রবিবার, ২ মার্চ, ২০১৪

লুক্স লিখিত সুসমাচার - ৩১

লিখেছেন লুক্স

২৯৬.
২০০৫ সালের কথা। দুই সপ্তাহের ছুটি পেয়ে গিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডে আমার অনেক স্কুলফ্রেন্ড থাকে। ঠিক করলাম, ইংল্যান্ড যাবো। ম্যানচেষ্টার থেকে বার্মিংহাম হয়ে লন্ডন পর্যন্ত সব স্কুলফ্রেন্ডকে খুঁজে বের করবো, তাদের সঙ্গে দেখা করবো। উদ্দেশ্য - তাদের বিলাতি লাইফ স্টাইল দেখা। 
বার্মিংহামেই পেয়ে গেলাম ছোটবেলার তিন বন্ধুকে। অকল্পনীয় এক মিল দেখলাম তিন বন্ধুর বাসাতে গিয়েই। তিনজনই হুজুর হয়ে গেছে। তাদের প্রত্যেকের বাসাতেই আছে একটি করে ইসলামিক রেডিও। সরাসরি লোকাল মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত এই রেডিওটি। এই রেডিওটির একমাত্র কাজ হচ্ছে - দিনে পাঁচবার মসজিদের দেয়া মুয়াজ্জিনের আজান অটোমেটিক বেজে ওঠা। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ইংল্যান্ডেও মাইকে আজান দেয়া নিষেধ। তাই ঘরে বসে আজান শোনার এ আধুনিক ইসলামিক প্রযুক্তি। 
আমি কিছুটা অবাক হয়ে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম, কিরে রেডিওতে আজান শুনিস কেন? 
বন্ধু বললো, বাংলাদেশরে খুব মিস করি দোস্ত। দিনে পাঁচবার নামাযের সময় আজান না শুনলে মনে হয় সামথিং ইজ মিসিং। আর শত হইলেও আমরা মুসলমান। ব্রিটিশ গভর্মেন্ট মসজিদে মাইক লাগানোর পারমিশন দেয় না, তাই মসজিদ থেকে মুসলমানদের বাসায় বাসায় রেডিওর ব্যাবস্থা করা হয়েছে। 
আমি বললাম, এত কষ্ট করে ইংল্যান্ডে এসে আজান শোনার কী দরকার? সৌদি আরব গেলেই পারতি। ডাইরেক্ট কাবা শরীফের আজান শুনতে পারতি। 
বন্ধু বললো, ঠিকই কইছোস। সৌদি আরব যাওয়ার কথাও ভাবছিলাম। কিন্তু হালারা তো আবার সিটিজেনশীপ দেয় না। 
আমি বললাম, তুই মুসলমান, চিন্তুা করবি পরকালের আর তুই দেখি সিটিজেনশীপের চিন্তা করস। 
বন্ধু বললো, আরে ব্যাটা আমি কি আর আমার কথা চিন্তা করি? চিন্তা করি আমার নেকষ্ট জেনারেশনের কথা।
আমার বন্ধুর ছোট ছোট ফুটফুটে তিনটা বাচ্চা। খেয়াল করেছি রেডিওতে যখন আজান বাজে তারাও বাবার সঙ্গে চুপ হয়ে আজান শোনে। বিলেতে জন্মগ্রহণ করা এই শিশু তিনটি যে বাংলাদেশকে মিস করে আজান শোনে, তা কিন্তু মনে হয়নি।

২৯৭.
আমার এক তুর্কিস কলিগ গতকাল অফিসে দেখা হতেই আমারে ঈদের শুভেচ্ছা জানাইলো। 
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি গরু না ছাগল? 
কলিগ কইলো, গরু। 
তারপর জিজ্ঞেস করলাম, জার্মানিতে তো যেখানে-সেখানে কোরবানী দেয়া যায় না, কসাইখানায় বুকিং দিতে হয়। তা, কেমনে কি ম্যানেজ করলা? 
ওভাবেই দিয়েছি, আমাদের কমিউনিটির ৩০টা ফ্যামিলি মিলে একটা গরু। 
কী? ৩০টা ফ্যামিলি মিলে একটা গরু? এটা কিভাবে সম্ভব? মোহাম্মদ তো কইছেন একটা গরু ৭ জনের বেশি ভাগ করা যাবে না। 
কলিগ কইলো, মোহাম্মদ তো কত কথাই কইছেন। মোহাম্মদ নিজে আইসা তো আর গরুটা কাইট্টা দিয়া যাইবো না। তাছাড়া অমুসলিম দেশে ঈদের ছুটিও নাই। 
আমি পুরাই কনফিউজড। এইবার ডাইরেক্ট জিগাইলাম, ব্যাটা তুমি কি মুসলমান না নাস্তিক? 
কইলো, 'নাস্তিক'। তাইলে কোরবানী দেয়ার মানে কী? তাও আবার ৩০ জনে মিলে একটা গরু? 
কলিগ কইলো, ট্র্যাডিশন, আর বুড়া বাবা-মা'রে খুশী করার জন্য। 
বুঝলাম, বাবা-মা'রে খুশি করার জন্য নাস্তিকগোরে জীবনে কত কীই না করতে হয়!

২৯৮.
প্রথমে জানতাম না সেদিন ছিল শবেবরাত। কয়েক বছর আগের কথা। ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে ফেরি পার হচ্ছিলাম। বিশাল বিশাল ফেরি চলে ইংলিশ চ্যানেলের উপর দিয়ে। একেকটা ফেরিতে থাকে শত শত গাড়ি আর হাজার হাজার যাত্রী। পার হতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। মহাসমুদ্রের ওপর চমৎকার জোছনা আর আকাশের বিশালতার কারণে অসাধারণ এক স্মৃতি হয়ে থাকে প্রতিটা যাত্রীর জীবনে দুর্লভ এই দুই ঘন্টা সময়। তাই সবাই ইচ্ছে মত উপভোগ করতে চায় এই সময়টা। একটা মিনিটও নষ্ট করা যাবে না। 
ফেরির প্রতিটা ফ্লোরেই আছে ড্রিংক্সবার আর ড্যান্সফ্লোর। ফেরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব যাত্রী বিভিন্ন ধরনের পানীয় পান করতে করতে মিউজিকের সঙ্গে নাচতে শুরু করলো। এরই মধ্যে দেখি এক হুজুর। দাড়ি, টুপি আর জোব্বা পরা এক আফ্রিকান বয়স্ক ভদ্রলোক। হাতে একটা জায়নামাজ নিয়ে হন্য হয়ে কী যেন খুঁজছেন। তারপর হঠাৎ করেই ড্যান্সফ্লোরের এক কোণায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার নামাজ পড়া দেখে সঙ্গে সঙ্গে সবাই সশ্রদ্ধভাবেই মিউজিক আর নাচ বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধের দিকে। তাকিয়ে রইলো পুরো ১০ মিনিট। কয়েকজন অবশ্য বৃদ্ধকে নিয়ে হাসাহাসিও করেছে। আমারও কী ভাগ্য, নামাজ শেষ করে বৃদ্ধ এসে আমার পাশেই বসলেন। আমার কালো চুল আর কালো চোখ দেখে হয়তো আমাকে তার নিজের ধর্মের মানুষ মনে করেছিলেন। 
আমি বললাম, ফেরিতে অন্য কোনো নিরিবিলি জায়গা পাননি? 
তিনি বললেন, না পাইনি, অনেক খুঁজেছি। আজ শবেবরাত। নামাজ না পড়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না। 
আমি বললাম, ভালোই করেছেন। সবাই আপনার নামাজের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নাচগান বন্ধ করে দিয়েছিলো।
তিনি বললেন হ্যা, কিন্তু কয়েকজন হাসাহাসিও করেছে, আমি শুনেছি। কিস্তু আমি নামাজ পড়ে সবার জন্যই দোয়া করেছি। 
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি দোয়া করেছেন? তিনি বললেন আল্লাহ যেন সবাইকে হেদায়েত দেয়, আর এই ফেরিটা যেন নিরাপদে ইংল্যান্ড পৌঁছায়। 
বললাম, গত কয়েকশত বছর ধরে আপনাকে ছাড়া আর কারও দোয়া দুরুদ ছাড়াই এই পথে প্রতিদিন অনেক গুলো ফেরি পারাপার করছে। আর ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মানুষের হেদায়েত অনেক আগেই হয়ে গেছে। এ বিশাল ফেরি দেখে বোঝেন না? তারা ঈশ্বর আর দোয়া দুরুদের উপর ভরসা করে নেই। তাদের মেধা, পরিশ্রম, সততা আর প্রযুক্তি তাদের কাছে ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বড় শক্তি। 
বৃদ্ধ আমাকে কাফের ভেবে উঠে চলে গেলেন। আমি চলে গেলাম কাফেরদের সঙ্গে নাচতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন