বৌদ্ধধর্ম নিয়ে বেহুদা রোমান্টিকতাক্রান্তদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।
লিখেছেন কৌস্তুভ
২৭৩ — কচ্ছপ-জাতক
[কোশল-রাজের দুইজন মহামাত্রের বিবাদভঞ্জন হইয়াছিল। তদুপলক্ষে শাস্তা জেতবনে অবস্থিতি-কালে এই কথা বলিয়াছিলেন। ইহার অতীত বস্তু দ্বিনিপাতে – উরগ-জাতক (১৫৪) এবং নকুল-জাতক (১৬৫) – বলা হইয়াছে।]
ইহা শুনিয়া সেই বানর বলিল,
অতঃপর বোধিসত্ত্ব কচ্ছপকে উদ্দেশ্য করিয়া তৃতীয় গাথাটি শোনাইলেন:
জাতকের ৫৪৭টি কাহিনীর মধ্যে এই একটি কাহিনী বিশেষ ‘সম্মানের’ অধিকারী। অনুবাদকালে এই একটিমাত্র গল্প ঈশানচন্দ্র (১৯২৩) বাংলার বদলে অনুবাদ করেছেন সংস্কৃতে। E. B. Cowell (১৮৯৫) জাতকের ইংরাজি অনুবাদের সময় এই একটিমাত্র কাহিনী অনুবাদ করেছেন ল্যাটিনে । ঘটনা কী? সবাই এই কাহিনীটিকে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?
কারণ, আপনারা যা অনুমান করতে পারছেন তাই-ই – এই গল্পটি কিঞ্চিৎ আদিরসাত্মক। আবার ঠিক প্রচলিত অর্থের আদিরসও নয়, তবে ‘নটি’ বলা চলে নিঃসন্দেহে।
(সম্ভবত) এটি ইংরিজিতে সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন John Garrett Jones, তাঁর জাতকের উপর Tales and Teachings of the Buddha বইটি লিখতে গিয়ে। সম্প্রতি আরেকজন ইন্টারনেটচারী বৌদ্ধ ভিক্ষু জোনসের অনুবাদের কথা না জেনে এটি তাঁর ব্লগে অনুবাদ করেছিলেন। এক হিসাবে, সেটি হয়ত ইন্টারনেটে প্রাপ্য এই কাহিনীর একমাত্র ইংরাজি অনুবাদ।
এই ইন্টারেস্টিং, মজাদার, বিনোদনী ও দুষ্টু গল্পখানা – যা আবারও প্রমাণ করে, কোনো ধর্মই বলদার্গু-মুক্ত নয় – বাঙালি পাঠকের অধরা থেকে যাবে, এটা ভাবতে খারাপ লাগল। ঈশানচন্দ্রের সময় অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত বাঙালিই সংস্কৃত জানতেন, তাই নাবালকের অবোধ্য কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কের বোধ্য সংস্কৃতে গল্পটি রেখে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সংস্কৃতের সেই সুদিন আর নেই কিনা। তবে আমি পালি-অজ্ঞ, তাই ওই দুটি ইংরাজি অনুবাদ আর সংস্কৃত অনুবাদটি মিলিয়ে এই কাহিনীর সম্ভবত প্রথম বাংলা অনুবাদটি খাড়া করলাম (অনুবাদের নিচে গল্পের বিশদ ব্যাখ্যা পাবেন)।
২৭৩ — কচ্ছপ-জাতক
[কোশল-রাজের দুইজন মহামাত্রের বিবাদভঞ্জন হইয়াছিল। তদুপলক্ষে শাস্তা জেতবনে অবস্থিতি-কালে এই কথা বলিয়াছিলেন। ইহার অতীত বস্তু দ্বিনিপাতে – উরগ-জাতক (১৫৪) এবং নকুল-জাতক (১৬৫) – বলা হইয়াছে।]
———————————————
পুরাকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁহার সময়ে বোধিসত্ত্ব কাশী রাজ্যে কোনো এক ব্রাহ্মণকূলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। বয়সপ্রাপ্ত হইলে তিনি তক্ষশীলায় গমন করিয়া বহুবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিলেন। অনন্তর বীতকাম হইয়া তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়া হিমবৎ প্রদেশে গঙ্গাতীরে এক আশ্রম নির্মাণ করিয়া তথা ধ্যানে লিপ্ত হইলেন। এই জন্মে বোধিসত্ত্ব সমুদয় জ্ঞানের মধ্যে স্থৈর্য বা উপেক্ষায় বিশেষভাবে পারদর্শী হইয়াছিলেন।
ধ্যানকালে বোধিসত্ত্ব যখন পর্ণকুটীরের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করিতেন, তখন একটি দুঃশীল, প্রগল্ভ মর্কট তথায় সমাগত হইয়া তাঁহার কর্ণকুহরে নিজ মেহন প্রবিষ্ট করাইয়া রেতঃপাত করিত। স্থৈর্যে পরম শীলিত বোধিসত্ত্ব ইহা নিবারণের জন্য কোনরূপ প্রয়াস করিতেন না।
একদা একটি কচ্ছপ জল হইতে রোদ পোহাইবার নিমিত্ত উত্থিত হইয়া গঙ্গাতটে মুখব্যাদান করিয়া নিদ্রাগত হইয়া পড়িয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া ওই লালসাগ্রস্ত বানর তাহার মুখবিবরেও মেহন প্রবেশ করাইয়া দিল। কিন্তু রেতঃ নিক্ষিপ্ত হইলে নিদ্রাভঙ্গ হওয়াতে কচ্ছপ জাগিয়া উঠিয়া সেই মেহন দংশন করিয়া বসিল। প্রবল বেদনা জাগ্রত হইলে ওই মর্কট চিন্তিত হইল, এমন কে আছেন যিনি আমাকে এই দুঃখ হইতে পরিত্রাণ করিতে পারেন, যাঁহার কাছে গিয়া আমি শান্তিলাভ করিতে পারি? এমন বিচার করিয়া সে দুই হাত দিয়ে কচ্ছপটিকে উত্তোলন করিয়া সে অবস্থায় বোধিসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হইল।
বোধিসত্ত্ব এই দুষ্ট মর্কটকে এমন পরিস্থিতিতে দেখিয়া তাহাকে পরিহাসপূর্ব্বক প্রথম গাথাটি বলিলেন:
অন্নভাণ্ড হস্তে লইয়া কোন ব্রাহ্মণ ফেরে?
ভিক্ষা পাইলে কোনোখানে? নাকি ফিরিছ শ্রাদ্ধ সেরে?
ইহা শুনিয়া সেই বানর বলিল,
মূর্খ একটি মর্কট আমি,
দয়া করি মোরে ক্ষমা কর স্বামী–
স্পর্শ-যোগ্য নয় যাহা, তাহা ছুঁইয়া করেছি ভ্রান্তি–
লভিলে মুক্তি, ফিরি পর্ব্বতে; কৃপা করি দাও শান্তি।
অতঃপর বোধিসত্ত্ব কচ্ছপকে উদ্দেশ্য করিয়া তৃতীয় গাথাটি শোনাইলেন:
কাশ্যপ-গোত্র এ কচ্ছপ, জানিও;
মর্কট গোত্রে যে কৌণ্ডিন্য;
কচ্ছপ, করহ মোচন উহাকে–
হ’ল তব মৈথুন সম্পন্ন।
বোধিসত্ত্বের বচন শুনিয়া প্রসন্ন চিত্তে কচ্ছপটি মর্কটের মেহন মুখ হইতে মুক্ত করিয়া দিল। মুক্তি পাইবামাত্র সে বানর বোধিসত্ত্বকে প্রণাম করিয়া সত্বর পলায়ন করিল; পুনর্বার ফিরিয়াও তাকাইল না। কচ্ছপও তাঁহাকে নমস্কার করিয়া যথাস্থানে গমন করিল। বোধিসত্ত্ব নির্বিঘ্নে ধ্যানে নিমজ্জিত হইয়া যথাসময় ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত করিলেন।
———————————————
[কথান্তে শাস্তা সত্যসমূহ ব্যাখ্যা করিলেন। সমবধান – এই মহামাত্রদ্বয় ছিলেন সেই কচ্ছপ ও বানর এবং আমি ছিলাম সেই তাপস।]
************************************************************
টীকা:
মহামাত্র – অমাত্য, পারিষদ
বিবাদভঞ্জন – ঝগড়া মিটমাট
শাস্তা – বুদ্ধদেব, বোধিসত্ত্ব
জেতবন – রাজা জেত এই উদ্যানটি বুদ্ধদেবের সংঘ তৈরির জন্য দান করেন। বুদ্ধদেব সেই আশ্রমে প্রায়ই অবস্থান করতেন।
দ্বিনিপাত – জাতকের যে সব গল্পে দুটো করে গাথা(কবিতা) থাকে সেগুলো দ্বিনিপাত বলে; এইটায় তিনটে গাথা আছে বলে এটা ত্রিনিপাত-এর মধ্যে পড়বে। আরো স্পষ্ট করে বললে, দ্বিনিপাত হচ্ছে দুটো গাথা-ওয়ালা সব জাতকের সংগ্রহ।
তক্ষশীলা – প্রাচীন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়
বীতকাম – কামনা-বাসনা ত্যাগ করা
প্রব্রজ্যা – সন্ন্যাস
হিমবৎ প্রদেশ – হিমালয়ের কাছাকাছি কোনো অঞ্চল
পর্ণকুটীর – পাতার কুঁড়েঘর
প্রগল্ভ – ফাজিল
মেহন – শিশ্ন
রেতঃপাত – বীর্যপাত
শীলিত – অনেক অনুশীলন/চর্চা করেছে যে
মুখব্যাদান – মুখ হাঁ করা
গাথা – কবিতা/শ্লোক
অন্নভাণ্ড – ভাতের (খাবারের) পাত্র
ব্রহ্মলোক – স্বর্গলোক, তপস্যার ফলে প্রাপ্ত পরম ধাম
সমবধান – জাতক-কাহিনীর শেষের ব্যাখ্যা, যেখানে আগের কাহিনীর সঙ্গে বর্তমানের (যার সূত্রেই ওই কাহিনী বলা শুরু) সম্পর্ক বোঝানো হয়।
************************************************************
আমার ব্যাখ্যা: উরগ-জাতকে শুরুতে যে ঘটনা বলা আছে, তা এইরকম – কোশলদেশের রাজার দুই মহামাত্র অর্থাৎ অমাত্য পরষ্পরের খুব বিদ্বেষী ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধ বুঝতে পারেন যে এঁরা দুজনেই ভবিষ্যতে পরম জ্ঞান লাভ করবেন। তখন তিনি ভিক্ষাচ্ছলে একজনের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঐ ব্যক্তিও বুদ্ধর হাত থেকে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে সমাদরে ভেতরে এনে বসালেন, সেবাযত্ন করলেন। বুদ্ধও খুশি হয়ে তাঁকে শাস্ত্রকথা শুনিয়ে পরম জ্ঞান দান করলেন। তারপর তাঁকে নিয়ে দ্বিতীয় অমাত্যের কাছে গেলেন। সেই অমাত্যও বুদ্ধকে দেখে সমাদরে প্রথম অমাত্য সহ-ই বাড়িতে এনে বসালেন। তারপর বুদ্ধ এঁকেও পরম জ্ঞান দান করলেন। তখন দুজনেই পরষ্পরের কাছে ক্ষমা চেয়ে বন্ধু হয়ে গেলেন।
জাতকের গল্পের যে ছন্দ, সেই অনুযায়ী এই গল্পেও এরপর বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলেন, যে পূর্বজন্মেও আমি এভাবে এদের বিরোধ মিটিয়েছিলাম। বলে এই কাহিনী শুরু করেন।
জাতকের এই গল্পটায় ওই দুই মহামাত্রের কচ্ছপ আর বানর হিসাবে পূর্বজন্মের কথা বলা হয়েছে। মোটামুটি মিল রাখার চেষ্টা হয়েছে, ওই অমাত্যের হাতে নেওয়া বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্রর সাথে এখানে বানরের হাতে নেওয়া ভিক্ষাপাত্র-আকারের কচ্ছপ (যেটা প্রথম কবিতাটায় উল্লেখও করা হয়েছে), ইত্যাদি। এখানে দুজনের একজন কাশ্যপ আর আরেকজন কৌণ্ডিন্য নামক গোত্রভুক্ত বলে জানানো হয়েছে, ঠিক কেন সেটা স্পষ্ট নয়। তবে যৌনক্রিয়া-প্রধান এই গল্পটায় শেষ কবিতাটায় বুদ্ধ মিলন শব্দটা একাধারে দুটো অর্থে ব্যবহার করেছেন, এক সন্ধি অর্থে, যেহেতু তিনি ওই শত্রুভাবাপন্ন দুজনের ভাব করিয়ে দিচ্ছেন, আর দুই, (বৈবাহিক) সম্পর্কস্থাপন অর্থে, যেহেতু রতি বা সঙ্গম ব্যাপারটা নিয়েই কথা হচ্ছে, এবং সেখানেই সম্ভবত গোত্রের প্রসঙ্গটা আসে, কারণ সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী এক গোত্রের মধ্যে বিয়ে হয় না।
গল্পটায় ঠিক কী ঘটছে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে কারো সমস্যা হয় নি। এবং সরল নিরক্ষর গ্রামবাসীদের ধর্মশিক্ষা দিতে এমন আদিরসাত্মক সরস গল্প মন্দও হয় না। তবে সে গল্পে বুদ্ধের নাম জড়িয়ে, পশুযোনিতে পূর্বজন্ম – বানরের যৌনব্যাভিচার – পশুদের ধর্মশিক্ষা ইত্যাদি অবান্তর কথা তাঁকে দিয়ে সিরিয়াসলি প্রচার করিয়ে, শেষমেষ রূপকথার ক্ষেত্র অতিক্রম করে এ কাহিনী একটি নিছক বলদার্গুতেই পরিণত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন