লিখেছেন নাসির আবদুল্লাহ
বেশ কিছুদিন ফেসবুকে অনুপস্থিত থাকায় এক বন্ধু বিচলিত হয়ে পত্র লিখেছেন কুশল জানতে চেয়ে... পত্রে তাকে কুশ-লাদি (ছাগলের না) জানিয়ে ভাবলাম আমার অনুপস্থিতির কারণটাও সবাইকে জানান দরকার।
হইছে কী; মেরাজে গেছিলাম, মেরাজে। কেমনে? শুনেন তাইলে।
আমার নবুয়তির যে একটা আলামত দেখা গেছে, তা তো মনে আছে সবার নিশ্চয়, এই নবুয়তির আলামত দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আরেকটা আলামতও দেখা দিছে আমার মাঝে: কাম! প্রবল কাম বাসনা... বউটার উপর বড় মায়া হয়, আবার কামের জ্বালায় অস্থির, আবার আরেকটা যে বিয়া কইরা ফালামু, তারও উপায় নাই, বিবিরে আমি খুব ডরাই, তার বাপ-মা-ভাই-বোনই আমারে পায়ের নিচে মাটি দিছে, বিবির বড় ভাই দুই আঙ্গুল দিয়া একবার তুড়ি বাজাইলে তা আমার জন্য ঈস্রাফিলের শিঙ্গার চেয়েও ভয়াবহ। এই সংকটের সময়, যে আল্লায় নবুয়তি দিছেন, সেই আল্লায় রহমত দিয়া দিলেন; আমার নজর গিয়া পড়ল সাঁওতাল পাড়ার ২১ বছর বয়েসী গীতা মুরমার ওপর। সহজ সরল মাইয়া, আমার নূরানী চেহারা আর মিছা কথার ফুলঝুড়ির সামনে দুই দিনের বেশী টিকতে পারল না।
তার শুধু একটাই কথা: "তুই হামারে সুহাগের নামে ঠকাইয়া দিবি না ত রে, নাসের?" আমি চোখে মুখে প্রেম আর মায়া জাগাইয়া বড়ই কাতর স্বরে বলি "তুরে ছাড়া হামি বাচমু নারে গীতালি, হামি তুকে বিহা করমু রে, তুর পায়ের মাঝে হামার জান্নাত, তুই হামারে ফিরায়ে দিলে বিষ খাইয়া ফালামু রে গীতালি" এইসব মিছা কথা। ২১ বছর বয়েসের নাদান মেয়ে - কতক্ষণ সে আর নিজেকে ধরে রাখবে?
যাহোক, গীতা তো ফিট, এখন অ্যাকশনের পালা; চাঁদনী রাইতে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট কইরা ফালাইলাম গীতার সাথে। আমার পেয়ারা দাদি রাত্রে তাহাজুদ্দের নামাজ পড়ে, আমি তারে ওজুর পানি দেই আর নানা ভাবে সেবা করি তার নামাযের সময়।
পরশু রাত্রে দাদিকে ওজু করিয়ে যেই বাইরে বেরুবার দরজা খুলতেছি অমনি দাদি জিজ্ঞাসা করল:
- ও নাসের, যাস কই?
- বিড়ি খাইতে, দাদি।
- তুই ত বিড়ি বাড়ির মইদ্যেই খাস, তো আবার বাইরে যাস ক্যান?
- দাদি বিড়ি শ্যাষ, দেখি রমজান মিয়ার কাছে পাই নাকি?
- নাসের তুর মনে অশান্তি ক্যান?
- দাদি, তুমি বুঝবা না, স্বপ্নে আমার কাছে অহি আসে, তুমারে তো বলছি।
- হারামজাদা, তুরে আমি চিনি না? তুই তর দাদার পথে পা বাড়াইচস।
(বুড়ি কিভাবে আমার কাম বাসনা টের পাইল, বুঝলাম না। আসল ওহি দেখি তার কাছেই আসে, আমার কাছে না)
গীতার বাড়ির পাশে যাইয়া বিড়ালের ডাক দিতেই সে বেরিয়ে আসল। বাড়ির পিছনে বাশবাগানে চলে গেলাম আমরা। আমি আল্লাহকে মনে মনে জিগাইতেছি, আমার এই নিউ প্রেম হালাল না হারাম, তার ওহি কেন কেন পাঠাও না আল্লাহ মিয়া? অমনি চোখের সামনে একটা ডায়মন্ড শেইপ ক্রিস্টাল ভেসে উঠে আমাকে বলল, "তুমি নবীদের অন্তর্ভুক্ত, তোমার সুবিধার জন্য যা যা দরকার, সব হালাল"; আমাকে আর পায় কে!
সাথে সাথে ওহ গীতা বলে যেই জাপ্টে ধরেছি ওকে, অমনি ধুপধাপ ধুপধাপ শব্দে মানুষের ছুটাছুটি শুনলাম আশেপাশে। কোথায় গীতা আর কোথায় কে, ভাবার অবকাশ না নিয়েই দিলাম এক ছুট, ছুটতে ছুটতে আল্লাহকে বললাম... আল্লাহ তোমার নবী বিপদে পড়েছে, তাড়াতাড়ি বোরাক পাঠাও, বোরাক দরকার। পিছন থেকে কণ্ঠ শুনলাম, বোরাক-টোরাক নাই, নিজের দুই পা সম্বল করে দৌড়াইতে থাক। পিছনে তাকায়ে দেখি, সেই ডাইমন্ড শেইপ ক্রিস্টালও আমার পিছনে পিছনে ছুটতেছে। মাইল খানেক দৌড়াইয়া চলে আসলাম আমাদের গ্রামের কবরস্থানে (লুকানোর খুব ভালো জায়গা, বিশাল এক ডুমুর গাছ আছে, আর ঐ ডুমুর গাছের ডালে ডালে আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে)... কী করব, বলেন? আমার গ্রামে পাহাড়-টাহাড় তো নাই, তাই গুহাও নাই। দেশ-কাল ভেদে আমি হলাম গিয়ে গেছো নবী। বয়স হয়ে গেছে এখন আর গাছে উঠতে পারি না, তাই গাছতলাতেই বসে থাকলাম। এক মুহুর্ত পরেই দেখি, তিন-চারজন লোক টর্চ জ্বালিয়ে গোরস্থানে হাজির। আমি সাথে সাথে ইজ্জত বাঁচাইতে একটা ভাঙ্গা কবরের মইদ্যে ঢুকে পড়লাম। গুড়িশুড়ি মেরে শুয়ে আছি কবরে... এমন সময় হিস হিস আওয়াজ শুনলাম...
সাথে সাথে মনে পড়ে গেল গোর আযাবের কথা, ধর্মে তো বলেছে কবরে বিষধর শাপের ছোবল মারার কথা। কবরের শাপ, আমি জিন্দা দেখে এখনো ছোবল মারে নাই। তারা শুধু মুর্দাদের ছোবল মারে। সাথে সাথে আমি ঈমান এনে ফেললাম আর বাচাও বাচাও বলে বিকট চিৎকার দিয়ে মরে গেলাম। কিছুক্ষন পরে ফেরেস্তারা এসে হাজির (তবে ধর্মে কিছুটা ভুল বর্ণনা দেওয়া আছে, ফেরেস্তারা দেখতে মানুষের মতই, পুলিশের ড্রেস পরা), তাদের হাতে পাওয়ারফুল টর্চ, ঘাড়ে একে ৪৭, কারো কারো হাতে রাবারের হান্টার। তারা আমাকে টেনে-হেঁচড়ে কবর থেকে বের করে কিছু না জিজ্ঞাসা করেই রাবারের ডান্ডা দিয়ে সাটা সাট পাছার ওপর পিটাতে থাকল।
তারপর একজন জিজ্ঞাসা করল:
- নাম কী?
- নাসের।
- বাড়ি কোথায়?
- উজিরপুর।
- সঙ্গীসাথী কোথায়?
- আমি কাউরে চিনি না, কাউরে জানি না, আল্লাহ-আল্লাহ।
- মাল কোথায়?
- কী মাল?
- (ঠাস ঠাস আবার বাড়ি পড়ল পশ্চাত দেশে) শালা-কুত্তার বাচ্চা, ফেন্সির বোতল কই ফালাইছস?
ভাইরে ভাই, গোর আযাব এতই কষ্টের, এত প্যাঁদানি! আমার আর কিছু মনে নাই। কিছুক্ষণ পরে ফেরেস্তারা আমাকে টেনে-হেঁচড়ে গোরস্থানের বাইরে আনতে লাগল। বুঝলাম, গোর আযাবের প্রাথমিক পর্যায় শেষ, এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে যাত্রা। ওরা (ফেরেস্তারা) আমাকে একটা ভাঙ্গা জিপে উঠিয়ে জিপ চালিয়ে দিল, কিল-ঘুষি কিছু পড়তে থাকল, কিন্তু তা রুলারের প্যাঁদানির কাছে অত্যন্ত নগণ্য। পৌঁছে গেলাম একসময় গন্তব্যে। এবার পুলসিরাত পার হতে হবে। চোখে মুখে ঘুষি খেয়ে ভালোমত দেখতে পাচ্ছি না কিছু... পরকালটা কি কানা হয়ে কাটায়ে দিতে হবে নাকি?
গীতার কথা মনে পড়ে গেল। মরার আগে ঈমান তো আনছিলাম কবরের মধ্যে, এখন পুলসিরাত যদি পার হইতে পারি তাইলে আল্লার কাছে হুর-পরি বাদ দিয়া গীতারে প্রার্থনা করুম (ভাইসকল, কামের ঠেলায় আমার মাথা খারাপ)।
তবে পুলসিরাতটাকে কেন জানি চেনা-চেনা মনে হচ্ছে, আমাদের লক্ষীপুর থানা অফিসের মত কিছুটা।মিউনিসিপালিটির ৮ ফুট চওড়া ড্রেনের ওপর সাকোর মত করে একটা তালগাছের গুড়ি ফেলা আছে, ডাইন পা রাখছি পুলসিরাতের ওপর, একটু ভয় ভয় লাগতেছে, পারব তো পার হইতে পুলসিরাত? এমন সময় "শালা কুত্তার বাচ্চা, ভান ধরছস" বলে রুলার দিয়ে ঠাস করে হাঁটুর ওপর এক বাড়ি দিল একজন ফেরেস্তা, আর আমি সব কিছু ভুলে মা বলে চিৎকার দিয়ে দিলাম এক দৌড়... নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম নিজের কেরামতি দেখে, পুলসিরাত পার হয়ে গেছি আমি। মনে মনে বেহেস্তে গীতাকে পাওয়ার আশায় সব ব্যথা বেদনা ভুলে গেলাম। আমাকে দারোগা ফেরেস্তার হাতে সোপর্দ করে বাকি ফেরেস্তারা সব চলে গেল।
"নাসির ভাই নাসির ভাই" ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গল... ব্যথায় চোখ খুলতে পারছি না, ডান চোখ কোনোমতে একটু ফাঁক করে দেখি, আমাদের সাইফুল মিয়া। আমি জিজ্ঞাসা করলাম:
- সাইফুল মিয়া, তুমি মরলা কবে?
- কী যে আবোলতাবোল বকতেছেন আপনি কিছু দিন ধইরা! দাড়ান আমি ভাইজানরে (আমার বউ মিলির বড় ভাই) ফোন করতেছি।
- তুমি মর নাই? তাইলে এখানে আসলা কীভাবে?
- নাসির ভাই, আপনি কিচ্ছু চিন্তা কইরেন না, আমি ভাইজানেরে ফোন কইরা দিছি আপনারে এক্ষনি ছাইড়া দিব।
কিছুক্ষণ পরে দারোগা ফেরেস্তা আমাকে ছেড়ে দিল। আমি দোযখ-বেহেস্ত কিছু খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ বাসায় ফিরে আসলাম পরের দিন দুপুরে। বউ বিছানায় পড়ে আছে, কথাবার্তা বন্ধ। তাকে গীতার অংশটুকু বাদ দিয়ে সমস্ত কাহিনি সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে বললাম, কিন্তু সে তো আর সেই যুগের খাদিজা না যে, আমাকে কম্বল দিয়া মুড়াইয়া দিবে! সে হচ্ছে এই যুগের মিলি, আমারে কম্বল দিয়া না মুড়াইয়া সে নিজেই কম্বল মুড়ি দিয়া আছে সারাদিন।
বাচ্চা কাচ্চারা সামনে আসতেছে না...
দাদি ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করতেছে "ও মিলি, পুলাপাইন আমার ধারে রাইখা তুমি খবিশটারে লইয়া আবার বিদ্যাশ চইলা যাও, আমার কথা না শুনলে পস্তাইবা বইন।"
নবুয়ত পাওয়ার আগে জীবনটা বড়ই সুখের ছিল... এখন শুধুই চোখের সামনে ডাইমন্ড শেইপ একটা ক্রিস্টাল দেখি, যে কিনা নিজেরে আল্লাহ বলে দাবি করে; সাথে আবার যোগ দিছে গীতার মসৃণ তেলতেলে শরীরটা। চোখে আর অন্য কিছু দেখি না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন