা সংগ্রহ করে ফিরে এসে দেশের মানুষজনের সাথে ভাগ করে নেওয়ার, ইনি নিজের দেশ থেকে বয়ে এনে বস্তাখানেক গাঁজাগুল-কুসংস্কার আমাদের গছিয়ে দিয়ে যাওয়ার তালে আছেন। এই মহাশয় একটি খ্রীষ্টধর্ম-আলোচনা-প্রচার-সমিতির সভ্য। তাঁরা (কারণ আছে, পরে বলছি) অবশ্য এইবার সরাসরি প্রচারব্যাটিংয়ে না নেমে ‘জ্ঞান’বিস্তারে ফিল্ডিং করছেন, অর্থাৎ ওঁদের সমিতি-নির্বাচিত কিছু উত্তম উত্তম ধর্মগ্রন্থের অনুবাদযুক্ত লিফলেট বয়ে নিয়ে এসেছেন আমাদের শহরগুলিতে বিতরণের জন্য। 

শুনলাম, ইনি গেছেন দিল্লী, বেঙ্গালুরু, উত্তর ভারতের আরো দুএকটা শহর আর সবশেষে কলকাতা (সেখানে সিকিম থেকে আসা আরো কিছু ধার্মিক বন্ধুরা মেহফিল করেছেন, মূলত সেজন্যই এ শহরে আগমন)। জিজ্ঞাসা করলাম, তাজমহল দেখেছেন? বললেন, নাঃ, কোথাওই দর্শনীয় কিছু দেখেন নি। যেখানে গেছেন, দুএকদিন করে থেকেছেন, বন্ধুদের সাথে চার্চে চার্চে সভাসমিতিতেই লিপ্ত থেকেছেন। এমন কি কলকাতায় টেরিজা’র হোমেও যান নি। ধুত্তোর, বিদেশাগতরা এমন হলে আমাদের ট্যুরিস্টনির্ভর ব্যবসাগুলোর বড়ই লস। 

বেশি কোথাও না যাবার আরো একটা কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন। ওনাদের সমিতি ও পরিচিতরা নাকি সাবধান করে দিয়েছিল, ভারতে ভিন্ন ধর্মের লোকেদের নাকি ভাল চোখে দেখা হয় না। ইনি যতটা ঘুরেছেন তাতে সেরকম কিছু মনে হয় নি বটে, কিন্তু তাও প্রকাশ্যে বেরোতে ওনারা তেমন ভরসা পান নি। শুনে হাসব কি কাঁদব বুঝতে পারলাম না, তবে জ্ঞানের বহর দেখে (১) এর ধারণা কিছু জোরদার হল। বললাম, শুনুন মশাই, শ্বেতাঙ্গ ট্যুরিস্ট মানেই খ্রীষ্টান ধরে নেওয়া হলেও, বড় বড় শহরে তো এমন ট্যুরিস্ট কোনো ব্যাপারই না, মফঃস্বলের দিকে গেলে হয়ত একটু আগ্রহের বস্তু হবেন, কিন্তু ভিন্ন জাতি বা ভিন্ন ধর্ম কোনোটার কারণেই ভারতীয়রা সচরাচর হোস্টিলিটি দেখায় না। তবে হ্যাঁ, রাস্তায় রাস্তায় ঘাপলা প্রচার করতে গেলে হয়ত তারা বিরক্তি প্রকাশ করবে, কারণ তারা যা নিয়ে শান্তিতে আছে তাতে অহেতুক টানাহ্যাঁচড়া চাইবে না, এছাড়া কোনো সমস্যাই নেই। 

শুনে ভদ্রতা করে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও কোনো তেমন নিরাপত্তার অভাব টের পাই নি বটে, অবশ্য আমি তো কেবল ওই কাগজগুলো সঙ্গে এনে দিয়েছিলাম, মূল প্রচার করবে এখানকার চার্চের লোকেরাই। এই যেমন আমি একবার সপরিবারে চার বছর জামাইকায় ছিলাম সক্রিয়ভাবে ধর্মবিস্তার করার জন্য, সেরকম কিছু না। 

তারপর একটু খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তা দাদাগো, আপনি যে এদিক-ওদিক ধর্ম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তা আজকালকার ছেলেপিলেরা তো আরো মোনাফেক হয়ে যাচ্ছে, নাকি? ভালো কথা প্রীচ করলে পাত্তা দেয় না, আচার-টাচার তেমন মানে না, চার্চেফার্চে যায় না, বিশ্বাসীদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে, তা কী বলেন? 

অনেক দুঃখটুঃখ করে বললেন, হ্যাঁ, সে ট্রেন্ড তো খানিক দেখছিই, কিন্তু কী করা? আসলে মুশকিল হল, আজকাল লোকে সত্য ধর্মের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে না – যে বিকৃত রূপ দেখছে তাতে স্বীকৃত হতে পারছে না। অল্প কয়েকজন লোক হলেও, তাদের নামে যে স্ক্যাণ্ডাল ছড়াচ্ছে (সরাসরি না হলেও শিশুনিপীড়কদের কথা যে তুলেছেন, এতেই আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে গেছে, অ্যাপলজিস্ট হয়ে অল্প কয়েকজন তো বলবেনই), কারুর কারুর প্রবল বিত্তশালী যে চেহারা মিডিয়ায় আসছে – আমাদের প্রভু যেমন বলে গেছেন আড়ম্বরহীন সৎ-সাধারণ-জীবনযাপন করতে তার পবিত্র ইমেজ তুলে ধরতে এরা ব্যর্থ হচ্ছে – তা দেখে লোকজন বলছে, এই যদি ধর্মের চেহারা হয় তবে এ ধর্ম আমরা চাই না। 

তারপর উত্তেজিত হয়ে পড়ে বললেন, আর দেশের ব্যবস্থাও সব যাছে গোল্লায়! এই তো, সম্প্রতি আমাদের অকম্মা সরকার আইন করেছে, স্কুলের শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের প্রেয়ারে লীড করতে পারবে না। এটা একটা কথা হল? তারা সুকুমারমতি, একটু সদিচ্ছা নিয়ে ঈশ্বরের নাম করবে, সত্য পথে একটু শিক্ষা পাবে, সেই অধিকারটুকুতেও বাগড়া! 

আরো চটে গিয়ে বললেন, আবার কিছু পাষণ্ড এসবে ইন্ধন যুগিয়ে লোকেদের পথভ্রষ্ট করে বেড়াচ্ছে! এই তো, আমাদের পবিত্র পিতৃভূমি, ওয়ান নেশন আন্ডার গড, তা আমাদের টাকাপয়সা ইত্যাদিতে যে ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ কথাটুকু লেখা রয়েছে, সেই টাকাপয়সা দেওয়ানেওয়ার মধ্য দিয়ে একটুখানি রোজ সর্বশক্তিমানের মহিমার কথা লোকে স্মরণ করতে পারে, সেই লেখাটুকু তুলে দেওয়ার আন্দোলনও শুনি কোন হারামজাদারা শুরু করেছে! সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, যখন লন্ডন যাই তখন পাউন্ডের নোট হাতে নিয়ে বড় পুলক হয়েছিল, কারণ তাদের নোটে ডারউইনের ছবি, আর এদিকে মার্কিন নোটে গডস্তুতি। ফ্যাকফ্যাক করে হেসে উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু চেপে গেলাম।


একটু শান্ত হয়ে এবার প্রসঙ্গ বদলে বললেন, আমি জীবনে তেমন বড় বিদেশী শহর দেখি নি যদিও, কিন্তু একটা জিনিস আমার চোখে লাগে, এখানে অন্ত্যজ মানুষদের জীবনে বড় দুর্দশা! এই তো কাল কলকাতার রাস্তায় একটু বেরিয়েছিলাম, দেখলাম ফুটপাথে একজন শীর্ণকায় একখণ্ড কাপড় পরা লোক শুয়ে রয়েছে, ঘুমিয়ে আছে কি মারা গেছে বোঝা যাচ্ছে না, জনস্রোত তার সামনে এসে দুভাগ হয়ে দুপাশ দিয়ে গিয়ে আবার জুড়ে যাচ্ছে। এমনই অবস্থা কী সারা দেশেই? 

দেখলাম, এর সঙ্গে সহমত হয়ে দেশের সমস্যার কথা আলোচনা করে কোনো লাভ নেই, বলবে সবই ঈশ্বরের লীলা আর তোমাদের সিন’এর শাস্তি। তাই সোজা ব্যাটে খেললাম। বললাম, আপনাদের আমেরিকায় তো আমি বড় শহরেই থাকি, বস্টন-নিউইয়র্ক-ডিসি-ফিলি যত শহরই দেখেছি সর্বত্রই হোমলেসদেরও যথেষ্ট দুরবস্থা। তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেক ঝাঁ-চকচকে আমেরিকায় এসে এদের দেখে আমিই বরং প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়েছিলাম। তা কালকেরটা এরই তৃতীয় বিশ্ব ভার্শন। অবাক হন কেন? 

তারপর আরো বললাম, দেখেন, ভারতে জনসংখ্যা একটা বড় সমস্যা; লোকজন অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বাড়লে দারিদ্র্যও বাড়বে বই কি। তাও তো সরকার জন্মনিয়ন্ত্রণের দিকে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছে – আপনাদের মতে তো গর্ভপাত পরিবারপরিকল্পনা সবই ঈশ্বরেচ্ছাবিরোধী (পরে শুনলাম, ওনার ফ্যামিলি সাইজও যথারীতি মাশাল্লা) – কি ভাগ্যি সেসবে কান না দিয়ে। 

আমার কাউন্টার-অ্যাটাকের জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই, (লোকটি দেখলাম বড়ই বিনয়ী, তা ধর্মব্যবসায় নামতে গেলে সে গুণটা আবশ্যক বইকি) তবে কি, আমি তো গ্রামেই বড় হয়েছি, বড় শহরে তেমন যাই নি, ওই মাঝে সাঝে ধর্ম-কনফারেন্সে যাই, তাই সেখানের হোমলেসদের সম্বন্ধে যেমন তুমি বললে তা নিয়ে আমার তেমন ধারণা নেই। 

তা শুনলাম, ইনি পরিবারগতভাবে চাষা – বিস্তীর্ণ জমিতে গম-ভুট্টা-সয়াবীন-আলফাআলফা-গরুর চাষ করেন। ছোটবেলায় শূকর পেলে বড় হয়েছেন, জামাইকা যাবার সময় সেগুলি বিক্রি করে দিতে হয় বলে প্রচুর কান্নাকাটি করলেন। 


জানতে চাইলাম, কোথাকার চাষা আপনি? উত্তরে শুনলাম, কানসাস। ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, কানসাস শিক্ষাবোর্ড একসময় স্কুলপাঠ্য বিজ্ঞান বইতে বিবর্তনের বদলে বাইবেলের সৃষ্টিকাহিনী ঢোকাবার জন্য কত চেষ্টাচরিত্রই না করেছিল। সেখানের বাসিন্দা এরকম অসামান্য ধারণাবিশিষ্ট তো হবেই। তা সেই কথা এনে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, কানসাসে যখন থাকেন, স্কুলের কথাও তুলেছেন, তখন মনে পড়ল, জিজ্ঞেস করি, এই স্কুলে বিজ্ঞানশিক্ষা বনাম ক্রিয়েশনিজম নিয়ে ওখানে কিছু বিতর্ক হয়েছিল, তা সেই সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে পারেন? ধর্মপ্রচার করেন ঠিকাছে, কিন্তু চার্চ আর স্টেট অর্থাৎ ধর্মশিক্ষা আর বিজ্ঞানশিক্ষা দুটো আলাদা রাখা উচিত নয় কি? 

ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, দেখ, আমার নিজের কথা যদি বলি, তাহলে এই যে তোমাদের এসব বিবর্তন-টিবর্তন বিজ্ঞান আমার আদপেই জুতের লাগে না। বান্দর থেকে মানুষ হয়েছে, কয়েক কোটি বছর আগে একটা ছোট্ট বোমা ফেটেছিল আর তার থেকেই পৃথিবী আদি দুনিয়া তৈরী হয়েছে, এসব কোনো কথা হল? কোনো সুস্থ লোকে এসব কল্পনায় বিশ্বাস করবে? আর এই তো, ছ হাজার বছরটা অনেক বোধগম্য সময়; ছ হাজার বছর আগে একটা সময় খোদাতালা সব কিছু গুছিয়ে সৃষ্টি করলেন, মানুষ ইত্যাদি সব সুন্দর ব্যবস্থা করে দিলেন, এটা অনেক স্বাভাবিক আর প্রণিধানযোগ্য না? এই যে কুকুর-বেড়াল সব হীনতর প্রাণী, এদের মানসিক পরিণতি – বুদ্ধিবৃত্তি – কল্যাণবোধ – ঈশ্বরচেতনা – এসব কিছু কি মানুষের সঙ্গে তুলনীয়, যে এদের থেকে বিবর্তনের প্রশ্ন আসবে? 

শুনতে শুনতে আমার মুখ ব্যঙ্গের তীব্র চাপা হাসিতে ভরে যাচ্ছিল, আর মনে ভাবছিলাম, যে দুনিয়া কোথায় অগ্রসর গিয়েছে যে এরকম একটা আধুনিক পরিবহনে এমন ভাবনার একটা লোক আমার পাশের আসনটায় বসে থাকতে পারছে, শুধু তাই নয়, অর্ধেক গোলার্ধ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে এসে আবার এইসব ভাবনা ছড়িয়ে যেতে পারছে? এ সব অগ্রগতিই তো অবশ্য বিজ্ঞান, থুড়ি, বিশুদ্ধ ধর্মালোচনার মাধ্যমেই হয়েছে, বলাই বাহুল্য। বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জি-ডলফিন-পাখিদের রেফারেন্স এনে কতটুকু লাভ হবে ভাবছিলাম, এমন সময় আমার মুখের হাসি দেখে উনি বললেন, আমি বুঝতে পারছি, তুমি আমার কথা মানছ না, কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি, যে এটাই সত্য, আর সত্যের জয় করাবেনই ভগবান। 

তারপর আমাকেও কিঞ্চিৎ বিশ্বাসী করাবার চেষ্টায় বললেন, যে দেখ, আমাদের সনাতন অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় ধর্ম কত প্রাচীন, সুবিস্তৃত এবং যুক্তিযুক্ত! তোমাদের ভারতের হিন্দুদের অনেকের ঘরেই দেখলাম কল্যাণকামনায় দরজায় লাল ফোঁটা, কপালে লাল ফোঁটার চল। এটা নিঃসন্দেহে বাইবেল-বর্ণিত মোজেসের সেই অনুশাসনের অনুসারে। ঘটনাটা জানো তো? সেই যে, মিশরে থাকাকালীন মোজেস ঈশরের কাছ থেকে বাণী নিয়ে নেমে এসে বললেন, যারা যারা সত্য ধর্মের অনুসারী তারা সবাই একটা করে কচি ভেড়া কেটে তার রক্ত দিয়ে দরজায় ফোঁটা দেবে। যারা দেবে না সেই রাত্রে তাদের জন্মানো সব সন্তান মারা যাবে। মুমিনরা সব সে আদেশ পালন করল, কিন্তু মিশরীয়রা সেটা না শোনায় পরদিন সকালে উঠে তারা দেখল সমস্ত নবজাত সন্তান মারা গেছে। এভাবেই মোজেস ধার্মিকদের বেছে নিলেন, আর তাদের নিয়ে এক্সোডাসে যাত্রা করলেন। 

দেখলাম, আর কিছু না'ও বলি, এই নব আইনস্টাইনের ভুলটুকু ভেঙে দেওয়া দরকার, নইলে দেশে ফিরে গিয়ে সবাইকে ধর্মানুসারী কী বিরাট আবিষ্কার করে এনেছেন তার গল্প শোনাতে লেগে যাবেন। তাই বললাম, ভাইটু, আমাদের দেশে লাল আর সাদা দুই ধরনের লেপনেরই যেমন প্রচলন আছে, তেমনই ওই দুই রঙেরই সাজগোজ আর ধর্ম দুটোতেই প্রয়োগ আছে। আর ওই লালটার সঙ্গে রক্তর কোনো সম্পর্ক নেই, ওটা কিছু খনিজ যৌগ থেকে বানানো হত। 

আর যদি বল খ্রীষ্টধর্মের ছড়িয়ে পড়ার কথা, তাহলে বলতে হয়, মানুষের বিস্তারটা হয়েছে অনেক আগে, তোমাদের ধর্ম বিলিতি অভিবাসীরা আসার আগে ভারতে বিশেষ আসেইনি। অনেক হাজার বছর আগে – সেটা আবার পুস্তকবর্ণিত ছয় হাজারেরও আগে, অতএব হয়ত বিশ্বাস করবে না – এশিয়া মাইনরের ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর এক শাখা আর্য হিসাবে ভারতে এসেছিল, আরেক শাখা ভূমধ্যসাগর উপকূলে গিয়ে বসতি গাড়ে, যাদের মধ্যে ইহুদী এবং পরে খ্রীষ্টধর্ম চালু হয়। লালরঙের প্রচলন থাকলে সেই মূল জাতির মধ্যেই ছিল। কিন্তু নিশ্চিত নই, কারণ ভারতের মূল জাতি দ্রাবিড়দের মধ্যে এধরনের প্রচলন কতটা আর কতটা আর্যদের আনা সে নিয়ে নিঃসংশয় নই। 

বলাই বাহুল্য, দ্রাবিড় জাতি ইত্যাদি সম্বন্ধে ইনি কিছুই জানতেন না। বিস্তারিত বুঝিয়ে বলায় বললেন, ও, তাই দেখি, ভারতের এক দল লোক অনেকটাই ফর্সা আর এক দল বেশই কালো। সে সব তো বললাম, তবে এনার আবিষ্কারের আনন্দে যে কিছুমাত্র ভাটা পড়ল বলে তো মনে হল না। শেষে বললেন, ভাই, তোমার সঙ্গে আলাপ করে বড়ই আনন্দ হল, কিন্তু আমি পথশ্রমে ক্লান্ত, এবার নিদ্রা যাওয়া প্রয়োজন... আমি মনে মনে বললাম, হ্যাঁ, যান, দূরে গিয়া মরেন, আমারেও একটু ক্ষ্যান্ত দেন। চেয়ার এলিয়ে একটুখানি চোখ বুজলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন