লিখেছেন হিমালয় গাঙ্গুলী
ঘুমের মধ্যেই মনে হল, আমার ঘরের ভিতর কেউ হাঁটছে।
আমি একবার তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘটনা সত্য। পাতলা ফিন ফিনে সাদা আন্ডারওয়্যার পরা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক আমার ঘরের মধ্যে হাঁটছেন। এই ভোরবেলা তিনি আমার ঘরে কী চান, কে জানে। এই লোক চোর হবার কথা না। কেননা আমার ঘরে চুরি করার মত কিছু নেই। একটা খাট পর্যন্ত নেই। খেজুর পাতার একটা মাদুর পেতে আমি শুয়ে থাকি। সেই মাদুর আমার নিজেরই বুনতে হয়। মাদুরের ব্যাপারটা একটা ভড়ং। মহাপুরুষ হতে গেলে নানা ধরনের ভড়ঙের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। দারিদ্র্যবিলাস তাদের মধ্যে বাধ্যতামূলক। আমার বাবা তাঁর উপদেশমালায় বলেছেন, "দুনিয়াতে যার সম্পদ কম, আখেরাতে তাঁর হিসেব সহজ হবে।"
কিছু একটা খাওয়ার শব্দ আসছে। আমি কুঁত-কুঁত করে তাকালাম। ভদ্রলোক পোটলা খুলে খেজুর খাচ্ছেন। এই খেজুরের পোঁটলা আমাকে দিয়েছে আয়েশা। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম থেকে আমার নাকি আলসার-টালসার হয়ে যেতে পারে। এজন্য খিদে লাগলেই চট করে দুটো খেজুর খেয়ে নিতে হবে।
ভদ্রলোক বেশ আগ্রহ করে খেজুর খাচ্ছেন। দেখে মায়া লাগছে। আহারে বেচারা!
আমার একবার ইচ্ছে হল "নারায়ে তাকবীর" বলে চিৎকার দিয়ে লোকটাকে চমকে দিই। সেই ইচ্ছে চাপা দিলাম। যথেষ্ট বয়স্ক লোক। চমকে উঠলে ধুম করে অ্যাটাক-ফ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। আমি গলা যথা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, "কাইফা হালুকা! ভাই সাহেব, শরীরটা ভাল?"
ভদ্রলোক আমার চেয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন, "জ্বি ভাল। খেজুর খাচ্ছি। অতি উপাদেয় ফল। বেহেস্তেও সুমিষ্ট খেজুরের ব্যবস্থা রেখেছেন আল্লাহপাক।"
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, "ও আচ্ছা।"
ভদ্রলোক সযত্নে খেজুরের পোটলাটি বেঁধে রেখে আমার পাশে এসে বসলেন। অপরাধীর মত মুখ করে বললেন, "সুবেহ সাদিকের সময় ভাই সাহেবের কাঁচা ঘুম ভাঙালাম।"
আমি বিজ্ঞের মত বললাম, "ভালই করেছেন। ঘুম হচ্ছে সাময়িক মৃত্যু। যে মৃত্যুতে হুর পাওয়া যায় না, সেই মৃত্যু যত কম হয়, ততই ভাল।"
ভদ্রলোক কাঁচুমাচু করে বললেন, "ভাই সাহেব কিঞ্চিৎ ভুল বলেছেন। যৌবনের শুরুতে ঘুমের মধ্যেও হুর আসে। শয়তান ভাই এটা করেন বলে একে স্বপ্নদোষ বলে। আল্লাহপাক করালে সম্ভবত এটাকে স্বপ্নগুণ বলা হত।"
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "আমার এখন যৌবনের শুরু না, ট্যাংকি প্রায় খালি।"
আমি উদাস গলায় বললাম, "করেছি। তবে গতকাল বউকে হেভি ডলা দিয়েছি। একেবারে বাঁশ ডলা টাইপ। রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে।"
উনি হতভম্ভ হয়ে বললেন, "হেভি ডলা দিয়েছেন কেন?"
আমি আরও উদাস গলায় বললাম, "আমার বাবা তাঁর বিখ্যাত উপদেশমালায় বলেছেন, তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সদুপদেশ দাও। অতঃপর তাদের শয্যা বর্জন কর ও তাদের প্রহার কর।"
ভদ্রলোকের চোয়াল ঝুলে পড়ল। মানুষের হতভম্ভ মুখ দেখতে আমার ভাল লাগে। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তার বিস্ময় দেখতে লাগলাম।
বিস্ময় বেশিক্ষন দেখা গেল না। তিনি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, "ভাইজানের সাথে থাকা একটা শিক্ষাসফরের মত, কত কিছু শেখা যায়!"
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। তিনি হড়বড় করে বললেন, "ভাই সাহেব কিন্তু একবারও আমার পরিচয় জানতে চান নি।"
আমি বললাম, "আমার কৌতূহল কম। মহাপুরুষদের জন্য কৌতূহল নিষিদ্ধ।"
তিনি বললেন, "হুজুরের আজ্ঞা হলে পরিচয় বলি?"
মহাপুরুষদের আগ্রহ প্রকাশ করতে হয় না। আমি বিকট শব্দে হাই তুললাম।
আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই তিনি পরিচয় দেওয়া শুরু করলেন এবং ঝাড়া বিশ মিনিট বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দিলেন। তার দীর্ঘ বক্তব্যের মোদ্দা কথা হল, তার নাম জিব্রাইল। তিনি পেশায় একজন নাপিত। তার ওস্তাদের নাম ইসরাফিল, যিনি একজন শখের বংশীবাদক। জিব্রাইল সাহেবের কিঞ্চিৎ গঞ্জিকাসেবনের অভ্যাস ছিল। একদিন অতি গাঁজার ঘোরে তিনি আন্ডারওয়্যার পরে রাস্তায় বের হয়ে যান এবং পাবলিক তাঁকে ফেরেশতা হিসেবে ধরে নেয়। তখন তার গা থেকে ভুরভুর করে বেলি ফুলের সুবাস আসতে থাকে। সেই থেকে তিনি অন্তর্বাস পরেই ঘুরাঘুরি করেন। নাপিতমহলে তার মাথা বানানোর সুনাম ছিল। তার মাথা বানানোতে মুগ্ধ হয়ে মক্কা বহুমুখি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁকে একটি রূপার মেডেল দেন। তার কাজের ছেলে মেডেলটি নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে বলে তিনি আমাকে জিনিসটা দেখাতে পারলেন না।
তার এই দীর্ঘ বক্তব্যের পর আমার কী বলা উচিত, বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করলাম, "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।"
জিব্রাইল বিনীত গলায় বলল, "ভাই সাহেব, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, ছোট ভাইকে তুমি করে বলবেন। আপনার সাথে কোন বেয়াদবি করে থাকলে আমি বড়ই শরমিন্দা। আপনি অনুমতি করলে আমি আপনার মাথাটা একবার বানিয়ে দিতে চাই।"
আমি দরাজ গলায় বললাম, "দিতে ইচ্ছা করলে দিবে। মনে আফসোস রাখা ঠিক না।"
জিব্রাইল ইতস্তত করে বলল, "তবে ভাই সাহেব, এখানে না। গলা পর্যন্ত বালিতে ডুবিয়ে মাথা বানালে হচ্ছে আসল মজা।"
আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললাম, "চলো। আসল মজা নিয়ে আসি।"
হেরা নামক পর্বতের গুহার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। জিব্রাইল বেলচা দিয়ে বালি তুলছে। সূর্য তখন মধ্যগগণচারী। আমি উদাস মুখে বসন্তের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মহাপুরুষত্ব মনে হয় মাকরুহ হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং মাঝে মাঝেই আমার বাচ্চা বধূ আয়েশার কথা মনে হয়। আমি শিস বাজানোর চেষ্টা করলাম, "বাচপান কা দিন ভুলা না দেনা..."
জিব্রাইল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "ভাইজান, গর্ত কমপ্লিট।"
আমি গলায় বৈরাগ্য এনে বললাম, "গর্ত দেখলেই আমার আর দেরি করতে ইচ্ছে হয় না। ফি আমানিল্লাহ।"
জিব্রাইল ইতস্তত করে বলল, "বস, গাঞ্জা না খাইলে মাথা মালিশের আসল মজা পাওয়া যায় না। আমার ওস্তাদ ইসরাফিল খাঁ সাহেব বলেছেন। উনি বাঁশি বাজানোর সময় ও সামান্য সিদ্ধি নিতেন।"
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, "আসল মজার জন্য গাঞ্জা খাওয়া সুন্নাত। হাদিসে আছে। দেবাদিদেব মহাদেব ও তাণ্ডব নৃত্যের আগে ভাং খেতেন।"
জিব্রাইল তার অন্তর্বাসের চিপা থেকে দুই স্টিক র গাঁজা বের করল। আমি ভরপুর গাঁজা খেয়ে গর্তে নেমে পড়লাম।
চৈত্র মাসের কঠিন রোদে গরম বালির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে আমি মাথা বানানোর আসল মজা নিচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, এক ঝাক পিঁপড়া ভিজে পায়ে আমার মাথার মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। জিব্রাইল আসলেই ভাল মাথা বানায়। তার গা থেকে এখন আমি বেলি ফুলের সুবাসও পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, আমি কাক চক্ষু জল এক নদীর পাড়ে হাঁটছি। নদীর নাম ময়ূরাক্ষী। একটা সাইন বোর্ড দেখে আমার ভুল ভাঙল। সাইন বোর্ডে লেখা...
নদীর নাম: পুলছিরাত
ইজারাদার: শয়তান অ্যান্ড কোং
বি: দ্র: এখানে সাঁতার কাটা নিষেধ।
হঠাৎ দেখি পুলছিরাতের পাড়ে আমার বাবা দুঃখী দুঃখী চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।
বাবা শিউরে উঠে বললেন, "এ কী, হিমু? আমার উপদেশ সব ভুলে গেলি? কাঁদছিস কেন?"
আমি উৎফুল্ল গলায় বললাম, "মহাপুরুষ ট্রেনিং-এ ফেল করেছি, তাই চোখে অশ্রু।"
বাবা হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাবার সাথে পরপার ভ্রমণ ভালই হল। লাইন দিয়ে টিকিট কেটে বেহেস্ত ও দোজখ দেখলাম। রাস্তার পাশের দোকান থেকে খোরমা এবং শরাবুন তহুরা খেলাম। দোজখ ভ্রমণে একটা জিনিস আমার খুব পছন্দ হল। এক জায়গায় চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কাটা হচ্ছে। আমি আমার মাতুল বংশ থেকে তেইশটা ভয়াবহ ক্রোমোজোম নিয়ে এসেছি বলে রক্তপাত জিনিসটা আমার অতি প্রিয়। চুরির শাস্তি হিসেবে আমার দেশেও হাতকাটা চালু করা উচিত বলে আমার ধারণা।
ফিরে আসার আগ মুহূর্তে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। আমি জোর করে কান্না চেপে থাকলাম। মহাপুরুষদের জন্য অশ্রু নিষিদ্ধ। রওনা হওয়ার সময় বাবা আমার হাতে "বুরাক এয়ার ওয়েজ"-এর ইকনমি ক্লাসের একটি টিকিট ধরিয়ে দিলেন।
স্বর্গভ্রমণ শেষে আমি যখন ফিরে এলাম, জিব্রাইল তখনও মাথা বানাচ্ছে। আরামে আমার ঘুম এসে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে মজাটা আর পাওয়া যাবে না বলে আমি কষ্ট করে জেগে থাকলাম।
মধ্যদুপুরের তপ্ত মরু বালুর মধ্যে ডুবে আমি পুলছিরাতের ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ পাচ্ছি। আমার মরীচিকা দেখতে ইচ্ছে করছে। জীবনে এমন এমন সব সময় উপস্থিত হয়, যখন বিপ্রতীপ জিনিসগুলো একই সাথে ধরা দেয়; উত্তাপ-শৈত্য, সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তব। মানুষের চিন্তা-ভাবনার জগৎটাই আসলে বিপ্রতীপ। যে মৃত্যুপথযাত্রী, সে বেঁচে থাকার কথা ভাবে; যে বেঁচে আছে, সে করে মৃত্যুচিন্তা। অসীম মহাবিশ্বে বেশিরভাগ ঘটনাই ব্যাখ্যার অতীত। প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়।
* এই সিরিজের আগের লেখা: মুহাম্মদ হিমুর মরু জ্যোৎস্না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন