শিবমহাপুরাণের বিদ্যেশ্বরসংহিতা ভাগের তৃতীয় অধ্যায়ের পঁচিশতম শ্লোক:
উক্তং ত্বয়া মহাভাগ লিঙ্গ-বেরপ্রচারণম্।শিবস্য চ তদন্যেষাৎ বিভজ্য পরমার্থতঃ।।
এখানে ব্রহ্মপুত্র সনৎকুমার ব্যাসদেবের শিষ্য সূতর কাছে শিবের লিঙ্গশরীর আবির্ভাবের কারণ এবং কিভাবে তা আবির্ভূত হয়েছে--তা জানতে চান।
তখন সূত বলেন:
পুরাকল্পে মহাকালে প্রপন্নে লোকবিশ্রুতে।
অযুধ্যেতাং মহাত্মানৌ ব্রহ্ম-বিষ্ণু পরস্পরম্।।২৮
তয়োর্মানং নিরাকর্ত্তুং তন্মধ্যে পরমেশ্বরঃ।
নিষ্কলস্তম্ভরূপেণ স্বরূপং সমদর্শয়ৎ।।২৯
ততঃ স্বলিঙ্গচিহ্নত্বাৎ স্তম্ভতো নিষ্কলং শিবঃ।
স্বলিঙ্গ দর্শয়ামাস জগতাং হিতকাম্যয়া।।৩০
অর্থাৎ লোকবিখ্যাত পূর্ব্বকল্পের বহুকাল অতীত হইলে একদা ব্রহ্মা ও বিষ্ণু পরস্পর সমরাসক্ত হওয়ায় তাঁহাদিগের অভিমান দূরীকরণার্থ ত্রিগুণাতীর ভগবান্ মহেশ্বর, উভয় যোদ্ধার মধ্যস্থলে স্তম্ভরূপে আবির্ভূত হইলেন। পরে সেই স্তম্ভে স্বীয় লিঙ্গচিহ্ন নিবন্ধন জগত্রয়ের হিতকামনায় তাহা হইতে নির্গুণ নিজলিঙ্গ প্রকাশ করিলেন।
সেই থেকে শিবলিঙ্গ পূজিত হয়ে আসছে। অন্যান্য দেবতাদের বেলায় তাদের সাক্ষাৎ মূর্তি কল্পনা করা হলেও শিবের বেলায় শিবলিঙ্গ এবং তার মূর্তি, উভয়ই পূজিত হয়।
হিন্দুরা এই ঘটনাকেই হাইলাইট করে দেখিয়ে বলে শিবলিঙ্গ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে নেয়া যাবে না, অর্থাৎ শিবলিঙ্গ মানে শিবের নুনু নয়। এটা সেই "স্তম্ভ" যা ব্রহ্মা-বিষ্ণুর যুদ্ধ থামানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, এবং সেটা শিবেরই একটা রূপভেদ মাত্র। এক্ষেত্রে আমরা বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গের যে সংজ্ঞাটা পড়েছি, অর্থাৎ ছেলে মেয়ের ধারণাকে বলা হয় লিঙ্গ। অর্থাৎ, পুংলিঙ্গ মানে পুরুষ, আর স্ত্রীলিঙ্গ মানে নারী বা মেয়ে বা স্ত্রী। ঠিক এইভাবেই শিবের ধারণাকে বলা হয় শিবলিঙ্গ।
ভূমিকা গেল। এবার শিবরাত্রি কিভাবে এলো, সেই দিকে আলোকপাত করা যাক। এজন্য আমাদেরকে উপরোক্ত কাহিনীটি অর্থাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণুর যুদ্ধের কাহিনীটি জানতে হবে। আর এটা জানা যাবে বিদ্যেশ্বরসংহিতা ভাগের চতুর্থ অধ্যায়ে।
বিষ্ণু খাওয়া-দাওয়া কইরা একটু শুইছিল। চ্যালারা হাত-পা টিপা দিচ্ছিল বইলা আরামের চোটে ঘুম-ঘুম ভাব হইছিল। সেই সময় হাওয়া খাইতে খাইতে সেইখানে ব্রহ্মা আইসা হাজির। বিষ্ণু তারে না দেইখা শুইয়াই থাকল। ব্রহ্মা তখন দিল এক ঝাড়ি, এই ব্যাটা, তোর গুরু আইসা হাজির, আর তুই কিনা না দেখার ভান কইরা শুইয়া আছোস!
বুইড়ার বাড়াবাড়ি দেইখা বিষ্ণুর রাগ হইলেও ঠাণ্ডা মাথায় কইল, বৎস, আছো কেমন? এইখানে আসতে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?
ব্রহ্মা আরো রাইগা গেল। কইল, আমি জগতের পিতামহ, তোমার প্রভু। আমার লগে একদম বিটলামি করবা না।
বিষ্ণু এইবার রাইগা গিয়া কইল, তুই আমার প্রভু না বাল! আমার নাভি থিকা তোর জন্ম। সেই হিসাবে আমি তোর বাপ।
এরপর আর কথা চলে না। হাতাহাতি শুরু হইয়া গেল। সেই থিকা বিশাল যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিষ্ণু ব্রহ্মারে লক্ষ কইরা 'মাহেশ্বরাস্ত্র' নামক ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করলে ব্রহ্মাও পালটা 'পাশুপতাস্ত্র' নিক্ষেপ করে। এই দেখে অন্যসব দেবতারা ভয় পাইয়া গেল। দুইটা অস্ত্রের সংঘর্ষ হইলে তো দুনিয়া শেষ! সবাই গেল শিবের কাছে।
পঞ্চম অধ্যায়ে দেখি: শিব অন্যান্য দেবতাদের কাছে ভাব লইতাছে, আমি তো আগেই ঘটনা জানি, দাঁড়াও দেখি কী করা যায়। এই বইলা সে ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর মাঝখানে আইসা আগুনের স্তম্ভরূপে আবির্ভূত হইল, আর দুইটা অস্ত্রই এই আগুনের মধ্যে আইসা পুইড়া ঠাণ্ডা হইয়া গেল। এরপর কিছু ফাও কথা আর গিয়ান দানের ব্যাপার আছে - বিষ্ণু সেই স্তম্ভের তলদেশ খুঁজতে গিয়া না পাইয়া ফিরা আইসা স্বীকার করল যে, সে সন্ধান পায় নাই। আর ব্রহ্মা উপরিভাগ খুঁজতে গিয়া না পাইয়াও ফিরা আইসা মিথ্যা কয় যে সে পাইছে। এরপর মিথ্যা কথা বলার জন্য তার পাঁচটা মাথার একটা মাথা কাটা যায়। বাকিগুলাও শিব কাটার ব্যবস্থা করতে গেলে মাফটাফ চাইয়া রেহাই পায়। এই কাহিনী আছে ষষ্ঠ অধ্যায়ে।
সপ্তম অধ্যায়ে দেখি ব্রহ্মা-বিষ্ণু মিল্লা শিবরে অনেক পূজাটুজা করতেছে। পূজায় খুশি হইয়া শিব কইতাছে:
তুষ্টোহহমদ্য বাং বৎসৌ পূজয়াস্মিন্ মহাদিনে
দিনমেতং ততং পূণ্যং ভবিষ্যতি মহত্তরম্।
শিবরাত্রিরিতি খ্যাতা তিথিরেষা মম প্রিয়াং।।১০
অর্থাৎ অদ্য আমি এই মহৎ দিনে তোমাদিগের পূজায় পরম প্রীতিলাভ করিলাম, অতএব চিরকাল এই পবিত্র দিন শ্রেষ্ঠতম বলিয়া সমাদৃত হইবে এবং মৎপ্রিয় এই তিথি 'শিবরাত্রি' নামে জগতে খ্যাতিলাভ করিবে।
শিব আরো কয়, "আমাকেই সগুণ ঈশ্বর বলিয়া জানিবে, আর দৃশ্যমান নির্গুণ এই স্তম্ভই আমার ব্রহ্মত্বব্যঞ্জক। বৎসদ্বয়! ঐ স্তম্ভে যখন আমার লিঙ্গচিহ্ন প্রকাশ পাইতেছে, তখন উহা আমার লিঙ্গ, তোমরা নিত্য ঐ লিঙ্গে পূজা করিবে।..." তারপর জয়নাল ব্যাপারীর পাছায় কত চুম্মায় কত ডলার, তার হিসাব নিকাশ।
এই গেল শিবরাত্রির উৎপত্তি এবং শিবলিঙ্গের একটা ভার্সন।
এবার এই কাহিনীর আগে অর্থাৎ জ্ঞানসংহিতানামক ভাগে লিঙ্গের আর্থরিক অর্থে কী কাহিনী আছে, সেইটা দেখা যাক।
জ্ঞানসংহিতা ভাগের বেয়াল্লিশতম অধ্যায়ে ঋষিরা সূতকে জিজ্ঞেস করেন, "লোকে যে লিঙ্গ পূজা করে, তাহার কারণ তুমি বলিয়াছ, (এই কারণটা জানতে হলে শিবমহাপুরাণ আবার প্রথম থিকা পড়তে হবে) তদ্ভিন্ন আর কোন কারণ আছে কি না?"
সূত কাহিনী শুনায়: দারু নামক এক বনে ঋষিরা বাস করত। তারা খুব শিবভক্ত ছিল। একদিন সব ঋষি বনের মধ্যে চলে গেলে শিবের ইচ্ছে হলো এদের পরীক্ষা করে দেখবেন। তিনি ছদ্মবেশে আশ্রমে হাজির হলে এভাবে:
দিগম্বরোহতিতেজস্বী ভূতিভূষণভূষিতঃ।
চেষ্টাঞ্চৈব কটাক্ষঞ্চ হস্তে লিঙ্গঞ্চ ধারয়ণ্।।১০
অর্থাৎ ন্যাংটা হইয়া শরীর "শরীর ভস্মাচ্ছাদিত, অতি তেজস্বী এবং তাঁহার বিকৃত চেষ্টা, বিকৃত কটাক্ষ, তিনি হস্ত দ্বারা লিঙ্গ ধারণ করিয়া স্ত্রীদের মন মোহিত করিয়া আগমন করিলেন।"
ঋষিদের স্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ভয় পাইল, কেউ কেউ অবাক হইল, কেউ কেউ মজা দেখার জন্য উঁকিঝুকি মারল। কেউ কেউ আবার শিবের হাত ধইরা আলিঙ্গন করতে লাগল। এমন সময় ঋষিরা ফিরা আসল। পুরা কাহিনী দেইখা তব্ধা খাইয়া কইতে লাগল, এই হালার পুত, তুই কেডা রে! শিব কিছু কইলো না, মিটমিট কইরা হাসতে লাগল। তখন ঋষিরা অভিশাপ দিল, "তোমার লিঙ্গ পৃথিবী তলে পতিত হউক।" অমনি শিবের লিঙ্গ টুপ কইরা খইসা পড়ল। পড়ামাত্র স্বর্গ মর্ত পাতাল ভেদ কইরা চলছে তো চলছেই, আর সামনে যা কিছু পাইল, সব কিছুই পোড়াইয়া দিতে লাগল।
ঋষিরা দেখল এ তো মহাজ্বালা! তারা ব্রহ্মার কাছে গেল। ব্রহ্মা কইল:
যাবল্লিঙ্গং স্থিরং নৈব জগতাং ত্রিতয়ে শুভম্।
জায়তে ন তদা ক্বাপি সত্যমেতদ্বদাম্যহম্।।২৫
অর্থাৎ যে পর্যন্ত লিঙ্গ স্থিরভাব অবলম্বন না করিতেছে, সেই পর্যন্ত ত্রিজগতের কোথায়ও শুভ হইবে না, ইহা সত্য কহিতেছি।
ঋষিরা কইলো, তা তো বুঝলাম, কিন্তু উপায় বলেন।
ব্রহ্মা উপায় বাতলাইলেন:
আরাধ্য গিরিজাং দেবীং প্রার্থয়ধ্বং শুভাং তদা।।২৭
যোনিরূপং ভবেচ্চেদ্বৈ তদা তৎ স্থিরতাং ভজেৎ।
তদা প্রসন্নাং তাং দৃষ্ট্বা তদেবং কুরুতে পুনঃ।।২৮
অর্থাৎ মঙ্গলাদায়িনী গিরিজা দেবীর আরাধনা কর, তিনি যদি প্রসন্না হইয়া যোনিরূপ ধারণ করেন, তাহা হইলে এই লিঙ্গ স্থিরভাব অবলম্বন করিবে।
তারপর "পার্ব্বতী বিনা অন্যা লিঙ্গ ধারণ করিতে সমর্থা হইবে না, তিনি ধারণ করিলেই শান্তি হইবে, দেবতা-ঋষিরা এই বিবেচনা করিয়া ব্রহ্মাকে অগ্রে করিয়া গিরিজাকে প্রসন্না করিয়া প্রার্থনা করিলে। পার্ব্বতী তাহা পূর্ণ করিলেন।...লিঙ্গ স্থাপিত হইলে জগতে সুখ হইল।" অর্থাৎ শিবের খসে পড়া লিঙ্গ দুর্গা যোনিরূপে ধারণ করলে স্থির অবস্থায় আসে।
তার মানে শিবমহাপুরাণে আমরা দুই ধরনের শিবলিঙ্গ দেখতে পাই: একটা শুধু স্তম্ভ আকারে - যেমন অমরনাথ, ইত্যাদির শিবলিঙ্গ,
আরেকটি যোনির উপর স্থাপিতরূপে - যেটির মাথায় বৌদিরা দুদু ঢালে আর অন্যদিকে বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভোগে...
* উপ্রের লেখা আর ছবি হইলো গিয়া শিবলিঙ্গ নিয়া দাড়িপাল্লার বিশদ নাড়াচাড়ার ফল। দুষ্টলোকে কয়, শিবলিঙ্গের প্রকৃত ইতিহাস আলাদা। মাত্র একখান সচিত্র পোস্টার দিয়া পুরা ইতিহাস বর্ণিত। তয় বাচ্চালোগ, তোমরা দূরে যাও। এইটা বড়োদের খাবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন