রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১১

হারাম ও হালাল এবং প্রবাসী মুসলমানদের মূর্খতা

লিখেছেন সেজান মাহমুদ 

হালাল শুয়োরের মাংস?
আমেরিকায় আসার পরে প্রথম বিষয়টি এভাবে খেয়াল করা শুরু করলাম। কেউ দাওয়াত দিলে বলেন, ‘আগামী শনিবার আসবেন ডিনার খেতে, আমরা হালাল মাংশ খাই।' কিম্বা কাউকে দাওয়াত দিতে গেলে কোনো রকমের ভদ্রতাবোধের বালাই না রেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, হালাল খাবার দেবেন তো?’ 

আমি এলাম ফ্লোরিডার রাজধানী শহরে ইউনিভার্সিটির চাকরি নিয়ে (২০০৪ সাল)। এসেই নানান দাওয়াত খেলাম। এখন পরিবর্তে আমাকেও দাওয়াত দিতে হবে। যাকেই দাওয়াত দিতে যাই, সবারই একই প্রশ্ন, ভাই, হালাল খাবার থাকবে তো? মনে হয়, ইতিমধ্যেই চাউড় হয়ে গেছে যে, আমি হালাল-হারাম নিয়ে একটু ভিন্নমত পোষণ করি! তবু নিমন্ত্রণ করেছি, অতিথিকে তো আর মিথ্যা বলে খাওয়ানো যাবে না। অন্যদিকে আমি থাকি যে শহরে, সেখানে কোনো বাঙালি দোকান নেই, হালাল মাংশও পাওয়া যায় না। যেতে হয় চার ঘন্টা ড্রাইভ করে সেই আটলান্টা, না হয় অরল্যান্ডো। একজন বুদ্ধি দিলেন যে, এখানে খামারে খাসি কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু নিজেরা কেটেকুটে নিতে হবে, ফ্রেস মাংশ, আবার দামও ভালো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনি। আমার সাত বছরের ছেলে তখন মাত্র প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে, প্রকৃতিবাদী হতে গিয়ে মাংশ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তার জন্য ছেলের মা-ও মাংশ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আমিই একমাত্র মাংশভূক মানুষ বাসায়। বাসার কাউকে না জানিয়ে খামারে গিয়ে খাসি কিনলাম, যিনি পরামর্শ দিলেন (সদরুল ভাই, যিনি পিএইচডি করা প্রফেশনাল) তিনি নিজেও খুব পরহেজগার মানুষ। আমার দুর্দশা চিন্তা করে (কিম্বা মনে হয় অন্যদের হারাম খাওয়া থেকে বাঁচাতে) তিনি নিজেই মুসলমানের কায়দায় জবাই করলেন। আমি জীবনে যা করিনি, তা-ই করতে হলো, নিজে সেই খাসির মাংশ কেটেকুটে, ধুয়ে নিয়ে এলাম বাসায়। প্রায় ষাটজন মানুষের দাওয়াত। আমার অমাংশভোজী স্ত্রী-পুত্র মাংশ খাবেও না, রাঁধবেও না। আমিই রান্না করলাম ষাটজন লোকের বিরিয়ানী (কিছুই করতে না পরলে হয়তো ফখরুদ্দীন বাবুর্চি না হলেও সেজান্নুদ্দিন বাবুর্চি হতে পারতাম!) 

যা হোক, আমার ঘর্মাক্ত কলেবরে সফল দাওয়াত শেষ হলো। সবাই নিশ্চিন্তে খেলেন। সাদরুল ভাই স্বয়ং হালাল কায়দার সাক্ষী! সবাই যখন বিদায় নিচ্ছেন, আমাকেও বললেন ‘আসবেন আমাদের বাসায়।’ বললাম, আসবো -তবে একখান কথা আছে। আমার দিকে তাকিয়ে উন্মুখ সবার মুখায়ব, এঁদের প্রায় সবাই শিক্ষিত, পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কেউ আবার পদার্থবিদ্যার ডক্টরেট ডিগ্রী নিতে যাচ্ছেন। আমি একেবারে বোমা ফাটানোর মতো করে বললাম, ‘আজকে আপনাদের ফরমায়েশ মতো আমি কিন্তু হালাল মাংশ খেতে দিয়েছি, আমি যা পছন্দ করি না সেই মাংশ-কাটাকুটি করেছি আপনাদের সন্মানে। আপনারাও আমাকে দাওয়াত দিলে কিন্তু ডিনারের সময় এক গ্লাস ওয়াইন দেবেন। স্বাস্থ্যগত কারণে এটা আমি খাই।‘ মোটামুটি স্তম্ভিত হয়ে চলে গেলেন সবাই। বলাই বাহুল্য, তারপর দাওয়াত খেয়েছি, কিন্তু ওয়াইন পাই নি। 

সবাই নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি উচ্ছন্নে গেছি, বেদ্বীন, নালায়েক হয়ে গেছি। আসলে আমি শুধু একটা পয়েন্ট তুলে ধরতে ঐ কথাগুলো বলেছি। আমি জানি না শুধু প্রবাসী শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত, স্বল্পশিক্ষিত, সবাই এভাবে ভাবেন, নাকি সারা পৃথিবীর মুসলমানেরা এভাবে ভাবেন! এখানে প্রবাসে তো অন্তত বেশির ভাগই শিক্ষিত। কেউ কেউ দেশে ঘুষখোর আমলা, সরকারী চাকুরির সুবাদে এসে থেকে গেছেন, কেউ ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে চলে এসেছেন, কেউ খুন করে পালিয়ে, আবার নিরেট নিপাট ভালো মানুষও আছেন এঁদের মাঝে। কিন্ত প্রবাসে এলে এই হারাম-হালাল যেন মাথা চাগিয়ে ওঠে ভালো-মন্দ নির্বিশেষে। আমি জিগ্যেস করি এঁদের, ‘ভাই বাংলাদেশে থাকতে কেউ যদি দাওয়াত দিতেন তাদের কি জিজ্ঞেস করতেন, ‘ভাই ঘুষের-টাকায়-না-কেনা খাবার দেবেন তো?’ ওটাও তো হারাম! 

যাহোক, এতোদিন ধরে ধর্ম-কর্ম-করা, শিক্ষিত মানুষগুলোও কি অন্ধের মতো শুধু মেনে চলেন, চলতে চান? আমিও তো মক্তবে পড়েছি। আমার জানা মতে কোরানের কোথাও তো এই ‘জবেহ’ করার পদ্ধতি নিয়ে হারাম-হালাল নির্ধারিত করা হয় নি। কিছু জিনিস হারাম করে দেয়া হয়েছে, মৃত প্রাণীর মাংশ, শূকর বা সোয়াইন, রক্ত, এবং যে কোনো খাবার যা আল্লাহ ব্যতিত অন্য কোন কিছুতে নিবেদিত (আমি ধরে নিচ্ছি পূজার প্রসাদ) ইত্যাদি (সূত্রঃ 16:115 He only prohibits for you the dead animal, blood, and swine-flesh and anything that has been dedicated to other than God….)। কিন্তু একটি পরিষ্কার প্রাণী, তা কীভাবে জবাই করা হলো, তাতে হারাম-হালালের কিছু আসে যায় না। কারণ, যদিও বলা আছে যে, সব কাজের শুরুতে (যেমন প্রাণী জবাই করার আগে) বিসমিল্লাহ বলে নিতে হবে। এখানে যে কাজটি নিজে প্রত্যক্ষ করছেন না সেখানে কে, কীভাবে আল্লাহর নাম নিলেন, তা তো জানার উপায় নেই। প্রবাসে অনেক প্রাণী জবাই করা হয় ক্যাসেটে সুরা পাঠ বাজিয়ে দিয়ে। বরং বলা আছে যে, যারা কিতাবে বিশ্বাস করেন তাদের কৃত সব মাংশই (উল্লেখিত হারামগুলো ছাড়া) খাওয়া জায়েজ (সূত্রঃ 5:5 “Today, all good food is made lawful for you. The food of the People of the Book) is Lawful (HALAL) for you……” । তার অর্থ হলো ইহুদী বা খ্রীষ্টানদের প্রস্তুতকৃত মাংশও খাওয়া যেতে পারে, সব খাবারের আগে যেমন আল্লাহ’র নাম নিতে হয়, তা নিয়েই সম্ভব। তার মানে, প্রবাসের গ্রোসারির দোকানের খাবারও হালাল। কিন্তু জবাই করার আগে আল্লার নাম নেয়া না বা নেয়ার সঙ্গে হালাল হারামের কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার জানা নেই। এমনকি কোরানে একথাও বলা আছে যে, ‘সব ভালো খাবারই হালাল (ল’ফুল), কোনো খাবার খেতে আপত্তি করো না যে কোন ঈশ্বরের নাম নেয়া হয়েছে।‘ এখানে মজার ব্যাপার হলো এই ঈশ্বর কিন্তু ইহুদী বা খ্রীষ্টানদের ঈশ্বরও হতে পারে (সূত্রঃ 6:119 Why should you refuse to eat on which God’s Name has been pronounced)। হাদিসেও এমন কথা আছে; সহি বুখারিতে যে বিবি আয়েশা নবীকে বলেছিলেন যে, আমি জানি না এই প্রাণী জবেহ করার আগে, আল্লাহ’র নাম নেয়া হয়েছিল কি না, এখন কী করবো? নবী বলেছিলেন, ‘বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে নাও।’ 

বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বললে বলা যায় যে, প্রাণী জবাই করার যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হয়েছে, যেমন আল্লাহর নামে করা বা কিতাবে বিশ্বাসী ঈশ্বরের নামে করা, রক্ত যাতে শরীর থেকে বের হয়ে যায় (কারণ রক্ত হারাম); এগুলোর সবই কিন্তু এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে পালটে গেছে; যেমন ঈহুদীরা কোশার মাংশ করে একই পদ্ধতিতে, রক্ত ধোয়ারও নানান হাইজিনিক পদ্ধতি আছে। সেক্ষেত্রে এই রিচুয়াল নিয়ে বাড়াবাড়ি যুক্তিসঙ্গত কি না?

ধর্ম কি মানুষ কে এতোটাই অন্ধ করে যে এই শিক্ষিত মানুষগুলোও মূর্খের মতো শুধু মেনেই যাবে, একটু খতিয়ে দেখারও তাগিদ নেই, ইচ্ছা নেই। না কি এ আসলে প্রবাসে এসে নিজেদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, নিজেদেরকে কিছু একটা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র?! আমি নিজে এই বাছ-বিচারে বিশ্বাসী নই। আমার কাছে এক গ্লাস ওয়াইন পানে স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে, তবে তা পান করবো, কিন্তু ধূমপানে যেহেতু লক্ষ লক্ষ ক্ষতি, কিন্তু কোনো উপকার নেই, আমার কাছে ধূমপান হারাম, ঘুষ খাওয়া অনৈতিক এবং হারাম। এখানে ‘হারাম’ শব্দটি নিষিদ্ধ বোঝাতে ব্যবহার করছি। কিন্তু যারা ধর্মীয় দৃষ্টিতে হারাম-হালাল বিচার করছেন, তাঁদেরও তো এই বিষয়টি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিত, যা অনেক সামাজিক নুইসেন্স কে দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। কারণ আমি দেখেছি এই সামান্য বিষয়টি না জানার কারণে অতিথি হয়ে একজনের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া, খাবার টেবেলে হোস্টকে অপমান করা, এমন কি কেউ তথাকথিত হালাল খান না বলে সামাজিকভাবে বয়কট করার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও প্রবাসে ঘটে থাকে। 

জানি, আমি এই ত্রুটি ধরিয়ে দিলাম বলে ধন্যবাদ দেয়ার বদলে অনেকেই গালমন্দ করবেন, আমার এই হক কথাতেও আহত হবেন অনেকজন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন