লিখেছেন আসিফ মহিউদ্দীন
আমরা যখন আইনস্টাইনের কথা বলি, তখন সব সময়ই বলি, আইনস্টাইন একজন জার্মান বিজ্ঞানী, বা পরবর্তী সময়ে আমেরিকান। বা ধরুন, নিউটন-ডারউইন একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, নীটশে-মার্ক্স জার্মান দার্শনিক, রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সাহিত্যিক, শেক্সপিয়র ইংরেজ সাহিত্যিক।
আমি কখনও কাউকে দাবি করতে শুনিনি, আইনস্টাইন একজন ইহুদী বিজ্ঞানী, নিউটন-ডারউইন খ্রিষ্টান বিজ্ঞানী, শেক্সপিয়র খ্রিষ্টান সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু একটা বিশেষ ধরনের হিপোক্রেসী মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রায়শই দেখা যায়, যেটা হচ্ছে, তারা কোনো বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিকের নাম বলার সময় আরব দার্শনিক বা পারস্যের বিজ্ঞানী না বলে তাদেরকে 'মুসলিম' দার্শনিক বা বিজ্ঞানী বানিয়ে ফেলে! তাদের ধর্মপরিচয়টা কীভাবে যেন শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে!
মুসলিম জাতি বস্তুতপক্ষেই একটি হীনমন্য সম্প্রদায়। সত্যিকার অর্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিপুল জনসংখ্যার এই সম্প্রদায়টির ভূমিকা অত্যন্ত অল্প। দিনরাত হুর-গেলমান আর বেহেশত নামক অশ্লীল বেশ্যাপল্লী আর শুঁড়িখানার স্বপ্নে বিভোর, যৌনসুড়সুড়িমার্কা কামনা-বাসনায় দিনে পাঁচবার মাথা মাটিতে ঠোকা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থা তারা নিজেরাও জানে। এই হীনমন্যতাই তাদের তাড়িত করে নীল আর্মস্ট্রং থেকে শুরু করে নানান তারকাকে টানাহ্যাঁচড়া করে মুসলিম বানাবার, কালের কন্ঠের মত পত্রিকায় হাস্যকর সব নিউজ ছাপাবার, যেখানে দেখা যায়, বিভিন্ন বিজ্ঞানী ইসলাম গ্রহণ করে নূরের পথে আসছেন! নাসায় কোরান নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, কোরানে বিজ্ঞান খুঁজে পেয়ে বিজ্ঞানীরা তা নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে এবং মাথামোটা উটপাখি মুমিনগন সেগুলো পড়ে মাশাল্লাহ ছোভানাল্লাহও বলে। এই এরাই একটা শব্দ বারবার ব্যবহার করে, সেটা হচ্ছে মুসলিম বিজ্ঞানী, মুসলিম দার্শনিক, মুসলিম সাহিত্যিক!!! যেখানে অন্য কোনো ধর্মগোষ্ঠী কখনই দর্শন-বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তাদের নামের আগায় তাদের ধর্মের নাম জুড়ে দেয় না। কেমন হতো, যদি বলা হতো হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর??? সেটা না বলে বলা হচ্ছে বিশ্বকবি, যেখানে খুব সচেতনভাবেই মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দার্শনিক বিজ্ঞানীর নাম বললেই তার আগে মুমিনগন মুসলিম শব্দটা জুড়ে দেবেই!
পৃথিবীর ইহুদী বিজ্ঞানী (ইহুদী বিজ্ঞানী কথাটা যদিও আপত্তিকর, তুলনীয় বলেই ব্যবহার করালাম, যদিও সেই সকল বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন) এই পর্যন্ত নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন সর্বমোট সেটা ৩০০-এর কাছাকাছি হবে সম্ভবত। সেই ইহুদী জনসংখ্যার একশগুণ বেশি মুসলিম পৃথিবীতে রয়েছে, সেখানে মুসলিমদের নোবেল পাবার হার দেখলে একেবারেই হাসি পায়। তিনটা না জানি চারটা, ঠিক খেয়াল নাই। হাস্যকর ব্যাপার!!!
হীনমন্যতাবোধ মানুষকে অতীতমুখী করে। তাদের কোন এক পূর্বপুরুষ কোন এক কালে ঘি খেয়েছিল, হাতে সেই গন্ধ শুঁকে তারা এক ধরনের সুখ পেতে চেষ্টা করে। মুসলিম সম্প্রদায়ও সেই কাজটাই করে। বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষের দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা কী করেছেন, তার চাইতে বেশি মাতোয়ারা হন আরবের 'মুসলিম' কোন বিজ্ঞানী মধ্যযুগে কী কী করেছেন তা নিয়ে। যেখানে এই ভারতবর্ষে শূন্য আবিষ্কারের মত বিশাল ব্যাপার ঘটেছিল, গৌতম বুদ্ধ সেই আমলে আধুনিক বস্তুবাদ, সংশয়বাদের মূল কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কেনই বা থাকবে? তারা স্বদেশে প্রবাসী জীবনযাপন করে, দেশের সবুজ ছায়ায় বসে আরব-ইরানের স্বপ্নে বিভোর হয়। এই দেশ তাদের কাছে মুখ্য নয়, তারা এই দেশকে আপন ভাবে না। তারা আগে মুসলমান, পরে বাঙালি!!! তারা মনের সুখে গান গেয়ে ওঠে, "মনে বড় আশা ছেল যামু মদিনায় য়াঁয়াঁয়াঁয়াঁয়াঁ"
জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য প্রভৃতি কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন নয়। একই সাথে, ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ কখনোই জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে একটা সময় চমৎকার জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিল। তাঁরা গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শনসহ নানান দর্শন গ্রহণ করে, তা চর্চার মাধ্যমে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ের খলিফাদের চোখে ধীরে ধীরে তাঁরা পরিণত হন কাফের-নাস্তিক-মুরতাদে। তারা সেই সকল জ্ঞানীদের ক্রমশ হত্যা করে আরেক অন্ধকার যুগের সূচনা করে, যেটা এখন পর্যন্ত চলছে। যদিও বর্তমান সময়ে সেই সকল কাফের-নাস্তিক-মুরতাদ জ্ঞানীদের ছাড়া ইসলামিস্টদের গর্ব করার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই সময়ের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধাচরণ করা কাফেররা হয়ে উঠেছেন আধুনিক ইসলামিস্টের ইসলামের স্বর্ণযুগের এবং খিলাফতের স্বপ্নদোষ।
সেই সময়েই দার্শনিক আল কিন্দিকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে শাস্তি দেয়া হয়। সক্রেটিসের মত ইবনে বাজাকেও হত্যা করা হয়েছে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে, স্বাধীন মতবাদ এবং মুক্তচিন্তার অপরাধে, প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে। তিনি বলেছিলেন, "খাঁটি দর্শনের সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য হতে পারে না"; ইবনে রুশদকে কাফের এবং নাস্তিক খেতাব দেয়া হয়, নির্যাতন করা হয় নির্মমভাবে। ইবনে সিনা থেকে শুরু করে আল আল-রাজী সকলের বিরুদ্ধেই নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। আল রাজি সে সময়ে রচনা করেন কয়েকটি বই, যেগুলো হচ্ছে:
১. The Prophets' Fraudulent Tricks - ‘নবীর ভণ্ড চাতুরি’
২. The Stratagems of Those Who Claim to Be Prophets - ‘নবীর দাবিওয়ালাদের ছলচাতুরি
৩. On the Refutation of Revealed Religions ‘প্রত্যাদিস্ট ধর্মসমূহ খণ্ডন প্রসঙ্গে’
দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকদের সে সময় এই মুসলিম ধর্মান্ধরাই হত্যা করেছিল, নির্যাতন করেছিল। প্রায় প্রতিটি জ্ঞানী লোক নির্যাতিত হয়েছেন মুসলিম ধর্মান্ধদের দ্বারা। ওমর খৈয়াম, আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এসে তারাই আবার সেই কাফেরদের কৃতিত্বের ভাগ বসাতে ছুটে আসে। কী হাস্যকর এদের হিপোক্রেসী।
শুধু মুসলিমদের ভেতরে নয়, পরবর্তীতে সময়ে ইউরোপে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। চার্চ ক্রমশ জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। কোনোকিছুকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রচারের জন্য চার্চ এবং বাইবেলে কী লেখা আছে, তার সাথে মিলিয়ে নেয়া শুরু হয়, যার ফলশ্রুতিতে ব্রুনো, গ্যালিলিও, কোপারনিকাসদের নির্যাতিত হতে হয়।
এই হিপোক্রেসীর অবসান যতদিন না হবে, ততদিন মুসলিমদের অতীতের স্বর্ণযুগের স্বপ্নেই বিভোর থাকতে হবে, নতুবা বেহেশতের হুর-গেলমানদের কথা ভেবেই উত্তেজিত হতে হবে। সময় হয়েছে সত্যের মুখোমুখি হবার, উটপাখির মত মাটিতে মুখ গুঁজে যদি তারা ভাবে, কেউ তাদের দেখছে না, তাতে সমস্যার সমাধান হয় না। বিজ্ঞানের ঠ্যাকা নাই কোরানে-বাইবেলে-গীতায় কি লেখা আছে তা দেখার। বিজ্ঞান নিজের পথেই চলবে, যুক্তি নিজের পথেই চলবে। কোরান-বাইবেলেরই নানা সময়ে অনুবাদ পালটে, আয়াত পালটে, শব্দার্থ পালটে বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করতে হবে, নিজেদের লজ্জা ঢাকতে হবে। নতুবা আধুনিক বিশ্ব তাদের নিয়ে হাসাহাসিই করে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন