লিখেছেন কৌস্তুভ
‘নব্য নাস্তিকতার চার ঘোড়সওয়ার’-এর একজন, ড্যানিয়েল ডেনেটের ইন্টারভিউটা প্রকাশ হওয়ার পর এক মন্তব্যকারী সেখানে বলেছিলেন,
Atheist knowledge of Other People’s religion is a powerful thing. Never stop learning.
এই কথাটার সঙ্গে আমি দারুণভাবে সহমত। তাই এ নিয়ে আপনাদের দু-চারটে কথা বলে একটা আবেদন রাখি।
১.
এই মজার ঘটনাটা ছোটবেলার একটা বইতে পড়া, এখন বিশদ মনে নেই। বঙ্কিম তখন কোনো এক টাউনের ম্যাজিস্ট্রেট কি হাকিম। ইংরেজ সরকারের পুলিশ এক গরীব বুড়িকে তাঁর এজলাসে ধরে নিয়ে এল, কমবাস্টিবল অর্থাৎ দাহ্য পদার্থ – খড়ের কুঁড়েঘর বানানোর জন্য। বুড়ি তো ভয়ে আকুল, জরিমানার টাকা সে গরীব মানুষ কোত্থেকে পাবে? দয়ালু বঙ্কিম কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে বুড়িকে বেকসুর খালাস করে দিলেন!
হয়েছিল কি, ওই আইনের বাংলা অনুবাদ যে করেছিল, সে ‘জ্বলীয়’ লেখার বদলে লিখে ফেলেছিল ‘জলীয়’। তাই বঙ্কিম ‘বুড়ির ঘর তো জলের তৈরী নয়’ বলে রায় দিয়ে তাকে খালাস করে দিতে পেরেছিলেন।
কয়দিন আগে ‘একলব্যের গুরুভক্তি ও উচ্চবংশের ছলচাতুরী’ পোস্টে আমার সাথে লম্বা বিতর্ক চলেছিল, পোস্টের মূল অভিযোগটা ধর্মসম্পর্কহীন বলাতে। আমি বলেছিলাম, উচ্চবর্ণ – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, এদের প্রাধান্যটা হিন্দুধর্মের সৃষ্টি, কিন্তু উচ্চবংশের প্রাধান্যটা ধর্মসৃষ্ট নয়, সেটা আসে কেবল আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে। বোকাবলাকার ওই ভুলটা আপাতদৃষ্টিতে হয়ত বড় কিছু নয়, দু-একটা অক্ষর, কিন্তু ধর্মের সমালোচনা করার দিক থেকে ওটা আমাদের অবস্থানকে অনেকটাই দুর্বল করে দিচ্ছে। ওই ঘটনাটার মতই, বিপক্ষকে এক মিলিমিটারও ছাড় দেওয়া যাবে না, আমাদের যুক্তির অবস্থানকে একেবারে ‘ওয়াটারটাইট’ করেই রাখতে হবে।
২.
‘সনাতনী কামিনী’র ইবুক বানাবার সময় একেবারে কেরানীসম কপি-পেস্ট-পিডিএফ না করে সম্পাদকীয় অভ্যাস অনুযায়ী একটু কপি-এডিটিং করতে গিয়েছিলাম। তাতে দেখলাম, একটা শব্দ ঘেঁটে ু া হয়েটয়ে আছে।
মূলটা দেখে ঠিক করে দেবার উদ্দেশ্যে রেফারেন্স খুঁজলাম। দেখলাম উনি অনন্ত বিজয় দাশের লেখা থেকে অংশটা নিয়েছেন, রেফারেন্সটাও সেখানকারই। কিন্তু সেটা ভুল, শব্দটা ওই সোর্সে নেই!
খুঁজে মহাভারতের অন্য একটা চ্যাপ্টারে শ্লোকটা পেলাম। তাই লেখায় রেফারেন্সটা আর শব্দটা দুটোই বদলে দেওয়া গেল।
ধর্মপচারকের মাধ্যমে লেখক নীল-এর সঙ্গে বার্তাবিনিময় হল, শুনলাম উনি আর রেফারেন্স চেক করে দেখেননি ওনার লেখার সময়। আমারও প্রত্যেকটা রেফারেন্স মিলিয়ে দেখা সময় হয়নি, আরো কিছু ভুলভ্রান্তিও থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
আবারও এটা আমাদের দিক থেকে তথ্য-প্রমাদ। আর এগুলো কোনো ধার্মিকের সঙ্গে তর্ক করার সময় আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করে দেবে, তারা ‘আগে তো হিন্দুধর্মটা ঠিক করে জানো তারপর তর্ক করতে আসবে’ বলে পিছলে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
তাই আমার অনুরোধ, তথ্য-প্রমাণের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব নিখুঁত থাকার চেষ্টা থাকুক। কেউ কোনো সুরার নম্বরের ভুল দেখিয়ে দিলে যেমন ধর্মপচারক দ্রুততার সঙ্গে বদলে ফেলেন, তেমনি আমরা যেন সদা পরিমার্জন-আপডেট করতে থাকি আমাদের ধর্ম-তথ্যভাণ্ডার।
৩.
গতবছর আমার এক বন্ধু খুব উৎসাহ নিয়ে Zeitgeist সিনেমাটা দেখিয়েছিল, যাতে খ্রীষ্টধর্মের ভেজালের সম্পর্কে একটা অংশ আছে। তাতে দেখানো হয়েছিল, ভার্জিন বার্থের মিথ বহু পুরোনো, ইজিপ্টের হোরাস দেবতার বহু হাজার বছর আগের গল্প থেকেই তা চলে আসছে, সারা দুনিয়ার বহু দেবতার সম্পর্কেই তা প্রচলিত (বুদ্ধ, ইরানের মিথ্রা), এমনকি কৃষ্ণেরও, আর সেখান থেকেই যীশুরটাও টোকা।
এইটা দেখে আমি এমন জনপ্রিয় একটা ডকুমেন্টারির তথ্যচ্যুতি নিয়ে দুঃখিত হলাম, কারণ আমার জানা বহু সোর্সমতে ভার্জিন বার্থের দ্বারা কৃষ্ণের জন্ম হয় নি, কংসের কারাগারে দেবকী আর বাসুদেব একসাথে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেবকীর গর্ভ হয়ে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। বরং লোকে ইয়ার্কি মেরে বলে, কংস এতবড় গাধা যে, ‘তোমার বোনের সন্তান তোমার মৃত্যুর কারণ হবে’ দৈববাণী শুনে যদি বোন-ভগ্নীপতিকে বন্দি করে রাখলিই, তবে এক কক্ষে রাখলি কেন রে ছাগলটা?
কিন্তু তার পরে যিশুকে নিয়ে আরো একটা ডকুমেন্টারি, The God Who Wasn't There -এ একই কথা শুনে আমার মনে হল, আরো তদন্ত করা উচিত। তখন জানতে পারলাম, বিষ্ণুপুরাণের এক অংশে এই গল্প সর্বপ্রথম চালু হয়।
এখন মজা হচ্ছে ক্রোনোলজিতে। মহাভারতের যুদ্ধ ঘটে আনুমানিক ১৪০০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। এবং যাদব নামের এক জনগোষ্ঠী(ক্ল্যান)-এর যুবনেতা হিসাবে বাস্তবিকই কৃষ্ণ বলে কেউ ছিল, এমনই ধরা হয়, অনেক পরে যার উপরে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর মহাভারতের প্রাচীন, ঐতিহাসিক অংশও খ্রীষ্টজন্মের আগেই রচিত। আবার ইজিপ্টের ওই আধা-মানুষ-আধা-বাজপাখি হোরাস দেবতার গল্পও খ্রীষ্টজন্মের কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই প্রচলিত।
কিন্তু বহু শতাব্দী ধরে মহাভারত যেমন বারবার এডিট হয়েছে, তেমনই প্রাচীন পুরাণগুলোও আর নেই, তার বদলে নতুন সাধুদের লেখা নতুন শ্লোকগুলোকেই ওই নামের পুরাণের স্থানে ধরা হয়। সেগুলো খ্রীষ্টজন্মের সময় থেকে দশম-একাদশ শতকের মধ্যে রচিত বলে ধরা হয়।
বহু যুগ ধরেই ভারতের সাথে মিশর, ইরান, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি স্থানের বাণিজ্যের সূত্রে যোগাযোগ। ভারতের গাথা, যেমন পঞ্চতন্ত্র, যেরকম সেদেশে গিয়েছে, তেমনই সেদেশের হোরাস দেবতার রূপকথা বা যীশু নামের কোনো ইহুদী ধর্মপ্রচারকের গল্প (যীশু তো শুরুতে ইহুদীই ছিলেন, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টও ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ থেকেই ঝেড়ে টোকা – যদি অবশ্য ওই নামে কেউ থেকে থাকে, কারণ যীশু বলে বাস্তবে কেউ ছিল কি না তাই নিয়েই ঐতিহাসিকদের মধ্যে সন্দেহ আছে) এদেশে এসে থাকতেই পারে।
অতএব বিষ্ণুপুরাণের ওই শ্লোক-রচয়িতা কার থেকে টুকেছেন, যীশুর থেকে না হোরাসের থেকে না বুদ্ধের থেকে, আবার যীশুর কাহিনীকারই বা হোরাস না মিথ্রা নাকি কৃষ্ণ কার থেকে শুনেছেন, তা বলা দুঃসাধ্য।
নিজের তথ্য-খামতি সংশোধন করে খুশি হয়ে উঠলাম। ওই যে বলেছে, Never stop learning.
তাই, সমমনাদের প্রতি আমার আবেদন, নাস্তিকদের সব ধর্মের সম্পর্কে এই জ্ঞান খুবই শক্তিশালী একটা হাতিয়ার, এটাকে মুমিনের ঈমানের মতই সদা উদ্যত করে রাখুন। আর কোনো নাস্তিকীয় বক্তব্য দেখলে সেই জ্ঞানটাকে ব্যবহার করে নিজেকে কোনো মুমিনের স্থানে বসিয়ে পরীক্ষা করে নিন, যুক্তিটা ব্যবচ্ছেদ-প্রুফ কিনা। হলে, সেটা খুশিমনে গ্রহণ করে প্রচার করুন। নাহলে শিঘ্রি জানান, ওই লেখকও শিখতে পারবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন