প্রথম আলোয় প্রকাশিত।
মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
রমজান মাসের বারকোড |
ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য বাজারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাহিদা ও জোগানের আলোকে নির্ধারিত হবে। তবে বাজার-প্রক্রিয়াকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য সরকার তদারকব্যবস্থ্থা শক্তিশালী করতে পারবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ক্রয়-বিক্রয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মজুদদারি সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিকোণ রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি করতে পারেন না। যদি এমনটি কেউ করে থাকেন তবে ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মসাৎকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। এভাবে মাহে রমজান বা বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে যখন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্যের স্ফীতি ঘটাতে চান, তখন সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে বলে ইসলামি আইনবিদ বা ফকিহগণ (কয়েকখানা নাম কি বলা যায়, যাদের সমস্ত বাণী মুসলিমরা একজোটে মেনে নেয়? সব সময়ই দেখে আসছি, কোন মুসলিম কার কথা মেনে চলে, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। এই যেমন, এক দল মুসলিমের কাছে জোকার নালায়েক নায়কের নবীর মতো। আবার আরেকদল মুসলিম তাকে স্পষ্টতই প্রত্যাখ্যান করে।) অভিমত প্রকাশ করেছেন।
সরকার কর্তৃক ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ-প্রক্রিয়াকে আরবিতে ‘তাসয়ির’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা ও উৎপাদক কোনো শ্রেণীরই ক্ষতিসাধন করা যাবে না, উভয় শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, (হাদিসের সূত্র ও নাম্বার উল্লেখ না করলে আমাদের মতো অবিশ্বাসীরা তার সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে) ‘ব্যবসায়ী যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করে এ সুযোগে যে ক্রেতা পণ্যের প্রকৃত মূল্য জানে না, তাহলে এই অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ পর্যায়ে গণ্য হবে।’
আসন্ন রমজান মাস নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে। মাহে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে যায়। ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ না থাকায় দাম বাড়তে থাকে। একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী কালোবাজারি, মজুদদার, মুনাফাখোর ও অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যদ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। পণ্য মজুদ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। এহেন পরিস্থিতি দেশের সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীদের বিবেকহীন ও অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের কারণে কখনো কখনো দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাজার-প্রক্রিয়াকে রক্ষার জন্য ইসলাম মজুদদারি, মুনাফাখোরি, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও দালালির মতো কার্যক্রমকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দর পরে বেড়ে যায় তবে আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত) (আবারও তথ্যসূত্র নেই! আচ্ছা, তা না হয় না থাকলো, কিন্তু এখানে নবীজি কি সত্যিই উদ্ধৃতিযোগ্য কোনও মূল্যবান বাণী দিয়েছেন? উদ্ধৃত কথাটুকু তো যে-কোনও স্কুলবালকও জানে!)
মজুদদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে, বিশেষ করে, রমজান মাস এলে পণ্যদ্রব্যের দাম তাঁদের ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেন। এর জন্য সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যখন মাহে রমজান শুরু হয় তখনই মুনাফাখোর চক্রটি তৎপর হয়ে পড়ে। ফলে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অবশ্য মাহে রমজানের আগেই ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। তাই রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। এ সম্পর্কে (অর্থাৎ রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে? সত্যি বলছেন?) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজা ও বায়হাকি)
অথচ পণ্যসামগ্রী মজুদ করে মূল্যবৃদ্ধি বা অধিক মুনাফা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য আমদানি করে বাজার দামে বিক্রয় করে, তার উপার্জনে আল্লাহর রহমত রয়েছে। আর যে ব্যক্তি আমদানি করে চড়া দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করে রাখে তাদের প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’
রোজাদার মানুষের কথা ভেবে যাঁরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা জনসাধারণের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার মানসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধকল্পে ব্যবস্থ্থা নিতে পারেন। রমজান মাসে রোজাদার মানুষকে যেন কষ্ট বরণ করতে না হয় এবং একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট থেকে বর্তমানে ‘আল-হিসবা’ ব্যবস্থ্থা চালু করে বাজারকে কলুষমুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা যেতে পারে এ লক্ষ্যে ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণ সেল’ গঠন করে শহর, নগর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্রই সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের নজরদারির আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থ্থা করা দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্যে মূল্যপ্রবাহকে কেউ যেন ঊর্ধ্বমুখী করে না তোলে, সে ক্ষেত্রে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আগুনের হাড়ের ওপর তাকে বসিয়ে শাস্তি (শুধু কিয়ামতের দিন? আর "আগুনের হাড়" ব্যাপারটা কী? আগুনের মাংসও আছে নাকি তার মানে!) দেবেন।’
রমজান মাস একটি ধর্মীয় আচার ও পবিত্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাহে রমজান পরিশুদ্ধির মাস হলেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নৈতিক অধঃপতন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামাজিক সমস্যা, সচেতনতার অভাব প্রভৃতি সেই আত্মনিয়ন্ত্রণকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষকে সৎ মনোভাবাপন্ন, নির্লোভ, মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা উচিত (স্বীকারোক্তির জন্য ধন্যবাদ। এখন আমরা স্পষ্টভাবে জানলাম, কেউ ধর্মপ্রাণ মানেই সে সৎ মনোভাবাপন্ন, নির্লোভ ও মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব নয়।)। মজুদদারি, ধোঁকাবাজি, সুদি লেনদেনসহ সব ধরনের ইসলামি আদর্শবিবর্জিত কার্যাবলি রোধ করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা, ইসলামসম্মত সেবামূলক ভূমিকা মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সুতরাং আসুন, মাহে রমজানে ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলি (অর্থাৎ বাকি মাসগুলোয় মানার দরকার নেই। রমজান যে পবিত্র মাস!)। মুনাফাখোরি, মজুদদারি, ফাটকাবাজারি, কালোবাজারি ও সুদসহ অবৈধ পন্থায় লেনদেনে অর্থ উপার্জন থেকে বিরত থাকি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন