বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান থাকলেই কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়?


লিখেছেন জুপিটার জয়প্রকাশ 

আসুন এইবারে তালগাচ কেটে ফেলি।

ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে এখন দুনিয়া গরম। ফল কিন্তু ভালই। ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান বেশ কিছু আছে। তবুও যে প্রশ্নটা থেকে যায় তা হল সেই বিজ্ঞানগুলি কি মানুষের গবেষণার ফল? নাকি অলৌকিক কোনো উৎস থেকে আসা? এটা বুঝতে গেলে যেসব তথ্য ধর্মে পাওয়া যায় সেগুলোকে নেড়েচেড়ে দেখতে হবে যে তাতে ভুল কিছু আছে কি না। ভুল থাকলে বোঝা যাবে যে সেটি কোনো “সর্বজ্ঞ” কারো কাছ থেকে আসেনি।

সেই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে, কোনো ধর্ম যদি প্রমাণ চাওয়াকে অন্যায় বলে দাবী করে, প্রমাণ না থাকা তত্বকে চরম সত্য বলে প্রচার করে তাহলে তাকে এক কথায় অবৈজ্ঞানিক বলে দেওয়া যায়। বিজ্ঞানেও কিছু তত্ত্ব আছে যেগুলি নিঃসংশয়ে প্রমাণিত নয়। কিন্তু সেগুলিকে কোনো বিজ্ঞানী কখনোই চরম সত্য বলে দাবী করেন না। সেগুলি বিনা প্রশ্নে মেনে না নিলে শাস্তি দেবার ভয়ও দেখান না। এমনকি যেসব তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েই গেছে, সেগুলি যাচাই করাও বিজ্ঞানে অন্যায় বলে ধরা হয় না। যে ধর্মে এই গুণগুলি নাই তাকে বৈজ্ঞানিক ধর্ম বলা যায় না।

দুনিয়ার প্রধান চারটা ধর্ম থেকে হিন্দুধর্মকেই পেলাম যেটার মধ্যে ভিন্ন মত প্রচার করার অনুমতি আছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার পরেও তাকে উপাসনা না করার অধিকার আছে। এমনকি ঈশ্বরে বিশ্বাস করার আগে প্রমাণ চাইবার অধিকার আছে। সেইটার মধ্যে বিজ্ঞান খুঁজতে গিয়ে দেখি সাংঘাতিক সব কাণ্ড। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হল, বায়ুপুরাণ বইটাতে দেখলাম পরমাণুর সাইজ বলা আছে। সেই বিবরণ অনুসারে পরমাণুর ব্যাস মোটামুটি 7 x 10^-9 মিটার বা 70 Angstrom. এখনকার পরিমাপ অনুসারে পরমানুর গড় ব্যাস মোটামুটি হয় 1.8 Angstrom সেই সময়ের হিসাবে বিরাট গবেষণা বলতে হবে। মাপে ভুল থাকা এটাই বোঝায় যে এই তথ্য কোনো সর্বজ্ঞের কাছ থেকে আসেনি। মানুষের গণনাতেই বের হয়েছে। গণনায় ভুল থাকাটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল তাঁরা গাঞ্জা টেনে বসে ছিলেন না। যথেষ্ট ভালোই হিসাব একটা করেছিলেন।

এমন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দেখে বইটি নিয়ে আরো খবর নিলাম। দেখা গেল সম্রাট হর্ষবর্ধনের জীবনীকে (হর্ষচরিত)  লেখক নিজেই বায়ুপুরাণ এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। হর্ষচরিত একটি মূল্যবান ইতিহাস বলেই বর্তমান যুগের ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। অন্য সব শাস্ত্রের মধ্যে থেকে এটার কথা বলার পিছনে এটা অন্যতম কারণ। 

বইটির মধ্যে আরো একটা জিনিস পাওয়া গেল যা বৈজ্ঞানিক ছাড়া অন্যদের মাথায় আসার কথা না। 
সুতরাং ঈশ্বরদের আচরণে দোষ দেখা গেলেও তার যুক্তিযুক্ত বিচার করা ঠিক না। ......... পরীক্ষা না করে গ্রহণ, বিপর্যয় করে গ্রহণ, পূর্বশ্রুতিতে দৃঢ় বিশ্বাস, ও লৌকিক প্রবাদ ইত্যাদি কারণে জনগণ প্রকৃত তত্ব জানতে পারে না। আগে এক প্রকার বিশ্বাস করে, কালান্তরে সেই বিষয় অন্য প্রকার হতে দেখে দ্বেষবশে তা গ্রহণ করতে পারে না।
কী কী কারণে মানুষ সত্য গ্রহণ করে না তা বলা হয়েছে। সেই সাথে পরিষ্কার ভাবে ঈশ্বরদের বৈজ্ঞানিক বিচারের বাইরে রাখা হয়েছে এবং এটাও বলা হচ্ছে যে ঈশ্বর একাধিক। (৬৬ অধ্যায়)

এবারে আরো কিছু নমুনা দেখাই।

১) মহীমণ্ডলের সুমেরুর পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে দেখা যায়। কেননা চতুরস্র পরিমানকে বৃত্তাকারে ধরলে এর চার কোন থেকে কিছু পরিমাণ হ্রাস পায় বলে এর পরিমাণগত ন্যুণতা নিশ্চিত। (৬৪ অধ্যায়) (কথার ভাব থেকেই পরিষ্কার যে এটা হিসাব কষে বের করা। পৃথিবীর উত্তর মেরু যে একটু চাপা, এটা তাঁরা হিসাব করে বের করেছিলেন।

২) জ্যোতিষ্কমন্ডলী ধ্রুবেরই অধিকৃত; সূর্য এদের নিজ তেজে আবরণ করেন মাত্র। তিনিই প্রদীপ্ত কিরণ হয়ে কালাগ্নি নামে পরিচিত হন। সূর্য এইরূপ পরিবর্তনক্রমে বায়ুযুক্ত কিরণ দিয়ে দিকগুলো আলোড়িত করে জগতের জলরাশি শোষন করেন। ............ জলরাশি এভাবেই একবার ওপরে উঠে আবার মাটিতে পড়ে। কিন্তু এর নাশ হয় নাপরিবর্তনই হয়ে থাকে। (৫০ অধ্যায়)

সর্বভূতের শরীরেই জল আছে। স্থাবর জঙ্গম যখন পুড়ে যায় তখন সেই জল ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে যায়। এতেই অভ্রের (মেঘের) উৎপত্তি। সূর্যের তাপ বাতাসের সাহায্যে সর্বভূত থেকে বিশেষ করে সমুদ্র থেকে জলরাশি আকর্ষণ করে থাকে। (৫০ অধ্যায়)
(বৃষ্টিপাতের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।)

৩) মর্ত্যজনেরা আবহমান কাল অন্ন দিয়েই জীবিত থাকে। সেই অন্ন সূর্যকিরণেই পুষ্ট হয়। এই সবিতা ভ্রমণ করে রশ্মি দিয়ে জগতের জল শুষে নেন। আবার বিসর্গকালে সেই জল বর্ষণ করে চরাচরের জীবন পোষণ করেন। (৫২ অধ্যায়)

৪) আমি সূর্যের যে হাজার রশ্মির কথ বলছি তার মধ্যে সাতটি প্রধান। (৫৩ অধ্যায়)
(বলা হইল ঐ সাতটি ছাড়াও সূর্যের আরো আরো অনেক রশ্মি আছে। দৃষ্টিসীমার বাইরের রশ্মির কথাও তাঁদের জানা ছিল।)

সমস্ত দেবতারা এই সমস্ত জায়গায় প্রবেশ করে থাকেন। সমস্ত মন্বন্তরেই তাঁরা চাঁদ সূর্য গ্রহের আশ্রয়ে থেকে প্রকাশমান হন। তাঁদের সেই আশ্রয়স্থানকেই দেবগৃহ বলে। সূর্য সৌরস্থান, সোম সৌম্যস্থান, শুক্র শৌক্রস্থান, বৃহষ্পতি বৃহৎ স্থান, মঙ্গল লোহিতস্থান, এবং শনৈশ্চর শানৈশ্চরস্থান আশ্রয় করে থাকেন। সেই সমস্ত স্থান আদিত্যরশ্মি সংযোগে সুপ্রকাশ। (৫৩ অধ্যায়) (বলা হচ্ছে চাঁদ, সূর্য এবং গ্রহ গুলি সবাই সূর্যের আলোয় আলোকিত। যে কয়টা গ্রহের তাঁরা খবর জানতেন আর কি। বুধ যে দেবতাদেরও বাস করার অযোগ্য সেটাও বোঝা যায় দেবগৃহ দের মধ্যে তার নাম নাই।)
এর সাথেই আছে: 
পৃথিবীর ছায়া দিয়ে সেই মন্ডলাকৃতি রাহু নির্মিত। এর বিরাট স্থান তমোময়। রাহু পূর্ণিমা দিনে আদিত্য থেকে সোমে প্রবেশ করে এবং অমাবস্যার দিনে সোম থেকে আবার আদিত্যে প্রবেশ করে। (৫৩ অধ্যায়) (রাহু যে গ্রহণের কারণ তা সবাই জানেন। সেই সময়েই তাঁরা জানতেন যে সেইটা কোনো দানব নয়। নেহাতই পৃথিবীর ছায়া দিয়ে তৈরী।)

------------------------------------- 
------------------------------------- 
এইবারে দেখা যাক যেই ধর্মে এত্ত বিজ্ঞান আছে তার উপর ভরসা রাখা যায় কিনা। ভরসা রাখতে পারলে আর সন্দেহ না করে বাকি কথাগুলা বিশ্বাস করে নেওয়া যেতে পারে। 
এই বই থেকেই একটি উদাহরণ দিই। সব দিতে গেলে পোস্ট এর সাইজ বেড়ে যাবে। যেটা দিলাম সেইটা সব পুরাণে পাওয়া যায়।

সূর্য যখন দক্ষিণায়ন পথবর্তী হন তখন তিনি সব গ্রহের নিম্নচারী। তার উপরে বিস্তীর্ণমন্ডল চাঁদ, তার উপরে নক্ষত্রমন্ডল, তার উপরে বুধ, তার উপরে বৃহষ্পতি এবং তদূর্ধে শনৈশ্চর, তার উপরে সপ্তর্ষিমন্ডল। তার উপরে ধ্রূব। (৫৩ অধ্যায়) এছাড়া সূর্য চাঁদ গ্রহ ইত্যাদিকে দেবতা বানিয়ে তাদের ঘোড়া, রথ ইত্যাদির বর্ণনা ত আছেই। ------------------------------------ এর পরেও কি বুঝতে বাকি থাকে যে ৫৩ অধ্যায়ের এত্তগুলা বৈজ্ঞানিক তথ্য যাঁর দেওয়া তিনি এই আজগুবি কথা বলতেই পারেন না? তাহলে এমন বিটকেল কথা এইখানে এল কিভাবে? 
এল কারণ ধর্মটিতে যেমন জ্ঞানী গবেষক ছিলেন তেমনি গাঞ্জাখোর কিছু কম ছিলনা। একদিকে কিছু মানুষ খেটেখুটে সত্য আবিষ্কার করতে আর অন্যদিকে গাঁজাখোরেরা তার উপরে রঙ ফলিয়ে পন্ডিতি করত। তারা বসে বসে গাঞ্জা টেনে পৃথিবীর আর আকাশের যা ভূগোল দিয়ে গেছেন তা দেখলেই তাদের বিদ্যের দৌড় বোঝা যায়। আর সেই সাথে ধান্দাবাজ ত গুণে শেষ করা যায় না। তারা কেবল পরের পকেট সাফ করার আর মানুষকে মুরগি বানিয়ে নাচানোর বুলি ছুটিয়ে ধম্মের একেবারে চুড়ান্ত করে ছেড়েছে। তাদের আবার চেষ্টা ছিল যেভাবে হোক প্রশ্ন তোলার অধিকারটিকে হিন্দুধর্ম থেকে বাদ দেওয়ার। তাদের সফল হওয়ার মুখেই বৌদ্ধধর্ম এসে সব গোলমাল করে দেয়। এর পরে তারা ভালোমত সফল হয়েছিল মুসলমান শাষনের সময়। 

তাদের এই সফলতার ফল কি দাঁড়িয়েছিল তার উদাহরণ দিই, হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের একটি চিঠির থেকে।

“যে দেশের বড় বড় মাথাগুলো আজ দু হাজার বৎসর খালি বিচার করছে- ডান হাতে খাব, কি বাম হাতে; ডান দিক থেকে জল নেব, নাকি বাঁ দিক থেকে। এবং ফট ফট স্বাহা, ক্রাং ক্রুং হুম করে তাদের অধোগতি হবে না তো কার হবে?” 
“যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে আর দশ-বিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ তাদের রক্ত চুষে খায় আর তাদের উন্নতির কোনো চেষ্টা করেনা, সে কি দেশ না নরক?”

========================= 
========================= 
আপাততঃ এখানেই শেষ। তার আগে দুটি কথাঃ-
১) বায়ুপুরাণে পাওয়া বৈজ্ঞানিক তত্বের মধ্যে কোথাও ঈশ্বর নিয়ে কোনো যুক্তি-প্রমাণ এর কথা নেই। বরং পরিষ্কার বলা আছে যে ঈশ্বরদের (বহুবচন) যুক্তির বাইরে রাখতে। কাজেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক আলোচনা কিম্বা কোনো প্রমাণ পাওয়ার আশা নাই। 

২)যে ধর্মে ঈশ্বরের পর্যন্ত খোলা সমালোচনার অধিকার স্বীকার করা হয় সেখানেই এই রকম গাঞ্জার আর ধান্দাবাজির চাষ চললে যেখানে বিশ্বাস না করলে কল্লা নেওয়া কিম্বা জ্যান্ত পোড়ানোর ব্যবস্থা আছে সেইসব ধর্মগুলোর কি অবস্থা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন। সবই দু-আনা চার-আনা বিজ্ঞানের সাথে প্রাণ ভরে চালবাজি আর ধান্দাবাজির মিশেল ছাড়া কিছুই না। 

দু আনা বিজ্ঞান পেলে দু আনাই মানা যায়। সেইটুকু বিজ্ঞানের গন্ধ শুঁকে বাকিটা মেনে নেওয়া যায় না।

(রেফারেন্স: 
কিতাব: "বায়ুপুরাণ" বাংলা অনুবাদ।
প্রধান সম্পাদক: ডঃ গৌরীনাথ শাস্ত্রী
সম্পাদক: ডঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়
ভাষান্তর: ইন্দ্রানী চক্রবর্তী
প্রকাশ: ১৯৮৬
প্রকাশক: নবপত্র প্রকাশন। ৬ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা ৭০০০৭৩
মূল্য: ৬০ টাকা (ভারতীয় টাকায়।)

-----------------
(বাংলা অনুবাদ ভুলভাল মনে হইলে আওয়াজ দিয়েন। সব মানুষেই ভুল অনুবাদ করতে পারে। তবে কিনা ইয়াদের সব ক'টাই ব্রাহ্মণ। ভুল কম হওনেরই কথা। )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন