পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪
মুসলিম নারীরা কি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে?
বিশ্বের প্রতিটি জীবের স্বাধীনভাবে যত্রতত্র চলার অধিকার রয়েছে। জন্ম থেকেই আমরা সেই স্বাধীনতা ভোগ করে আসছি - ব্যতিক্রম শুধু মুসলিম নারীরা। বিশ্বাস না হলে ঘুরে আসুন কোন এক ইসলামী স্বর্গ থেকে - যেমন সৌদি আরব, ইরান, আজকের ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান… এই সব দেশ। আপনি দেখবেন আমরা যে অধিকারকে জন্ম অধিকার হিসেবে মনে করি, এই সব ইসলামী স্বর্গগুলোতে বসবাসকারী মহিলাদের এই নূন্যতম অধিকারটুকুও নেই। এ কী বর্বরতা! আল্লাহ্ কেন এত নিষ্ঠুরভাবে তাঁরই সৃষ্ট নারীদের বন্দি করে রেখেছেন চার দেওয়ালের মাঝে? আল্লাহ্ কেন এই সব বিদঘুটে নিয়মকানুন পুরুষদের বেলায় প্রযোজ্য করেননি? দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সমস্ত মুসলিম বিশ্ব এই বর্বরতা নীরবে মেনে নিচ্ছে - এর বিরুদ্ধে কোনো টুঁ শব্দটি আমরা শুনি না। আরও অবাকের ব্যাপার হচ্ছে, মুসলিম নারীরা এই সব অসভ্য, বেদুঈন, বর্বরতাকে জোরদার সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। কী পরিহাস! মুসলিম নারীরাই এই জংলী সভ্যতার ভুক্তভোগী, অথচ তারাই নীরবে এই বর্বরতা স্বাছন্দে মেনে নিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে। এইই যদি চলে, তবে কেমন করে একজন মুসলিম নারী পেশাদার কিছু হতে পারবে? ইসলাম যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, পায়ে বেড়ি লাগিয়ে, সমস্ত শরীরকে কারাগারে পুরে, এবং তার নারীত্বের সমস্ত মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে।
ইসলামী জ্ঞানীগুণীরা অনেক যুক্তি দেখান এই বর্বরতার - যেমন, এ সবই করা হচ্ছে মুসলিম নারীদের মর্যাদা, সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য। এই প্রসঙ্গে সর্বদাই বলা হয়ে থাকে: দেখুন, পাশ্চাত্যের নারীরা কি রকম অসভ্য, বেলেল্লাপনা করে বেড়াচ্ছে। তাদের পরনে নামে মাত্র পোশাক, তাদের যৌনাঙ্গ প্রায় উন্মুক্ত। এই সব পাশ্চাত্য বেশ্যাদের তুলনায় আমাদের ইসলামী নারীরা অনেক সুখী, সৌভাগ্যবতী, এবং ধর্মানুরাগী। এইসব শারিয়া আইন করা হয়েছে মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য। এই সব শারিয়া আইন প্রমাণ করে ইসলাম নারীদের কত মর্যাদা দেয়, কত মূল্যবান মনে করে মুসলিম নারীদের। এই সব কত গালভরা কথাই না আমরা অহরহ শুনছি। কী উত্তর দেওয়া যায় ঐ সব অযুক্তি ও কুযুক্তির?
দেখা যাক নারীর প্রতি ইসলামের মর্যাদা দেখানোর কিছু নমুনা।
ইবনে ওয়ারাকের, আমি কেন মুসলিম নই বই, পৃঃ ৩২১:১৯৯০ সালে পাকিস্তানী এক নারীকে হোটেলের চাকুরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় যেহেতু মহিলাটি এক পুরুষের সাথে করমর্দন করেছিল। তারপর পাকিস্তানী মহিলাটি বললেন:“পাকিস্তানে নারী হয়ে বাস করা খুবই বিপদজনক”।
এখন আমরা দেখি, কোরান ও হাদিস কী বলছে এই প্রসঙ্গে।
কোরান সূরা আন নুর, আয়াত ৩১ (২৪: ৩১):ইমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত: প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নি-পুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদি, যৌনকামমুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগন, তোমরা সবাই আল্লাহ্র সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
কোরান সূরা আল আহযাব, আয়াত ৩৩ (৩৩:৩৩)তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে—মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ্ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত পবিত্র রাখতে।
সহিহ মুসলিম, বই ৭ হাদিস ৩১০৫:আবু হুরায়রা বললেন: “রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে নারী আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে সে কখনই তার মাহরাম ছাড়া এক দিনের ভ্রমণে যাবে না।”
মালিকের মুয়াত্তা, হাদিস ৫৪.১৪.৩৭:মালিক—সাইদ ইবনে আবি সাইদ আল মাকবুরি—আবু হুরায়রা থেকে। মালিক বললেন: আল্লাহ্র রসুল (সাঃ) বলেছেন: যে নারী আল্লাহ ও আখেরতে বিশ্বাস করে তার জন্যে তার পুরুষ মাহরাম ছাড়া একদিনের রাস্তা ভ্রমণ করা হালাল নয়।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, এমনকি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মহিলা শ্রমিক বিভিন্ন কল-কারখানায় প্রতিদিন কাজ করতে যায়। এ না করলে তাদের সংসার চলবে না। আমরা ইসলামীদের প্রশ্ন করব: কী হবে ঐ সব মহিলা শ্রমিকদের, যদি তারা শারিয়া আইন বলবত করে? অনেক মহিলা শ্রমিক রাত্রের বেলাতেও ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তাদের কী হবে ইসলামী আইন চালু হলে? শারিয়া আইনের ফলে এই সব মহিলা শ্রমিক ও তাদের পরিবার যে অনাহারে থাকবে, তা আর বোঝার অপেক্ষা থাকে না। আমরা কি চিন্তা করতে পারি, শারিয়া আইনের ফলে কেমন করে মেঘবতী সুকার্ণপুত্রী (ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি), আমাদের দুই নেত্রী কেমন করে বিদেশে যেতে পারবেন এবং বিদেশের পুরুষ রাষ্ট্রনায়কদের সাথে এক সাথে বসে আলাপ আলোচনা করবেন? সৌজন্য স্বরূপ পুরুষ রাষ্ট্রনায়কদের সাথে করমর্দনের কোনো কথাই উঠতে পারে না। ইসলামে তা একেবারেই হারাম - ঐ দেখুন ওপরে - এক পাকিস্তানী মহিলার ভাগ্যে কী জুটেছিল। আজকের দিনে আমরা এই বিশুদ্ধ ইসলামী আইনের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি তালিবানি শাসিত আফগানিস্তানে, উত্তর সুদানে ও নাইজেরিয়ার কিছু প্রদেশে।
একবার ইসলামী আইন চালু হলে মুসলিম নারীদের কপালে যে কী আছে, তা আর বিশেষভাবে লেখার দরকার পড়ে না। শারিয়া আইন নারীদেরকে বেঁধে ফেলবে চতুর্দিক থেকে। মোল্লা, ইমাম, মৌলানা, ইসলামী মাদ্রাসার ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়বে হিংস্র, খ্যাপা কুকুরের মত। দলিত মথিত করে, জবাই করে, টুকরো টুকরো করে এরা খাবে আমাদের মাতা, ভগ্নি, স্ত্রী, প্রেয়সীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। পাথর ছুঁড়ে এই পাগলা কুকুরগুলো হত্যা করবে আমাদের নারী স্বাধীনতার অগ্রগামীদেরকে। তাকিয়ে দেখুন, কী হচ্ছে আজ ইরানে, ইসলাম শাসিত সুদানে, আফগানিস্তানে, নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ও অন্যান্য শারিয়া শাসিত ইসলামী স্বর্গগুলিতে।
এখন শুনুন, এক পাকিস্তানী মোল্লা কী বলছে রাওয়ালপিন্ডির মহিলা নেতাদের প্রতি।
ইবনে ওয়ারাকের বই, আমি কেন মুসলিম নই, পৃঃ ৩২১:আমরা এই সব মহিলাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছি। আমরা তাদেরকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলব। আমরা ওদেরকে এমন সাজা দিব যে কস্মিনকালে ওরা ইসলামের বিদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারবে না।
বেশ কিছু শিক্ষিত ইসলামী প্রায়শঃ বলে থাকেন যে, ইসলাম নাকি মহিলাদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য আহবান জানায়। ইসলামের লজ্জা ঢাকার জন্যই যে এই সব শিক্ষিত মুসলিম পুরুষেরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁদের মিথ্যার মুখোশ উন্মোচনের জন্যে আমরা দেখব কিছু শারিয়া আইন। কী বলছে শারিয়া মুসলিম নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে?
শারিয়া সাফ সাফ বলছে যে মহিলাদের জন্য একমাত্র শিক্ষা হচ্ছে ধর্মীয়, তথা ইসলামী দীনিয়াত।
শারিয়া আইন এম ১০.৩ (উমদাত আল সালিক, পৃঃ ৫৩৮):স্বামী তার স্ত্রীকে পবিত্র আইন শিক্ষার জন্য গৃহের বাইরে যাবার অনুমতি দিতে পারবে। সেটা এই কারণে যে যাতে করে স্ত্রী জিকির করতে পারে এবং আল্লাহ্র বন্দনা করতে পারে। এই সব ধর্মীয় শিক্ষা লাভের জন্য স্ত্রী প্রয়োজনে তার বান্ধবীর গৃহে অথবা শহরের অন্য স্থানে যেতে পারে। এ ছাড়া স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী কোন ক্রমেই তার মাহরাম (যে পুরুষের সাথে তার বিবাহ সম্ভব নয়, যেমন পিতা, ভ্রাতা, ছেলে…ইত্যাদি) ছাড়া গৃহের বাইরে পা রাখতে পারবে না। শুধু ব্যতিক্রম হবে হজ্জের ক্ষেত্রে, যেখানে এই ভ্রমণ বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া অন্য কোন প্রকার ভ্রমণ স্ত্রীর জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং স্বামীও অনুমতি দিতে পারবে না। হানাফি আইন অনুযায়ী স্ত্রী স্বামী অথবা তার মাহরাম ছাড়া শহরের বাইরে যেতে পারবে যতক্ষণ না এই দূরত্ব ৭৭ কি: মিঃ (৪৮ মাইল) এর অধিক না হয়।
শারিয়া আইন এম ১০.৪ (ঐ বই, পৃঃ ৫৩৮):স্ত্রীর ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা।স্বামীর কর্তব্য হবে স্ত্রীকে গৃহের বাইরে পা না দেবার আদেশ দেওয়া। (O. কারণ হচ্ছে বাইহাকি এক হাদিসে দেখিয়েছেন যে নবী (সাঃ) বলেছেন:যে মহিলা আল্লাহ্ ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে সে পারবেনা কোন ব্যক্তিকে গৃহে ঢোকার যদি তার স্বামী সেই ব্যক্তির উপর নারাজ থাকে। আর স্বামী না চাইলে স্ত্রী গৃহের বাইরে যেতে পারবে না।)কিন্তু স্ত্রীর কোন আত্মীয় মারা গেলে স্বামী স্ত্রীকে অনুমতি দিতে পারে গৃহের বাইরে যাবার।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন