লিখেছেন অর্ণব
যদিও আমি গ্রামের ছেলে নই, তথাপিও গ্রাম সম্পর্কে আমার রয়েছে একটি বিশেষ ফ্যাসিনেশন। বাংলাদেশে থাকাকালীন বছরের অন্তত চার-পাঁচদিন গ্রামে থাকা হতো আমার, বিশেষত স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে। ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন গ্রামে পার করা কয়েকটি দিনের ছুটি আমার জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। গ্রামের সকল ঘরেই মুরগী-গরু-ছাগল থেকে থাকে, আমাদেরও ছিল। সেইসময় একটি গাভী বাচ্চা দেয়। বাচ্চাটির বয়স একমাসও হয়নি সম্ভবত। সকল ম্যামাল শিশুই খুবই খুবই সুন্দর; নির্দোষ অভিব্যক্তি, কৌতূহলী চোখ আর অপেক্ষাকৃত বৃহৎ হেড টু বডি রেইশিয়ো প্রায় প্রত্যেকটি ম্যামাল শিশুকেই মানুষের কাছে করেছে মোটামুটি আদরণীয়।
সেই বাছুরটিও এর ব্যতিক্রম ছিলো না, ধবধবে সাদা শরীর আর কুচকুচে কালো ক্ষুর, আর ইভেন টোঅড ওঙ্গুলেটসদের চোখ হয় খুবই মায়াকাড়া, এটা কে না জানে! ইন ফ্যাক্ট কবি সাহিত্যিকেরা সুন্দর চোখকে নাকি হরিণের চোখের সাথেই তুলনা করে! বাছুরটির বেশিরভাগ সময়ই কাটতো দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি করে, মায়ের কাছেই থাকতো বেশি; আর মা-টিও ছিলো খুবই ডিফেন্সিভ ও অ্যাগ্রেসিভ - অন্যান্য আর সকল গর্ভবতী বা সদ্য সন্তান জন্মদানকারী ম্যামাল মায়ের মতোই। আমি বাছুরটিকে একদিন অ্যাপ্রোচ করি, তাকে দেখে আমার ইচ্ছা করেছিলো শরীরে হাত বোলাতে। দিন দুয়েকের মধ্যেই সেটা আমার বেশ পোষ মানে, আমাকে দেখে আর আগেরমতো দৌড়ে পালিয়ে যেতো না, বরং কাছাকাছি আসতো। শরীরে হাত বোলালে চোখ বন্ধ করে দিতো। প্যাটিং ক্রেইভও করতো গলা উঁচু করে। তার মুখাবয়বে ছিলো সুস্পষ্ট প্রকাশ যে, সে এইটা এনজয় করছে। সকল ম্যামালই সঙ্গ এনজয় করে রিলায়েবল কোম্পানী হতে। বাছুরের মা-টিও কিছুদিন পর আমি তাদের অ্যাপ্রোচ করলে আর আমার দিকে তেড়ে আসতো না; আমি সমর্থ হয়েছিলাম তাদের ট্রাস্ট অর্জন করতে।
আমার খুবই ভালো লাগতো বাছুরটির সাথে সময় কাটাতে, আমিও তার সঙ্গ উপভোগ করতাম, আমাদের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিলো একটি সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ-সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। তার মনোভাব আমি স্পষ্টতই বুঝতে পারতাম, হয়তো সেও পারতো আমার মনোভাব। আমার জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো, কেন আমরা দুটি প্রজাতি এতো একইরকম, কতোটা সিমিলার আমাদের আবেগ, আমাদের অ্যাপ্রোচ, আমাদের আচরণ, অনুভূতি? তখনও আমি জানতাম না যে, এই সাদৃশ্য বাস্তবতা লিখে দিয়েছে আমাদের কোষে কোষে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়োটাইডের অক্ষরে, বেঁধে দিয়েছে আমাদের অলঙ্ঘণীয় আত্নীয়তার সূত্রে।
আমার খুবই ভালো লাগতো বাছুরটির সাথে সময় কাটাতে, আমিও তার সঙ্গ উপভোগ করতাম, আমাদের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিলো একটি সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ-সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। তার মনোভাব আমি স্পষ্টতই বুঝতে পারতাম, হয়তো সেও পারতো আমার মনোভাব। আমার জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো, কেন আমরা দুটি প্রজাতি এতো একইরকম, কতোটা সিমিলার আমাদের আবেগ, আমাদের অ্যাপ্রোচ, আমাদের আচরণ, অনুভূতি? তখনও আমি জানতাম না যে, এই সাদৃশ্য বাস্তবতা লিখে দিয়েছে আমাদের কোষে কোষে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়োটাইডের অক্ষরে, বেঁধে দিয়েছে আমাদের অলঙ্ঘণীয় আত্নীয়তার সূত্রে।
ছুটি শেষ হলে আমি চলে আসি, বাছুরটির কথাও ভুলে যাই। আরও পরে আবার গ্রামে গিয়ে দেখি, সেটি অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে, আগের মতো অ্যাডোরেবল শিশু আর নেই, ফলশ্রুতিতে তার প্রতি ইন্টারেস্টও আমার হারিয়ে যায়। কী পরিণতি হয়েছিলো তার? হয়তোবা জবাই হয়ে গিয়েছিলো কোনো এক কোরবানী ঈদে, শ্বাসনালী আর খাদ্যনালী কেটে হত্যা করা হয় তাকে রান্না করা হয়েছিল। আফটার অল কেটল তো আমরা রেইস করি মাংসের জন্যই, নারী হলে যতোদিন পারা যায় দুধ আদায় করি, অতঃপর জবাই করে পরিণত করি মাংসে। যদিও কোনো প্রকার রিসার্ভেশন ছাড়াই আমি কাটাচামচে কেটে মুখে পুড়েছি রম্প স্টেইক বহুবার, তথাপিও বড় হয়ে এই অনুধাবনটা কেন যেন আমাকে হতাশ বোধ করাতো, হেল্পলেস বোধ করাতো। তবে এটা মেনে নিয়েছি যে, এটাই বাস্তবতা, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য বধ করতে হবে অন্য প্রজাতি, যে প্রজাতি কিনা আমাদের খুবই খুবই নিকটাত্মীয়, কতোটা নিকটাত্মীয় যে, এরা এটা অনুধাবন করলে অন্তত এক নিমিষের জন্য হলেও শিউরে ওঠাটা আমাদের পক্ষে অলঙ্ঘণীয়।
কোরবানীর বিরোধিতা আমি করি এই কারণেই যে, অত্যাবশ্যকীয় হত্যাকে একটি উৎসবে রূপদান করে এই শিউরে উঠাটার গলাই চেপে ধরে প্রস্তরযুগীয় নিম্নজীবী মানুষের রিটার্ডেড মূল্যবোধ। আমি কি এই আচারটির বিরোধিতা করি যে, খাদ্যের জন্য আমাদের হত্যা করতে হচ্ছে? উত্তর হচ্ছে - না, আমি বরং বিরোধিতা করি এই প্র্যাকটিসটার কথা চিন্তা করে শিউরে ওঠা ও উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠার অতি স্বাভাবিক একটি মানবিক রেসপন্সকে ধ্বংস করার আচারটির।
কী হয় কোরবানীর ইদে? বিজাতীয় ভাষায় মন্ত্র পাঠ করতে মানুষ মানুষ নামায পড়তে যায়, নামায পড়ে এসে হাসিমুখে হাতে ছুরি তুলে নিয়ে প্রবৃত্ত হয় হত্যার উৎসবে। একটি ফেলো ম্যামালের সামনে হত্যা করা হয় আরেকটিকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে একটি গরু আরেকটি গরুর মৃত্যু ও অপেক্ষা করে নিজের টার্নের জন্য। আর বাচ্চারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, প্রেমিক-প্রেমিকা সাজগোজ করে যায় প্রমোদভ্রমনে যখন কিনা শহরের রাস্তা রঞ্জিত রক্তে, মানুষের রক্তের মতোই লাল যেই রক্তের রঙ; বাতাস ভরে ওঠে যন্ত্রনা আর আর্তনাদে, আর্ত মানুষের চিৎকারের সাথে যার কিনা ভয়াবহ ও ভীতিকর সাদৃশ্য। আমি পরাজিত বোধ করি, যখন কিনা দেখি যে, এই দৃশ্য যারা দেখে তাদের কারোরই মুখে অভিব্যক্তিতে আসছে না কোনো পরিবর্তন, মিইয়ে যাচ্ছে না তাদের মুখের হাসি একফোঁটাও। এটাই কি কারণ যে, মুসলমানচিত্তে মনুষ্যত্ববোধ ও ইমোশোনাল সেন্সিটিভিটি সাধারণত হয়ে থাকে প্রায় অনুপস্থিতই? কে জানে? এটাই কি কারণ যে, চোর ধরা পড়লে তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলতে কোন সমস্যাই হয় না? সমস্যা হয় না আরেকজনের গলায়ও ছুরি চালাতে?
মানুষের মনকে করাপ্ট করা খুবই সোজা, মনকে ডিসেন্সিটাইজ করার মাধ্যমে। এবং মনকে করাপ্ট করতে পারলে করাপ্ট করা সম্ভব সকলকিছুই। এবং করাপ্ট জাতি কখনই কিছু করতে পারে নাই। মুসলমানরাও এ পর্যন্ত খুব বেশি একটা কিছু করতে সমর্থ হয়নি, সুপিরিয়র জাতির লাথি-গুঁতো খেয়ে সেগুলো হজম করতেই ব্যয় হয়েছে তাদের পাকস্থলীর সকল পাকশক্তি। বাচ্চারদের প্রত্যক্ষ করতে দিলে জীবন্তের আর্তনাদ, এটার ওপর আরোপ করলে একটি সুপারফিশিয়াল মহত্ববোধ, এটাকে ত্যাগ উৎসর্গ প্রভৃতি হাস্যকর জাইঙ্গা-ফোলানো নাম দিলে এবং দাবী করলে যে, এ কাজটি করলে পরে মহাকাশে একজন সর্বশক্তিমান স্কাইড্যাডি আছে, সে খুব খুশি হতে যাচ্ছে - অনেক বড়ো পরাজয় মেনে নেওয়া হয়।
গতবছর সংবাদে দেখেছিলাম কোরবানী দেখে এক শিশু আত্মহত্যা করেছিলো। আমি শিশুবয়সে কোরবানী দেখে বমি করেছিলাম একবার। বস্তুত সেই সময় থেকেই আমি সর্বপ্রথম ভাবতে শুরু করি যে, হাও এবাউট মানুষের ধর্ম, ধার্মিকতা, ভূত-ফেরেস্তা-পরজীবন-হাশর-নশর ইত্যাদি কমপ্লিট বুলশীট? পরবর্তী কোরবানী আমি ক্লাস টেনে ওঠার আগে দেখিনি।
যাই হোক, ভালো লাগল দেখে যে, বাংলা ইন্টারনেটে এই প্রস্তরযুগীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকাচারের বিরুদ্ধে স্ট্রং ভয়েস আবির্ভূত হয়েছে। এই ভয়েস ছড়িয়ে দিতে পারলে আমি নিশ্চিত আমাদের জীবদ্দশাতেই আমাদেরকে আর বছরের একটি দিনে রক্তাক্ত রাস্তা, রক্তাক্ত শহর দেখতে হবে না। আফটার অল নিম্নজীবী মূল্যবোধকে আমরা যদি আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে না জানি, কীভাবে আমরা সামনে এগুনোর স্বপ্ন দেখতে পারি, প্রভাইডেড দ্যাট সামনে এগুতে হলে অনেক কিছুই ছুঁড়ে ফেলতে জানতে হয়??
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন