সোমবার, ২ জানুয়ারী, ২০১২

আমার অবিশ্বাস

লিখেছেন পাভেল মাহমুদ 

ভালো ছেলে হতে হলে নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে, কোরান শরীফ তেলাওয়াত করতে হবে – গুরুজনদের এইসব উপদেশ আরো দশটা ছেলের মতো খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মেনে চলার চেষ্টা করতাম। ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করা এবং ভালো ছেলে হওয়াই জীবনের উদ্দেশ্য, এর বাইরে তেমন কিছু ভাবতে, কিছু করতে কেউ আমাকে উৎসাহিত করেনি। এভাবে চলতে থাকলে আজ হয়তো আমি পথে পথে তাবলিগের কর্মী হিসাবে ঘুরে বেড়াতাম অথবা ইসলামি শাসন কায়েম করতে রাস্তায় নেমে পড়তাম। কিন্তু আমার বাবা-মা একটা ভুল করে বসল, তারা আমাকে পড়াশোনায় ভালো করার জন্য ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করে দিল। 

এক-দুই বছরের মধ্যে আমি ধার্মিক হিসাবে পরিচিত হয়ে গেলাম ক্লাসমেটদের কাছে। ওই বয়সে মনের মধ্যে এই কারণে কোন সুপিউরিওরিটি কমপ্লেক্স ছিল কিনা এখন ঠিক বলতে পারব না, তবে বেশ ভালো লাগত অন্যদের বিভিন্ন ধরনের ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান দিতে। বেশির ভাগ প্রশ্ন ছিল জানার জন্য। কেউ কেউ অবশ্য বিভিন্ন ধরনের বাঁকা প্রশ্ন করত - ‘ছেলেরা কেন চারটি বিয়ে করতে পারে’, ‘মুহাম্মদ কেন এতগুলো বিয়ে করেছিল’, ‘সবকিছু ভাগ্যে লেখা থাকলে পাপ করলে কেন তার শাস্তিভোগ করতে হবে’, এই ধরনের প্রশ্ন যা অশিক্ষিত মুটে-মজুর থেকে শুরু করে শিক্ষিত ভদ্রলোক পর্যন্ত সবার মনেই আসে। যদিও এইসব সাধারণ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই, ক্লাস এইট-নাইনের বাচ্চাদেরকে কিছু একটা বোঝানো যায় জাকির নায়েক টাইপের যুক্তি দিয়ে। আমিও তাই করতাম। এই ধরনের কুযুক্তির সফলতা নির্ভর করে নিজের জ্ঞানের পাল্লা কতটা ভারী, এটা সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে জাহির করা এবং যাকে যুক্তি দেয়া হচ্ছে তাকে দ্রুত অপরাধবোধে ভোগানোর মধ্যে। আমি লাইব্রেরি থেকে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বই, মসজিদ থেকে হাদীসের বিশাল ভলিউম নিয়ে এসে পড়তাম। যদিও আমার উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম সম্পর্কে জানা, এতে করে অপরাধবোধে ভোগা আমার অনেক বন্ধুর আমার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যেত। তবে সমস্যা হয়ে গেল লাইব্রেরিতে আসা-যাওয়া করতে করতে আমি অন্যান্য বইও পড়তে শুরু করলাম।

দুই বাংলার লেখকদের লেখা উপন্যাস, কবিতা, আলোচনা-সমালোচনা আমি কিছুই বাদ দিতাম না। যাই পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম। এসএসসির ছুটিতে এক পুরনো শিক্ষকের বাসা থেকে এনে কালিদাস থেকে শুরু করে বঙ্কিমবাবু, শরৎ, রবীন্দ্র, শেক্সপীয়ার, হোমার গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। এখনো মনে পড়ে, শরৎচন্দ্র পড়ে হিন্দুসমাজে দলিতদের জন্য, নারীদের অসহায়ত্বের জন্য খারাপ লাগত। জীবনানন্দের কবিতা কেমন এক রহস্যময় পৃথিবীর দরজা খুলে দিয়েছিল। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, সাহিত্য পড়তে শুরু করলে হাদীস-কোরান পড়ে আর আগের মতো ভাল লাগে না। মনে হ্ল, ছেলেমেয়েদের মেলামেশা, ভালবাসা, এমনকি বন্ধুত্ব কেন ইসলামে নিষেধ? কোরান তো কবিতা, তাহলে কোরান কেন জীবনানন্দের চাইতে নীরস? এইসব প্রশ্ন থেকে থেকে মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত। মানুষের সম্পর্ক, জীবনযাপনের পদ্ধতি আল্লাহই ভাল বোঝেন, কোরানের সাথে জীবনানন্দের তুলনা করা ঠিক না, এইসব ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিতাম।

ক্যাডেট কলেজে শেষ দুই-তিন বছর একরকম দ্বন্ধপূর্ণ সময় কেটেছে। গাছ-লতা-পাতা, আকাশ, বৃষ্টি, নারীমুখ এইসব নিয়ে কবিতা লিখি, গল্প লিখি যেখানে নায়িকারা পর্দা করতে পছন্দ করে, নায়কেরা কখনো নায়িকার হাত ধরে না। ক্লাসে ধর্ম শিক্ষক হিন্দু বন্ধুকে বের করে দিয়ে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব না করার কোরানের আয়াত শোনায়। কষ্ট লাগে, নির্বাক হয়ে যাই। তালেবানদের আফগান জয়ে আনন্দিত হই, একটা সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কীভাবে সবাই অবশেষে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে, বন্ধুদের সেই কথা শোনাই। জুওলজির শিক্ষক বিবর্তন পড়িয়ে যখন বলে ‘এইগুলা কেউ বিশ্বাস করবা না, তাহলে আমি দোজখে যাব’, বুকের ভিতরে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করি, হাজার বছরের পুরনো দেয়াল নড়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই দেয়ালে গজিয়ে ওঠা কিছু শেকড়-বাকড় ছিড়ে যায়। আবার অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করি, আঁকড়ে ধরি ধর্ম। মনের ভিতরে জেগে ওঠা সব প্রশ্নের ঝড় ধামাচাপা দেই অজ্ঞানতার অজুহাতে, নিজের ক্ষুদ্রতার, সামান্যতার অজুহাতে। ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে আসি ভালো ছেলের মুখোশটা পরে।

ইউনিভার্সিটির ক্লাস করি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই, সাধারণ সুখী মানুষের প্রশ্নবিহীন জীবনে অভ্যস্ত হতে থাকি একটু একটু করে। হয়তো কখনো জুম্মার নামাজটা পড়ি, কখনো কখনো তাও পড়া হয় না, ধর্ম নিয়ে আর মাথা ব্যথা করি না। এমনভাবে কেটে যায় বছর দুয়েক। একদিন কী ভেবে সমরেশের 'সাতকাহন' বইটি পড়তে শুরু করি। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপাবলি সমাজে ভীষণ রকমের পোড় খাওয়া এক মেয়ে। হিন্দুধর্ম থেকে উঠে আসা সমাজের সব অন্যায় অবিচার অসম্মান দীপাবলিকে পদে পদে আহত করে। কিন্তু অসম্ভব সাহসী এই মেয়ে কোনোভাবেই হার মেনে নেয় না; সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে, সমাজের নিষ্ঠুর ক্রুরতার বিরুদ্ধে সে তার লড়াই চালিয়ে যায়। অতি-নাটকীয়, সেন্টিমেন্টাল এই গল্প আমাকে কেমন যেন দুর্বল করে দেয়। নিজেকে হিপোক্র্যাট মনে হতে থাকে। বাঁধ-ভাঙা ঢেউয়ের মতো আমার মনে পড়তে থাকে কত অসংখ্যবার আমি নারীর অসম্মানকে যুক্তি দিয়ে, হাদিস-কোরান শুনিয়ে, বিভিন্ন-রকম জোড়াতালি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছি। হাজার বছর ধরে হাজার দীপাবলি আমার মতো মেরুদণ্ডহীন মানুষের সমাজে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে গেছে। এরপর ধর্মের আরো অসংখ্য ছিদ্র আমার সামনে একে একে বড় হতে শুরু করল, আমার একুশ বছরের অর্থহীন জীবন একটা উপহাস মনে হ্ল, আমি কিছুদিন লজ্জায় ম্রিয়মান থাকলাম। একসময় দীপাবলির ছড়িয়ে দেয়া সাহস আমিও একটু বুকের ভেতর সঞ্চয় করলাম, প্রথমবারের মতো নিজ মুখে বললাম, ‘এইসব বস্তাপচা ধর্ম আমি আর মানব না’।

এরপরও কিছুদিন মৃত্যু পরবর্তী অস্তিত্বহীনতা মেনে নিতে পারতাম না। এক ধরনের হতাশা বোধ করতাম, কী হবে মৃত্যুর পরে? খুব সম্ভবত কিছুই না, মাটিতে মিশে গলে যাব, কংকালটা পড়ে থাকবে। আশ্চর্যজনকভাবে, বাবার মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে এইসব হতাশা কেটে গেল। আসলেই কি কেউ কখনো শেষ হয়ে যায়? প্রতিটি মানুষ, যার জীবন আমি কিছুটা স্পর্শ করেছি, যার জন্য আমার সামান্য কিছু অনুভূতি আছে, আমি জানি তার পৃথিবীতে আমি বেঁচে থাকব অনেকদিন। অপদার্থ ঈশ্বরের অপদার্থ স্বর্গ-অপ্সরীদের চেয়ে, বাসে ঝুলে ঘরে ফিরে আমার সাথে এক কাপ চা খেতেই আমার বাবার সব সময় ভাল লাগবে। 

ভয়, লোভ, কিংবা অপরাধবোধ নয়, এখন আমি বেঁচে থাকি বেঁচে থাকবার আনন্দে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন