লিখেছেন রাশান ফুলকি
উত্তর: ভাববাদী দর্শন দিয়ে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; আজকাল যে প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ ভাববাদী দর্শনে ভাবনার মধ্য দিয়েই কারণ অনুসন্ধান করা হয়। ভাবনার পূর্বে সেই ভাবনা উদ্রেকের কারণ যে-বস্তুটি সৃষ্টি করে, তার অস্তিত্বের গুরুত্বকে স্বীকার করা হয় না। কিন্তু বিজ্ঞান একটা বস্তুবাদী জ্ঞান, যেখানে বস্তুর ক্রিয়ার কার্যকারণ হতে ভাবের আখ্যান হয় এবং পরবর্তীতে তার বিশ্লেষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে সত্যতা প্রমাণিত হয়। ধর্ম একটি ভাববাদী দর্শন, যার মুলে রয়েছে শর্তহীন বিশ্বাস। এটির ফলিত শাখা জীবনদর্শন নামে পরিচিত, যা ব্যক্তিমানুষের (অবতারগণের) অভিজ্ঞতা হতে উদ্ভুত ভাব এবং তা হতে আসা সিদ্ধান্তের ফসল। এই জীবনদর্শন আপাতদৃষ্টিতে অনেকক্ষেত্রে বস্তুবাদী মনে হলেও তা মূলত ভাববাদী বিশ্বাস হতেই উৎপন্ন। সুতরাং এগুলো বস্তুবাদী তথা বৈজ্ঞানিক চিন্তা নয়, বরং ভাববাদী বিশ্বাস হতে উদ্ভুত এবং ব্যক্ত। তাই এগুলো সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্টভাবে বলে না এবং তার কারণও বিশ্লেষণ করে না। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে যুক্তিযুক্ত এবং কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ নয়। এ কারণে তার ভুল সংশোধনও সহজ ও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়াবদ্ধ। কিন্তু ভাববাদী দর্শন ইঙ্গিতবাহী এবং প্রাথমিকভাবে শর্তহীন বিশ্বাসআক্রান্ত। এ কারণে তার পরিবর্তন সহজ নয়।
বিজ্ঞান শুরুতেই সিদ্ধান্ত টানে না। শুরুতে সন্দেহ করে, তারপর বিশ্লেষণ ও প্রমাণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসে। অতঃপর সেই কার্যকরণের প্রতি বিশ্বাস ('আস্থা' অর্থে) জন্মে, তার পূর্বে নয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় ভাববাদী দর্শনের অনেক বক্তব্যের অংশবিশেষ মিলে যেতে পারে। কিন্তু সেটা প্রমাণ করে না যে, ভাববাদ হতেই বিজ্ঞান উদ্ভুত। কারণ যে কার্যকারণ হতে ভাব উদ্ভুত, তাও পার্থিব বস্তুগত কোন ক্রিয়া নিষ্পন্ন। আবার যদি এভাবে চিন্তা করা যায় যে, বস্তুগত বিষয় হতেই কোনো ধর্মের বিভিন্ন ভাবের জন্ম হয়েছে, তবে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব মূল্যহীন হয়ে পড়বে। কারণ সৃষ্টিকর্তা একটি ভাববিশেষ, যা কোনো বস্তু হতে উদ্ভুত নয়, যুক্তি দ্বারা বিশ্লেষণযোগ্য নয় এবং এবং দর্শনেযোগ্যও নয়, কেবল অনুভবযোগ্য অর্থাৎ তিনি অসংজ্ঞায়িত। বিজ্ঞান কোনো অসংজ্ঞায়িত ভাব হতে উদ্ভুত হতে পারে না। ধর্মবিশ্বাসের মূলেই রয়েছে একটি শর্তহীন ভাবের প্রতি বিশ্বাস, যার কোনো ভিত্তি নেই। কাজেই যে জ্ঞানের ভিত্তিটির কারণ অসংজ্ঞায়িত বা অজ্ঞাত, তা বিজ্ঞানের মত বস্তুবাদী জ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব ব্যাপার।
ভাববাদী দর্শনের অনেকগুলো ত্রুটির অন্যতম একটি ত্রুটি হল, অভিজ্ঞতা অর্জন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মাঝে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি অনুপস্থিত, তা হল বিশ্লেষণ। মুলত এটিই ভাববাদ আর বস্তুবাদের মধ্যে মূল পার্থক্য। ভাববাদী দর্শনের তথা ধর্মের কোনো যুক্তিগত বা গাণিতিক প্রকাশ পাওয়া যায় না। বিশ্বাসই তার মূল ভিত্তি। মানুষভেদে বিশ্বাস ভিন্ন হতেই পারে। ভৌগলিক অবস্থান, সামাজিক প্রথা, অর্থনৈতিক অবস্থা, আবহাওয়ার প্রকৃতিসহ আরও বহুবিধ বস্তুগত কার্যকারণভেদে মানুষের বিশ্বাস ভিন্ন হয়। আর তাই একই বিষয়ের বহুবিধ ভাববাদী ব্যাখ্যা এবং তার বিরোধিতা, পুনর্ব্যাখ্যা ইত্যাদি দেখা যায়। সেই ভাবের প্রতি বিশ্বাস টলানোও কঠিন, কারণ সেই বিশ্বাস কোনো শর্তাধীন নয়, তাই সবাই আপন আপন বিশ্বাসে অটল থাকতে চায়। আর তাই এর পরিবর্তনও সম্ভব নয়, বরং পরিবর্তন করতে গেলে দেখা যায়, সমগ্র গোত্র বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের বিশ্বাস বিভিন্ন হয়। কিন্তু বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল এবং কোনো নতুন মতবাদ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে তা সকলে মেনে নিতে বাধ্য। কারন, এর বিশ্বাসের মুল ভিত্তি কোনো শর্তাধীন বিশ্বাস নয়, বরং বস্তুগত সন্দেহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপনীত সিদ্ধান্ত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভাববাদী দর্শন তথা ধর্ম কোনোমতেই বিজ্ঞানের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করে না। আর তাই বলা যায়, ভাববাদী দর্শন তথা ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞান নয়, নিছকই মানব মনের অভিজ্ঞতা ও তা প্রসূত বক্তব্য, যার মূল ভিত্তি হল অসংজ্ঞায়িত ভাববিশেষ, যা ঈশ্বর নামে পরিচিত এবং যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সেই হিসেবে ধর্মতত্ত্বও মানুষের অভিজ্ঞতা ও ভাবনাপ্রসূত ভাববাদী দর্শন, যা কোনোমতেই বিজ্ঞান নয়। তবে এর ফলিত শাখা, জীবনবিধানের অনেকাংশই যেহেতু বিভিন্ন অবতারের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ, সুতরাং তা স্বাভাবিকভাবেই বস্তুবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে ভাববাদের দ্বারা। এটা হয়েছে, কারণ ধর্মের জীবনবিধান অংশের সকল সিদ্ধান্তই বস্তুবাদী কার্যকরণের সাপেক্ষে নিতে হয়েছে। আর যে-শাস্ত্রের নাম জীবনবিধান, সেটি অবশ্যই বস্তুগত বিষয় নিয়েই আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবে, কারণ জীবনযাপনের সমস্ত বিষয়ই বস্তুগত। তথাপি এটা বিজ্ঞানময় নয়, কারণ তাদের এই বস্তুগত সিদ্ধান্তের কার্যকরণ যৌক্তিক, গাণিতিক বা ব্যবহারিক বিশ্লেষণ দ্বারা করা হয়নি, করা হয়েছে একটি অসংজ্ঞায়িত বিশ্বাসের দ্বারা, যা একটি ভাব মাত্র।
পরিশেষে প্রশ্ন উঠতে পারে, অবতারগণ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন যার বেশকিছু (লক্ষণীয়: সকল নয়) পরবর্তীতে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অবতারগণের কার্যকরণগুলোর ব্যাখ্যা হিসেবে স্রষ্টার লীলার কথা বলেন, বস্তুগত কোনো কারণের কথা বলেন না। অথচ সকল বক্তব্যের পেছনেই বস্তুগত বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে, অবস্তুগত কোনো বিশ্বাসের ভূমিকা নেই; একথা যে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই প্রমাণ করে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, বিভিন্ন বক্তব্য দাবীতে ছিল ভাব হত উদ্বুত সন্দেহ বা ধারণা মাত্র। অথচ বিজ্ঞান পরবর্তীতে প্রমাণ করে যে, সেগুলো দৈনন্দিন বস্তগত কার্যকরণ দ্বারাই উদ্ভুত হয়েছিল যার মধ্যে ভুল ধারণা এবং সঠিক ধারণা উভয়েই সমান্তরালভাবে বিরাজ করেছিল। এগুলোর বেশীরভাগেরই সত্যতা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়নি এবং যে সমস্ত সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোর মূল কারন বস্তুগত; কোনো ঐশ্বরিক লীলার ফল নয়। তাই বলা যায়, ধর্মতত্ব কোনোভাবেই বিজ্ঞানময় নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন