লিখেছেন হিমালয় গাঙ্গুলী
রাত আড়াই টার সময় আমি খাদিজার দরজায় নক করলাম।
ভেতর থেকে থপ থপ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। খাদিজার আকৃতি প্রায় মৈনাক পর্বত। সে চলার সময় থপ থপ শব্দ হয়। সেই শব্দের ও একটা ছন্দ আছে...
থপ থপ থপ্পস
থপ থপ থপ্পস
বেশিক্ষন থপ থপ শব্দ শোনা গেল না। খটাস করে দরজা খুলে গেল। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে খাদিজা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ রক্তবর্ণ । মনে হচ্ছে মৈনাক পর্বত ফেটে কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা হুলুস্থুল ব্যাপার হবে।
আমি অগ্নিদৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললাম, "কেমন আছ, খালা?"
খাদিজা কর্কশ গলায় বলল, "খালাটা কে?"
আমি উদাস গলায় বললাম, "একবিংশ শতাব্দিতে জনৈক ঔপন্যাসিক তোমার মত স্বাস্থ্যবতী একটা চরিত্র সৃষ্টি করবেন। তাঁর নাম হবে মাজেদা খালা। আফসোস, তোমার কোনো পুত্র সন্তান নাই। থাকলে আকীকা করে তার নাম বাদল রাখা যেত।"
খাদিজা থমথমে গলায় বলল, "ভণ্ডামি বন্ধ কর। হলুদ রঙের আলখেল্লা পরেছ কেন?"
আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললাম, "হলুদ বৈরাগ্যের রং। মহাপুরুষদের বৈরাগ্য থাকা বাধ্যতামূলক।"
খাদিজা বিদ্রুপের স্বরে বলল, "তুমি মহাপুরুষ?"
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। আমার সেই বিখ্যাত বিভ্রান্তিকর হাসি, যার মানে হ্যাঁ না দুই-ই হতে পারে।
খাদিজা বলল, "নিজের বউকে খালা ডাকছ কেন?"
আমি হালকা গলায় বললাম, "মহাপুরুষরা আর্থিক কারণে খালার বয়সী কাউকে বিয়ে করতে পারে। আবার তার আকৃতির কারনে তাকে খালাও ডাকতে পারে। হাদিসে আছে।"
খাদিজা হুঙ্কার দিয়ে বলল, "অফ যা ফাজিল।"
আমি অফ গেলাম। খাদিজা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।
আমি রাস্তায় নেমে এলাম। ফাজিল শব্দটা আমার পছন্দ হয়েছে। ফাজিল অর্থ জ্ঞানী। জ্ঞানী হলেও একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে। আমার আধপাগল বাবা তার বিখ্যাত উপদেশমালায় বলে গেছেন "নারীরা শস্যক্ষেত্র। তোমরা ইচ্ছা মত সেখানে শস্য ছড়িয়ে দাও।"
আমার বাবা খাদিজাকে দেখেন নি। দেখলে হয়ত বলতেন "নারীরা পাহাড় পর্বত। তোমরা সাধ্যমত সেখানে জুম চাষ কর।"
মরুভুমির বালির উপর দিয়ে আমি হাঁটছি। পূর্ণিমার চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়েছে। মরু জ্যোৎস্নার অপার্থিব আলোয় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। আমি হাঁটছি, হাঁটছি। আচ্ছা বেহেস্তের সৌন্দর্য কি এর চেয়ে বেশি?
কতক্ষন হেঁটেছি, জানি না। হঠাৎ খেয়াল হল আমি আমি আমার চাচার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এই ভদ্রলোক কোনো এক রহস্যজনক কারণে আমাকে দু'চোখে দেখতে পারেন না। মানুষকে চমকে দেবার একটা সচেতন ইচ্ছা সবসময় আমার মধ্যে কাজ করে। আমি আল্লাহু আকবর বলে হাঁক দিলাম।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, "না চাচা। সুসংবাদ। একটু পরেই ফজরের ওয়াক্ত। আল্লাহপাক বেহেস্তের দরজা খুলে দেবেন। বেহেস্তি হাওয়ার সাথে দু'-একটা হুর-টুর চলে আসতে পারে। বলেন সুবহানাল্লাহ!"
চাচা রাগী-রাগী গলায় বললেন, "রসিকতা করছ?"
আমি বিনীত গলায় বললাম, " জ্বি চাচা। আপনার শরীর ভাল?"
চাচা থম থমে গলায় বললেন, "মুহাম্মদ! আমি তোমার চাচা। তোমার ইয়ার দোস্ত না। আমার সাথে রসিকতা করবে না"
আমি বিনয় আর এক ডোজ বাড়িয়ে বললাম," চাচাজি, আমাকে মুহাম্মদ বলবেন না। আমার পুরো নাম মুহাম্মদ হিমালয়। সংক্ষেপে মুহি বলতে পারেন। ১৪০০ বছর পর, বাঙ্গালা ভাষারীতির ধ্বনি বিপর্যয় নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা হবে হিমু।"
চাচা হতাশ গলায় বললেন, "এই সব উদ্ভট কথাবার্তার অর্থ কী?"
আমি গলায় বৈরাগ্য ঢেলে বললাম, "মহাপুরুষ হবার চেষ্টা করছি।"
চাচা বললেন, " মহাপুরুষ হবার দরকারটা কী?"
আমি উদাস গলায় বললাম, "জানি না। আমার বাবা আমাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার উপদেশমালায় তিনি বলেছেন, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, মুহাম্মদ তাঁর রসুল।"
চাচা চিৎকার করে বললেন, "বহিষ্কার বহিষ্কার! এই মুহূর্তে বহিষ্কার!"
আমি বিনয়ে গলে পড়তে পড়তে বললাম, "আমার মাথা-খারাপ বাবা নিজেকে অদ্বিতীয় বলেছেন বলে আমি তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আচ্ছা চাচা! রসুল মানে তো মহাপুরুষ টাইপ কিছু, নাকি?"
চাচা তাঁর রাগের সর্ব উচ্চ সীমায় চলে গেলেন। এই সময় তিনি হিন্দি ভাষায় গালি গালাজ করেন। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, "গিদ্ধর কি ছানা! আভি নিকলও ইহাসে! নাহি তো..."
আমি আর কথা বাড়ালাম না। কেটে বেরিয়ে এলাম। চাচা এত সহজে রাগ করেন না। মাঝে মাঝে তিনি একটু আধটু মদ্যপান করেন। তাঁর লিমিট হচ্ছে সাত। আজ মনে হয় দশ-বারো পেগ চড়িয়ে ফেলেছেন।
আমি পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। চন্দ্রাস্তের আলোয় অন্ধকারের শেষ মৃত্যু । হঠাৎ মনে হল আমি কোন মহাপুরুষ নই। আমরা সবাই প্রকৃতির কোন বিরাট পরিকল্পনার অংশ। সেই পরিকল্পনায় আমি একজন অতি ক্ষুদ্র মরু পরিব্রাজক। এভাবে পথ চলতে চলতেই একদিন আমার মৃত্যু হবে। সেদিনই সব কিছুর সমাপ্তি। পরকাল বলে আসলে কিছু নেই। সবই চিরকাল বেঁচে থাকার একটা মিথ্যা আশা। জীবনের জন্য মায়া। কিন্তু এই মায়াকে অতিক্রম করার ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয় নি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন