লিখেছেন হিমালয় গাঙ্গুলী
ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার সামনে খেজুর পাতার মাদুরে বসে আছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার ঘরে এ সময় বিদ্রোহী কবি কেন এলেন, কে জানে? অবশ্য আসাটা বিচিত্র কিছু না। বেশ কিছুদিন যাবত আমি আরবদের সাথে বিদ্রোহ করছি। আমার ওপর বিশেষ অনুরাগবশত তিনি যদি মেরাজ টাইপ কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ থেকে এসে হাজির হন, তাহলে আনন্দে আমার খাবি খাওয়ার কথা। আমি চোখ বুজে বিড় বিড় করে বললাম:
ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো মহান পুরুষ
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা...
বিকট গলা খাঁকারিতে আমার আবৃত্তিতে ছেদ পড়ল। চোখ বন্ধ রেখেই আমি বিনীত গলায় বললাম, "স্যারের শরীর কেমন? বোরাক এক্সপ্রেস এখন কেমন সার্ভিস দিচ্ছে? পথে কোন তকলিফ হয় নি তো?"
কবি ভরাট গলায় বললেন, "এই সব উদ্ভট কথার অর্থ কী?"
আমি বিনয়ে গলে পড়তে পড়তে বললাম, "উদ্ভট কথা বলার জন্য আমি লজ্জিত, স্যার। আপনার শরীর কেমন, জিজ্ঞাসা করা ভুল হয়েছে। আপনার স্বাস্থ্য মাশাল্লাহ খোদার খাসির মত, খারাপ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।"
কবি জবাব দিলেন না। মনে হচ্ছে কবির ভাব এসে গেছে। আমাকে উৎসর্গ করার জন্য 'মরুভাস্কর' টাইপ কোনো কবিতা-টবিতা ভাবছেন:
মহা উন্মাদ রণ ক্লান্ত
আমি সেই রাতে হবো শান্ত
যবে গনিমতে পাওয়া রমণীর দেহ
একটাও বাকি রহিবে না,
উত্থিত মোর ঈমানের পানি
এক ফোঁটা ভূমে পড়িবে না...
কবি দীর্ঘক্ষণ কিছু বললেন না। আমি পিটপিট করে তাকালাম। আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মাদুরের ওপর কবি না, বসে আছেন আমার খালাপ্রতিম স্ত্রী খাদিজা বেগম। বিরাট স্বাস্থ্য আর ঝাঁকড়া চুলের জন্য চোখে ধান্দা লেগে গিয়েছিল।
আমি মধুর গলায় বললাম, "কেমন আছো, খালা?"
এই নির্দোষ প্রশ্নের উত্তরে খাদিজা আমাকে কিছুক্ষণ অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ করল। আমি গায়ে মাখলাম না। মহাপুরুষদের এইসব সামান্য জিনিস গায়ে মাখতে হয় না।
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম।
খাদিজা বলল, "দূর হ, হারামজাদা"
আমি উদাস গলায় বললাম, "আমি হারামজাদা হওয়ার চান্স আছে। বাপ মরার পর জন্মেছি। আবদুল্লাহ সাহেব ছাড়া অন্য কেউও ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন।"
খাদিজা চোখ লাল করে বলল, "তুই মর!"
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, "আমার ইন্টিউশন বলছে, আমি মরি আর না মরি, তোমার নাতি অপঘাতে মারা যাবে।"
খাদিজা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, "খেঁতা পুড়ি তোমার ইন্টিউশনের!"
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, "আমার ইন্টিউশন কিন্তু প্রবল।"
খাদিজা হতাশ গলায় বলল, "আচ্ছা, আমার নাতি কি তোমার নাতি না?"
আমি হাসলাম। আমার সেই বিখ্যাত বিভ্রান্তিময় হাসি। যার মানে হ্যাঁ বা না দুইই হতে পারে। এই হাসিটা অবশ্য আমি ইচ্ছা করে দেই নি। নিজে যথেষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে আছি। আমার ছোট্ট বন্ধু আয়েশা এই বিভ্রান্তির উৎস। আমার ধারণা ছিল, মহাপুরুষদের জিনিসে কেউ হাত দেয় না। সেই ধারণা কঠিনভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাফোয়ান নামের এক ধড়িবাজ ছেলে আয়শার দিকে নজর দিয়েছে। আমার প্রবল ইন্টিউশন বলছে, তাদের প্রেম লদকা-লদকি পর্যায়ে চলে গেছে। এই ঘটনার পর নারী জাতির ওপর থেকে মন উঠে গেছে। সবাইকে গণহারে অবিশ্বাস করছি। অবশ্য অবিশ্বাসী হওয়া কাজের কথা না। আমার বাবা তাঁর উপদেশমালায় বলেছেন, "অবিশ্বাসীদের জন্য পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা।"
খাদিজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সে দিন-দিন কোলাব্যাঙের মত ফুলছে। রাগের কারণে তাকে আরও মোটা দেখাচ্ছে। আমি মনে মনে "অফ যা কোলাব্যাঙ" বলে লাফ দিয়ে বের হয়ে গেলাম।
মক্কার তপ্ত মরুপথে আমি হাঁটছি। আজ অনেকগুলো কাজ করতে হবে। আমি মনে মনে লিস্ট করে ফেললাম।
১. গাঞ্জাসম্রাট জিবরাইলকে খুঁজে বের করতে হবে। (তাঁর গাজায় ইদানিং ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে, কঠিন ঝাড়ি দেওয়া দরকার। চামে তাঁর ওস্তাদ ইসরাফিল খাঁ-এর সানাইও শুনে আসতে হবে।)
২. আমার পালক পুত্রের বউয়ের সাথে তার বিরাট ক্যাচাল লেগে গেছে। গিট্টু ছোটাতে হবে। (বউটা একখানা মাল, সিস্টেমে কিছু করা যায় কি না, দেখতে হবে।)
৩. সাফোয়ান হারামজাদা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
৪. চাচাজানের সাথে দেখা করতে হবে। অনেকদিন তাকে ভড়কে দেওয়া হয় না। মাঝে মাঝে ভড়কানো হার্টের জন্য ভালো।
বেশিক্ষণ হাঁটা লাগলো না। কাবা ঘরের পাশে পাবলিক টয়লেটের সামনে জিবরাইলকে পাওয়া গেল। আমাকে দেখে হাত কচলাতে কচলাতে এগিয়ে এসে বলল, “ওস্তাদ শরীর টা ভালো?”
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “হুম।"
জিব্রাইল বিনীত গলায় বলল, “ভাইজান, নতুন ব্যবসা শুরু করেছি। দি কাবা পাবলিক টয়লেট প্রাইভেট লিমিটেড। হাগা-মুতার ব্যবসা, তবে ধান্ধা খারাপ না।”
আমি আবার বললাম, “হুম।”
জিব্রাইল বিনয় আর এক ডোজ বাড়িয়ে বলল, “কিছু মনে না করলে একটা আর্জি ছিল হুজুরের কাছে।"
আমি আরও গম্ভীর গলায় বললাম, “বলো।”
জিব্রাইল থেমে থেমে বলল, “ইয়ে মানে জনাব মনে হয় অনেক দিন গোসল করেন না। গা থেকে কাঁচা গু-এর সুবাস আসছে। হুজুরের আজ্ঞা হলে সাবান ডলে একটা হেভি গোসল দিয়ে দেই?”
আমি উদাস গলায় বললাম, “দাও।”
জিব্রাইল মহা উৎসাহে আমার গায়ে সাবান ডলা শুরু করল। ঝাড়া এক ঘন্টা ডলাডলির পর সে বলল, “গোসল মাশাল্লাহ ভালো হয়েছে। শেষটায় আপনার বুকের মধ্যে জ্ঞান সঞ্চার করে দিয়েছি। বলেন সুবহানাল্লাহ।”
আমি উদাস গলায় বললাম, “ও আচ্ছা।”
জিব্রাইলের এইসব ভাঁওতাবাজি কথায় বিশ্বাস করার কিছু নেই। সারাদিন গাঁজার ওপর থাকে। কী বলতে কী বলে, কে জানে। আমি জিব্রাইলের হাতে একটা ছেঁড়া পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলাম। একটা জিনিস বাদ রয়ে গেল। ওস্তাদ ইসরাফিল খাঁ সাহেবের সানাই এর ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হল না।
পালক পুত্রের বাড়ি যাওয়ার আগে চাচাকে খেপিয়ে যাওয়া দরকার। ইদানীং উনার মদ্যপানের মাত্রা বেড়েছে। চাচার বাসার সামনে পৌঁছে আমি হাঁক দিলাম, “হক মওলা।”
চাচাকে ভড়কানো গেল না। ভেতর থেকে উনি কোমল গলায় বললেন, “কে, মুহাম্মদ? ওয়েলকাম, মাই বয়!”
আমি বিনয়ে মরে যাচ্ছি এমন একটা ভাব করে বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ, চাচা।”
চাচা লন্ডন রাম-এর বোতলে এক চুমুক দিয়ে বললেন, “হিমু, তোকে যে আমি কী পরিমাণ পছন্দ করি, তুই জানিস না।”
আমি বিড় বিড় করে বললাম, “পবিত্র গাভী।”
চাচা আমার কথায় ভ্রূক্ষেপ করলেন না। তিনি বলতে থাকলেন, “...সে তোর অনেক ছোটবেলার কথা। মুসলমানীর দিন তোর সে কী কান্না। আমি সেদিন তোর পুরুষাঙ্গ দেখেই বুঝেছিলাম, তুই এক দিন মহাপুরুষ হবি...”
আমি আর দাঁড়ালাম না। চাচার নাকের ডগা দিয়ে কেটে বেরিয়ে এলাম। নেশাগ্রস্ত মানুষের স্নেহ ভয়ংকর। হিমুদের জন্য এই জিনিস নিষিদ্ধ।
আমি যখন আমার পালক পুত্রের বাড়ির সামনে পৌঁছলাম, ততক্ষণে ঘটনা ঘটে গেছে। আমার গুণধর পুত্র তাঁর বউকে বাইন তালাক বলে ফেলেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি টাইপ। পুত্রের স্ত্রীর দিকে নজর দেওয়া জায়েজ না, কিন্তু বেগানা নারীকে চোখ দিয়ে চেটে খেয়ে ফেলাও জায়েজ। হাদিসে আছে। আমি আমার পুত্রবধূকে চোখ দিয়ে গিলে খেয়ে ফেললাম। আয়েশা-সাফোয়ানের উপাখ্যান আপাতত ধামাচাপা দিলাম। এই মুহূর্তে সুন্দরী পুত্রবধূ ছাড়া আমার মনে আর কিছু নেই। সাফোয়ানের ব্যাপারে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। জলদি করতে গেলেই বিপদ। আমার বাবা তাঁর বিখ্যাত উপদেশমালায় বলেছেন, “হে মানব সন্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।”
ভুজুংভাজুং কিছু কুরআন-হাদিস ঝেড়ে ওই রাতেই সুন্দরীকে বিয়ে করে ফেললাম। আমার বাবা তাঁর উপদেশমালায় আমাকে যত খুশি বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে গেছেন। রামচন্দ্রের মত আমি এখন পিতৃসত্য পালন করছি। পিতার আদেশ পালন করাও ঈমানের অঙ্গ।
বিবাহের সম্পূর্ণ অধিকার প্রয়োগ করে আমি পথে নেমে এলাম। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের তৃষিত জ্যোৎস্না। মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিসই তৃষ্ণার্ত। আমি তৃষ্ণার্ত, আয়েশা তৃষ্ণার্ত, সাফোয়ান তৃষ্ণার্ত। মরুভুমির বালু থেকে যুদ্ধবাজের তরবারি, কেউই তৃষ্ণার বাইরে না। সবাই তৃষ্ণা মেটানোর জন্য প্রতীক্ষা করে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একদিন তৃষ্ণা শেষ হয়। কিন্তু প্রতীক্ষা চলতেই থাকে। পরকালের প্রতীক্ষা, পুনর্জন্মের প্রতীক্ষা। এই অনিত্য জগতে একমাত্র প্রতীক্ষাই সত্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন