রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

জেহাদ প্রসঙ্গে

লিখেছেন মহসিনা খাতুন 

কিন্তু জিহাদ সম্পর্কে নতুন আর কী বলার থাকতে পারে, তাই ভাবছেন? ভাবছেন, যে বিষয় নিয়ে সারা বিশ্বে এত চর্চা, সেই প্রসঙ্গে চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কি হতে পারে? আসলে আমার মনে হয়, জেহাদ শব্দটি নিয়ে খানিকটা ধোঁয়াশা তো রয়েছেই। ধোঁয়াশা এই কারণে যে, এই শব্দটির এক রকম ব্যাখ্যা জঙ্গি মুসলিম, অমুসলিম এবং সেক্যুলারিস্টরা করে তো অন্যরকম ব্যাখ্যা করে উদারপন্থী মুসলিমরা। তাই কিছু বলার আগে আমরা জেহাদ শব্দটির অর্থ নিয়ে একটু আলোচনা করে নেব। ‘জেহাদ’ শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ “জাহাদাহ্‌” থেকে , যার অর্থ উদ্যমী হওয়া। জেহাদ শব্দটির অর্থ হল - অসৎ-এর বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করা। এই যুদ্ধ হল আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। 

এতদূর পর্যন্ত দুই পক্ষেরই কোনও সমস্যা নেই। উভয়পক্ষই মেনে নেয় জেহাদের এই অর্থ। কিন্তু এরপরই শুরু হয় যত গোলযোগ, যত মতান্তর। জঙ্গি মুসলিম,অমুসলিম এবং সেক্যুলারিস্টরা মনে করে, ইসলাম অনুযায়ী ‘অসৎ’ হল অমুসলিম এবং ইসলাম বিরোধীরা। তা সে যে-ই হোক, যেমনই হোক। যতক্ষণ অমুসলিম ও ইসলাম বিরোধী মানুষরা থাকবে, ততক্ষণই ইসলামের বিপদ। যতক্ষণ না ইসলাম সারা বিশ্বে প্রসারিত হচ্ছে, ততক্ষণ এদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যেতে হবে সংগ্রাম। আধুনিক জঙ্গিবাদী মুসলিমরাও এ কথাই মানে। সমসাময়িক কালে গ্রেফতার হওয়ার পর কাসাব নামক জঙ্গির জবানবন্দী এ কথাই প্রমাণ করে। এ কথা নাস্তিক, খ্রিস্টান ও হিন্দুসহ ইসলামত্যাগী মানুষেরাও বোঝে। কিন্তু উদারপন্থী সাধারণ মুসলিমরা মনে করে যে, মনের মধ্যেকার অসৎ প্রবৃত্তিকে ধ্বংস করতে সংগ্রামই আসলে আল্লাহর পথে সংগ্রাম। ইসলাম- ও মুসলিমবিরোধীরা ইসলামকে কলঙ্কিত করতে জেহাদের অর্থের অপব্যাখ্যা করে, তেমনি অমুসলিমরা এই ব্যাপারটাকে না বুঝে তাদের ফাঁদে পা দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরস্প বিরোধী দুটি অর্থের মধ্যে কোনটি ঠিক? জেহাদ শব্দটির সঠিক অর্থ সম্পর্কে কাদের বক্তব্য আমরা মেনে নেব? 

আসলে, কিছু মানুষ মিথ্যা প্রচার ও ব্যাখ্যা করে জেহাদ সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণাকে গুলিয়ে দিচ্ছে খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। যেমন, জাকির নায়েকের মতে, “যদি কোনও চাকুরীজীবী মনিবকে খুশি করার জন্য চেষ্টা করে, পরিশ্রম করে, তা সে ভাল কাজ দিয়েই হোক বা খারাপ কাজ দিয়েই হোক, তা হলেই তা জেহাদ।” আচ্ছা, জাকির নায়েকের দেওয়া অর্থে কোরআনে বা হাদিসে কোথাও জেহাদের উল্লেখ আছে? নেই। বাস্তবে, সংগ্রাম বা লড়াই করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন একটি প্রতিপক্ষ। কিন্তু জাকিরের এই উদাহরণে কোন প্রতিপক্ষ নেই। সুতরাং তাকে লড়াই বলা যায় না। তাই তাকে জেহাদও আখ্যায়িত করা যায় না। 

তাহলে বোঝা গেলো যে, একটি স্পষ্ট প্রতিপক্ষ ছাড়া জেহাদ সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, জেহাদের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ কে? উত্তরে বলা যায়, বিধর্মীরা আর ইসলাম বিরোধীরা। ডঃ ওসমান গনী সাহেব-এর মহানবী গ্রন্থেও একটি অধ্যায় আছে: ‘মহানবী তার জীবনে কতগুলি জেহাদ পরিচালনা করেছেন?’ পরিষ্কার বোঝানো আছে যে, জেহাদ হল আল্লাহ্‌-র পথে (ইসলাম প্রসারের জন্য) বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। জাকিরের “সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদ” বইটিতে উপরিউক্ত উদাহরণটি দেওয়ার পরে পুরো বইটি জুড়েই যুদ্ধের কথা বলা আছে। অর্থাৎ তিনি পরোক্ষভাবে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে জেহাদের অর্থ আল্লাহর পথে সংগ্রাম। কোরআনেও দেখা যায় জিহাদ শব্দটি পারিভাষিক অর্থে গৃহীত, যার অর্থ হল ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর পথে সংগ্রাম। এবং কোরআনে এই কথা উল্লিখিত আছে:
“হে নবী! কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জেহাদ করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হন তাদের ঠিকানা জাহান্নাম”। (আত তাহরিম: ৯) 
“অবিশ্বাসীগণ ( কোরআন আল্লাহ্‌ ও নবীতে) তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”! ( নিসা: ১১১) 
“তোমরা ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না আল্লাহ-র ধর্ম সামগ্রিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়”। (আনফাল: ৩৮) 
এই বক্তব্য তো স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। তাহলে উদারপন্থীদের মনে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ার কারণ কী? আসলে হজরত মোহাম্মদ যে জেহাদ তত্ত্ব চালু করে গিয়েছিলেন, তা সারা বিশ্বে স্থায়ী অশান্তি তৈরি করেছে। মুহম্মদের পরবর্তী সময়ে ইসলামী বাহিনী যখন পারস্য বিজয় করে, তখন পারস্যের বহু পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়। এবং প্রায় দু'শো বছর আরবের সরাসরি অধীনে থাকে। কিন্তু নবম শতাব্দীর শেষের দিকে আরব পারস্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ততদিনে প্রায় সকল পার্সি ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছে। এরা কোনোদিনই ইসলামের মূল ধারার সাথে পুরো একমত হতে পারেনি। একটু স্বাধীনতা পেয়েই তারা ইসলাম নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও গ্রন্থ লেখা শুরু করে। এরা জেহাদ তত্ত্বের ভয়াবহতা দেখে ইসলামের জেহাদ-তত্ত্বকে আপাদমস্তক পাল্টে তার আধ্যাত্মিক রূপদানের চেষ্টা করে। ‘চলিত ইসলামী শব্দকোষ’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, “মোহম্মদ পরবর্তী সময়ে জেহাদের ভয়ানক অপব্যবহার দেখে উদার মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক এবং পণ্ডিতরা নবম এবং দশম শতকে জেহাদের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেন। তারা বলেন, আল্লাহর সঠিক পথের অন্বেষণে ব্যক্তির আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টাই জেহাদ।’’ 

এইসব উদারপন্থী ও মরমিয়া সাধকদের মতে, জেহাদ দুই প্রকার। বড় জেহাদ আর ছোট জেহাদ। ভেতরের শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে আল্লাহর পথে আধ্যাত্মিক লড়াই হল বড় জেহাদ। অন্যদিকে অস্ত্র হাতে বাইরের যুদ্ধ হল ছোট জেহাদ। “তবে এ সবই মোহম্মদ পরবর্তী যুগের ভাবনা-চিন্তা। কারণ কোরআন বা হাদিসে এর কোনও অনুমোদন মেলে না।” 

পরবর্তী কালে সূফীদের হাতে পড়ে জেহাদ তত্ত্ব আরও ব্যাপক রূপ পায়। সূফী সন্তরা পাঁচপ্রকার জেহাদের কথা বলেন: 

১. আত্মার জেহাদ: মনের ভিতরের রিপু রূপ শয়তানকে ধ্বংস করা অন্তরের সংগ্রাম ‘তৌহিদ’-এর মাধ্যমে। 

২. বাচনিক জেহাদ: খুতবা, জলসা ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক শত্রু ও শয়তানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। 

৩. কলমের জেহাদ: ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ইজতিহাদ বা ইসলামী জ্ঞানের চর্চা এবং প্রচারের মাধ্যমে সংগ্রাম করা। 

৪. হাতের জেহাদ: নিজের অর্জিত সম্পদের মাধ্যমে অর্থাৎ আপন অর্থ ও অন্য সম্পদ দানের মাধ্যমে ইসলাম প্রসারের কাজে অন্য মুজাহিদদের সাহায্য করা। 

৫. তলোয়ারের মাধ্যমে: অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারা ইসলামবিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। 

এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম প্রকারের জেহাদ বর্তমান বিশ্বের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী ধনী দেশগুলি থেকে জেহাদের উদ্দেশ্যে অর্থ সরবরাহ হচ্ছে দরিদ্র মুসলিম দেশগুলিতে। উদ্দেশ্য হল - অমুসলিমদের ইসলামে নিয়ে আসা। এবং কোনও মিশনারি কাজের মাধ্যমে নয়, বরং কোরআনের ভাষায় “তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করে।” অর্থাৎ আতঙ্কের মাধ্যমে। কোনও সন্দেহ নেই যে, এটাই জেহাদের প্রকৃত অর্থ। 

বর্তমানের উদার এবং শিক্ষিত মুসলিম-বিশ্বের মানুষের কাছে জিহাদ একই সাথে আতঙ্ক, লজ্জা ও আশার নাম। তারা বোঝে যে, এই জগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বড় সংগ্রাম; তারা বোঝে, বর্তমানে কোরআন আওড়ানোর চেয়ে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন পড়া কাজের। তারা কোরআন হাদিসকে শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থের বেশি আর কিছু বলে মনে করে না। এইসব নামেমাত্র মুসলিমরা দিনরাত দেখে যে, জেহাদ কীভাবে বর্তমান বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এমনকি মুসলিম দেশগুলিও সন্ত্রাসের বাইরে থাকছে না। বিভিন্ন ইসলামী গোষ্ঠীর প্রত্যেকটিই মনে করছে, অপর গোষ্ঠী হল তাদের ইসলামের বিরোধী। ফলস্বরূপ একে অপরের ওপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এবং প্রাণহানী। ভাবতে পারেন, বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ধ্বংসের পর থেকে আজ পর্যন্ত কুড়ি হাজারের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছে! হতাহতের সংখ্যা বেশ কয়েক লক্ষ। অমুসলিমরা তো এর শিকার হচ্ছেই, মুসলিমরা শিকার হচ্ছে আরও বেশি। কী মনে হয়, এরা মনে মনে উপলব্ধি করতে পারে না সত্যিটা? পারে। 

এর ওপর অন্যধর্মী মানুষদের সাথে তাদের একত্র থাকতে হয়। তাদের মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার লেশমাত্র না থাকলেও রোজকার জেহাদি কার্যকলাপ তাদের প্রতিনিয়ত অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে ফেলে। রোজ একটা বোমা বিস্ফোরণ হয় কোথাও না কোথাও, আর রোজ অন্যের সন্দেহ ও ঘৃণার পাত্র হতে হয় সাধারণ মুসলিমকে, সারা বিশ্বজুড়ে। কী করতে পারে তারা? না পারে নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে, যে ধর্মীয় সংস্কৃতিতে তারা জন্মেছে, বড় হয়েছে, যাকে পবিত্র বলে এতদিন মেনে এসেছে, যাকে খারাপ বললে তাদের বুকে আঘাত লাগে; না পারে ইসলামের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা-হীন কদর্যতাকে বিনা বিচারে সমর্থন করতে, যার প্রায়োগিক রূপ পৃথিবীকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে ইসলামের জন্মের সময় থেকেই। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন খুব স্পষ্ট ভাবেই দেখিয়েছে যে, উদ্বেগ এবং হতাশায় পরিপূর্ণ স্বাধীন জীবনই মানুষের যথার্থ অস্তিত্বকে সূচিত করে। কিন্তু বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা যেহেতু মানুষের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দেয় ,তাই উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে অধিকাংশ মানুষই আশ্রয় নেয় ‘মিথ্যা বিশ্বাস’-এর (false belief)। এক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই ঘটে। তাকে আশ্রয় নিতে হয় অদ্ভুত এক মিথ্যা বিশ্বাসের, জেহাদের উদারপন্থী তত্ত্বের, যা কোরআন-হাদিস সমর্থিত নয়। সযত্নে লালিত আদর্শ ও কঠিন বাস্তবের সংঘাতে আজ এদের অন্তর জর্জরিত। 

কোন মানুষ উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে কোন মিথ্যা বিশ্বাসের আশ্রয় নেবে, সেটা তার নিজের বিষয়। কিন্তু সমস্যা তো এখানেই শেষ নয়। এরকম মিথ্যা বিশ্বাসের বশীভূত হওয়ার অর্থ হল - নিজে অন্যের হাতের পুতুল বা যন্ত্রে পরিণত হওয়া। বিষয়টি কি রকম জাঁ পল সার্ত্রের উদাহরণ দিয়েই বোঝান যাক:
“একজন তরুণী প্রথমবার এক পুরুষ বন্ধুর সাথে ডেটিং এ বেরিয়েছে। সে ভাল করেই জানে যে, তার পুরুষ বন্ধুর উদ্দেশ্য তার ভালবাসা পাওয়া ছাড়াও আরও বেশি কিছু এবং শীঘ্রই এই বিষয়ে তাকে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে পুরুষ বন্ধুটির সঙ্গ ত্যাগ করার সাহস তার নেই, অথচ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করার ইচ্ছাও তার নেই। এই দু'টি বিকল্পের কোনও একটিকে বেছে নেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তার থাকলেও সে তা করতে পারে না। এরপর পুরুষ বন্ধুটি যখন তার হাতের ওপর হাত রাখে, তখন সে কী করবে, বুঝতে পারে না। কেননা, নিজের হাতটি যদি সে পুরুষ বন্ধুটির হাতে স্বাভাবিকভাবে রেখে দেয়, তাহলে তার অর্থ হবে পুরুষটিকে এগিয়ে যাওয়ার সম্মতি দেওয়া; অন্যদিকে যদি সে হাতটা সরিয়ে নেয়, তবে এই সুন্দর মুহূর্তটিকে নষ্ট করা হবে। এই মুহূর্তে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সে এমন ভান করে, যেন সে কিছুই বোঝেনি। সে তৎক্ষণাৎ পুরুষ বন্ধুটির সাথে ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত, আবেগ-বর্জিত ও আদর্শের কথা বলে প্রাণপণে সে দেহ ও মনের বিচ্ছিন্নতা ঘটাতে চায়। হাতটি যেন একটি জড়বস্তু, যার কোনও অনুভূতি নেই। অচেতন জড়বস্তুর মতো সেটি পুরুষটির উষ্ণ মুঠির ভেতরে ধরা থাকে।” 
এরকম অনুভূতি তো সব মেয়েদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। যাই হোক, সার্ত্রের মতে, মেয়েটির সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করলো। কেননা তার সিদ্ধান্তের পরিণতি সে জানে না। মানুষ সর্বদাই উদ্বেগ থেকে বাঁচতে চায়। তাই সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে নিজেকে ভুল বোঝায়, নিজের কাছেই কিছু না বোঝার ভান করে। অর্থাৎ নিজে সেই বিষয়ে অনুভূতিহীন না হলেও, নিজেকে সেই বিষয়ে অনুভূতিহীন হওয়ার মিথ্যাতে বিশ্বাস করায়। ঠিক এই ঘটনা ঘটে সাধারণ মুসলিমদের সাথে। তারা সব বুঝেও সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে কিছুই না বোঝার এবং কিছুই না হওয়ার ভান করে। তারা প্রাণপণে নিজেকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, এইসবের কারণ ইসলাম নয়। আবার উদাহরণের মেয়েটি যখন ওরকম ভান করে, নিজেকে মিথ্যা বিশ্বস্ত করে তখন কিন্তু সে আসলে উদ্বেগ কাটাতে গিয়ে নিজের চিন্তা ও ক্রিয়ার স্বাধীনতাকে নিজেই হারিয়ে ফেলে। নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থা এমন এক দুর্বল অবস্থা যে, মেয়েটি শেষমেশ নিজেকে পুরুষটির ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়। তার ফল হয় মেয়েটি যা চাইছিল না, সেটাই হয়। মুসলিমদের ক্ষেত্রেও অবস্থা ঠিক এই রকম। অর্থাৎ যে ইসলামী জেহাদ বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সেই ইসলামী জেহাদি তত্ত্বের হাতেই তারা নিজেদের ছেড়ে দেয়। তখন জেহাদিদের ইচ্ছাই তাদের ইচ্ছায় পরিণত হয়। নিজের মিথ্যা বিশ্বাসের ফলে তারা হয়ে পড়ে যন্ত্র। জেহাদিরা যা স্বপ্ন দেখায়, তারা চোখ বন্ধ করে সেটাই বিশ্বাস করে। 

অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীদের সাথে জেহাদিদের পার্থক্য একটা বিশেষ ক্ষেত্রে। অন্যান্য সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সরকারকে চাপ দেয়। কিন্তু জেহাদিরা যখন জেহাদি কার্য পরিচালনা করে, তখন শুধুমাত্র সরকারই তাদের টার্গেট নয়। বরং এই কাজ করে তারা সম্পূর্ণ মুসলিম জাতিকে উন্নত, জটিল, বহুমাত্রিক এই সমাজ থেকে আলাদা করে দিতে চায়, যাতে সারা সমাজ তাদের দিকে সন্দেহ ও ঘৃণার নজরে দেখে। যাতে তারা আরও গুটিয়ে নেয় নিজেদের, আরও সংহত করে নেয়, আরও সচেতন হয়ে পরে নিজেদের ধর্মীয় আইডেন্টিটি সম্পর্কে, যেটা তাদের মিথ্যা বিশ্বাসেরই অঙ্গ। ধর্মীয় আইডেন্টিটি সম্পর্কে নিজেদের মিথ্যা বোঝানো এই অতি-সচেতন (!) সংহত একটি মানবগোষ্ঠীকে অতি সহজেই ধর্ম বিষয়ে বিভ্রান্ত করা যায়। জেহাদিরা সেটা করে খুব দক্ষতার সাথেই। তারা ‘প্যান-ইসলাম’ (অর্থাৎ সারা বিশ্বের ইসলামীকরণের তত্ত্ব)-এর দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে তাদের ব্যবহার করে যন্ত্র হিসেবে। আর এই মানুষগুলো অন্যদের ঘৃণা ও সন্দেহ থেকে বাঁচার জন্য এই পথটাকেই সঙ্গত মনে করে। তারা যন্ত্রের মতোই প্যান-ইসলামের সমর্থক হয়ে পড়ে। সমর্থক হয়ে পড়ে জেহাদের, নিজের অজান্তেই। 

তবে এটাই শেষ কথা নয়। আশার কথা এই যে, মিথ্যা বিশ্বাস কোনোদিন চিরকালের জন্য থাকতে পারে না। সার্ত্র নিজেই বলেছেন, মিথ্যা বিশ্বাস একটা প্যারাডক্সিক্যাল (paradoxical) অবস্থা। কেননা, সার্ত্রের মতে মানুষ যখন উদ্বেগ থেকে প্রাণপণে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করে, তখন পক্ষান্তরে সে উদ্বেগ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হয়ে পড়ে। ছোট বেলায় ভাঙার আগে আলগা হয় যাওয়া দাঁতের কথা ভাবুন, যতই ভাবতাম যে ওটা সম্পর্কে ভাববো না, ততই সেখানে জিভ চলে যেত, অর্থাৎ আমরা আরও সচেতন হয়ে পড়তাম। ঠিক সেইরকম এই সব মিথ্যা বিশ্বাসী মুসলিমদের ভবিতব্য হল, তারা একদিন বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসবে। তাদের মিথ্যা বিশ্বাসই তাদের ফিরিয়ে আনবে মিথ্যা বিশ্বাস থেকে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে তারা। স্বাধীনতা ও উদ্বেগের মুখোমুখি হবে। সেদিন কী হবে, সে সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করার ক্ষমতা আমার নেই। কেননা ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির মধ্যে অসীম সম্ভাবনা নিহিত। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন