লিখেছেন মুখফোড়
দারুবীণ বড় দুষ্টু ছেলে। ওর বাপটা ছিলো মদখোর। গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে এসে সাপুড়েদের বীণ বাজাতে বাজাতে একদিন ঘরে ঢুকে শুনলো, পুত্র সন্তান হয়েছে। বীণটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে সে বললো, "য়্যাঁ? জমজ নাকি?" নেশার ঘোরে সে প্রায়ই একটা জিনিসকে দুটা দেখতো।
যাই হোক, যারা মানিকের "জননী" পড়েন নাই তারা হেসে নেন একটু, মুখফোড়ের মান রাখেন এট্টু।
দারুবীণ, এটাই ছেলের নাম রাখলো মাতালটা। যেমন বাপ, ছেলেও তেমন। উড়নচন্ডী। পোকামাকড় ধরে, লতাপাতা শোঁকে। গাঁয়ের পুরুত দেখে হাসে। বলে ওরে তুই দেখি জন্মেছিসই মাতাল হয়ে রে। তোর মজ্জায় মজ্জায় দারুস্রোত জাগ্রত। চাঁদের সাথে তাল ঠুকে জোয়ারভাটা হয়, তাই এইসব করিস।
দারুবীণ শোনে, কিন্তু কিছু বলে না, গম্ভীর হয়ে যায়।
একটু বয়স হবার পর দারুবীণ একদিন এসে মা-কে বলে, মা গো, বাণিজ্যেতে যাবো আমি সিন্ধুবাদের মতো! মা বলে, পাগল খোকা আমার, বাণিজ্যে যেতে গেলে যে পুঁজি লাগে, মাল লাগে, জাহাজ লাগে বাবা, তোমার তো কিছুই নেই। দারুবীণ বলে, না মা, আমাদের আর গাঁয়ের বিঘল মহাজনের বড় সাগরচষা নাওয়ে করে ভিনদেশে যাবো যে!
তা-ই ঘটে, দারুবীণ একদিন গামছায় তার অস্থাবর সম্পত্তি বেঁধে ভেসে পড়ে বিঘল মহাজনের নায়ে। সে নায়ে চড়ে সে কত অজানা দেশে যায়, কত অজানা দ্বীপে নামে, কত অজানা বন্দরে নেমে শুঁড়িখানায় মাতাল হয়ে বেশ্যাপাড়ায় রাত কাটায়। পুরোদস্তুর জাহাজী হয়ে যায় আমাদের নিষ্পাপ দারুবীণ। বাপটার মতো অবশ্য মদের দিকে ঝোঁক নেই তার, এক পর্তুগীজ বোম্বেটের সাথে জুয়ায় জিতে মারপিট করে তার দূরবীণখানা ছিনিয়ে নিয়েছে দারু মহাজন (এখন লোকে ও নামেই তাকে ডাকে কি না), সেই দূরবীণ দিয়ে সে মাঝে মাঝে রাতের আকাশ দেখে, আর বিড়বিড় করে কী সব বকে। ওদিকে আবার বিঘল মহাজনের হিসেব টোকার তুলোট খাতার কয়েকটা পাতায় সে হিজিবিজি কী সব লেখে। কে জানে কী।
নিজের নামের সাথে মিল আছে দেখেই কি না কে জানে, দূরবীণখানা দারুবীণের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। দিনভর সে জলে সূর্যের ছায়া দেখে কী কী সব ছক কষে, আর রাতে ঘুম ফেলে আকাশ চষে। বিঘল মহাজনের গোমস্তা হাসে, বলে অ দারু, গ্যালো বন্দরে কি পেটে খুব বেশি পড়ে গেছলো নাকি র্যা? দারু জবাব দেয় না।
কিন্তু বিঘল মহাজনের বাণিজ্যও একসময় ফুরোয়, তার নাও ভেড়ে গাঁয়ের ঘাটে, দারুর মা ছুটে এসে দারুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। হোসেন আলি নামের একটা লোক পাশের নাওয়ে দাঁড়িয়ে পিটপিট করে দারুকে দ্যাখে। দারুবীণ মাকে শুধায়, মা, কপিলা কই?
না, কপিলা নিছক দারুবীণের পোষা গাইয়ের নাম। দেখা যায় সে-ও হাম্বা ডাক ছেড়ে দারুকে বরণ করে নিতে এসেছে।
দারুবীণ গম্ভীর মুখে মা আর গাইটাকে সাথে নিয়ে পুঁথি বগলে বাড়ির দিকে হাঁটে।
পরের হপ্তায় দারুর পুঁথি পুস্তকাকারে হাটে বিক্রি হতে দেখা যায়। পুঁথির নাম, "আকাশে সূর্য ও নক্ষত্রের গতিবিধি বিষয়ক কিছু কথা"।
প্রথমটায় কেউ পাত্তা দেয় না, কিন্তু হোসেন আলি সেই পুঁথি পড়ে মহা চটে যায়। পুঁথিতে লেখা দারুবীণের বাণিজ্যযাত্রায় আকাশ পর্যবেক্ষণের কথা। সূর্য, চন্দ্র, আরো তারকারাজির আকাশে গতিবিধি ঠাহর করে আর বিঘল মহাজনের কাছে শেখা চক্রবৃদ্ধি সুদের হারের আঁক কষে সেখানে দারুবীণ দেখিয়েছে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র শনি এরাও নাকি সবাই গ্রহ, এরাও নাকি সূর্যের চারদিকে ঘোরে। সূর্য অবশ্য কারো চারদিকে ঘোরে না নাবি, সে শুধু তারাগুলো থেকে বাঁই বাঁই করে তফাতে ছোটে। আর কেবল চাঁদ শালা ঘোরে পৃথিবীর চারপাশে।
হাটে তুমুল শোরগোল পড়ে যায়, হোসেন আলি মহা ক্ষেপে যায় দারুবীণের মতো। বদ একটা ছোকরা, দুতিন বছর মোটে মহাজনের নায়ে মোট নড়িয়ে খুব আঁটি হয়েছে ব্যাটার, সে চন্দ্রসূর্য নিয়ে কথাবার্তা বলতে আসে! সবাই জানে সূয্যিদেব তার আগুনে রথে চড়ে সেই সক্কালে পূব দিক থেকে দৌড়োন, আর সন্ধ্যেবেলা পশ্চিমে গিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। সারারাত বৌমামির সাথে রোমানস লড়িয়ে ভোরবেলা চুপটি করে আবার কোন ফাঁকে নিজের বাড়ি পূব দিকে চলে আসেন, আবার রওনা করেন শ্বশুর বাড়ির দিকে। শীতে একটু দক্ষিণ ঘেঁষে চলেন, আর গরমে উত্তর, এ-ই তো। মঙ্গল বুধ বিষুদ শুক্কুর শনি এঁরা সব নানারকম দেবতা, দূরে দূরে থাকেন, রাতে চাঁদকে পাহারা দেন যাতে রাহু এসে খেয়ে না ফেলে। কিন্তু বুড়ো দেবতা সব, তাই কালেভদ্রে রাহু এসে মাঝে মাঝে টপ করে চাঁদটাকে গিলে ফেলে। কিন্তু হ্যাঁ, সব চক্কর খায় পৃথিবীকে ঘিরে। পরিষ্কার লেখা আছে সবিতামঙ্গল আর আদিত্যপুরাণে। এসব ফালতু আবর্তনবাদ, যা লিখেছে দারুবীণ, এগুলো সব পঁচা বন্দরের আধগ্যাঁজানো তাড়ি আর বুড়ি বেশ্যাদের ঠমকের ফল। এসব লিখে কচি ছেলেছোকরাদের মাথা খাবার কোন হক নেই দারুবীণের!
হাঁকডাক পড়ে যায়, সবাই গাল দ্যায়, মাতালের ব্যাটা দারুবীণ, দুপাতা লিখতে শিখে শাস্ত্রজ্ঞ হয়ে যেতে চায়!
দারুবীণ গম্ভীর মুখে শোনে আর কপিলার জন্যে খড় কাটে, খৈল ঢালে মাটির পাত্রে। সন্ধ্যেয় পিদিমের আলোতে একখানা পত্র লেখে দূর বন্দরের জ্যোতির্বিদ বন্ধু গিবরিলকে, "বন্ধু গিবরিল! আমার পুঁথিতে একটা ত্রুটি রয়ে গেছে। গ্রহগুলোর আবর্তনকাল আমি এই স্বল্প তথ্য দিয়ে পরিমাপ করতে পারিনি। কেন তারা আবর্তন করে, কী সেই টানে, তা-ও নিরূপণ করতে পারিনি।"
তারপর বহুকাল কেটে যায়। ইতিমধ্যে দারুবীণের পুঁথি আলোড়ন তোলে টোলগামী ছাত্রদের মধ্যে, তারা আরো গবেষণা করে বার করে দারুবীণের হিসেবের খুঁটিনাটি, চন্দ্রসূর্য গ্রহতারার চলার পথের পাইপয়সাটি পর্যন্ত তারা হিসেব কষে বার করে ফেলার পণ করে।
আর বহু বছর পর সেই হোসেন আলির এক পুঁইয়ে পাওয়া বেহেড রামছাগল বংশধর, লোকে তাকে ডাকে গবেটসোনা, সেই গবেটসোনা ক্লাবে নাচা আর মদ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একখানা গবেষণা পত্র খাড়া করে দারুবীণের বিভ্রান্তিকর পুঁথি নিয়ে। এ নিয়ে আরেক হাটে শোরগোল ওঠে নতুন করে। দারুবীণের পিন্ডি চটকায় আরেকদল হাটুরে।
তবে চন্দ্রসূর্যগ্রহতারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা আনমনে পাক খায়, ছুটে চলে, কোথায় কে জানে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন