লিখেছেন সাদিয়া সুমি
ফুটবল সম্পর্কে কুরআন-হাদীছ শরীফ উনাদের রেফারেন্স সহকারে ৭টি প্রশ্নের উত্তর।
১. খেলাধুলা হালাল না হারাম?
২. খেলা দেখার কতটুকু জায়িয?
৩. কোন দলকে সমর্থন করা বা কোন দলের জয় কামনা করে দোয়া করা বা রোযা রাখা, হাতে তালি দেয়া, রং ছিটানো, শুকরিয়া আদায় করা শরীয়ত সম্মত কি না?
৪. ক্রিকেট বা ফুটবলে কোনো দল/দেশকে সমর্থন করা, প্রশংসা করা ও পতাকা উড়ানোর ব্যাপারে শরীয়তের ফায়ছালা কি?
৫. কোনো দেশ বা দল কোনো কারণে হঠাৎ জয়লাভ করায় অনেকে বলছে যে, ‘স্বয়ং আল্লাহ্ নিজ হাতে ঐ দলকে জিতিয়ে দিয়েছেন কিংবা আল্লাহ ফিরিশতা দিয়ে সাহায্য করেছেন।’ এ কথাগুলো কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
৬. অনেকে বলছে: ‘ছওয়াবের নিয়তে খেলা দেখতে যাব। আর খেলা দেখার সময় দোয়া করব যাতে মুসলমান দেশ বা দল জয়লাভ করে।’ এ কথাটি কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
৭. আশরাফ আলী থানভী ও মুফতী শফীর খেলা সম্পর্কিত ফতওয়া কতটুকু সঠিক?
প্রশ্ন: ১
খেলাধুলা সম্পর্কে শরীয়তের ফায়ছালা কি? অনেকে বলে, ‘কিছু কিছু খেলা জায়িয।’ তা কোন কোন খেলা?
উত্তর: ১
এর জবাবে বলতে হয় যে, হাদীছ শরীফের বিখ্যাত কিতাব, “মুস্তাদরিকে হাকিম”-এর মধ্যে হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “সব প্রকার খেলা নিষিদ্ধ, তিনটি বিষয় ব্যতীত - (১) তীর ধনুক চালনা করা, (২) অশ্বকে প্রশিক্ষণ দান করা, (৩) নিজ স্ত্রীর সাথে শরীয়তসম্মত হাসি-খুশী করা।”
আবু দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, নাসাঈ শরীফ, ইবনে মাজাহ্ শরীফ ইত্যাদি হাদীছ শরীফের কিতাবেও হযরত ওকবা ইবনে আমির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে অনুরূপ হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে। তবে শব্দের কিছু তারতম্য রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে রেওয়ায়েত আছে, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মু’মিনের শ্রেষ্ঠ খেলা অর্থাৎ প্রশিক্ষণ হচ্ছে সাঁতার কাটা, আর নারীর শ্রেষ্ঠ খেলা অর্থাৎ কাজ হচ্ছে সূতা কাটা।”
“সহীহ্ মুসলিম” ও “মুসনদে আহমদ শরীফে” হযরত সালমান ইবনে আকওয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, “নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৌড় অনুশীলনে এজাযত দিয়েছেন।” (তবে অবশ্যই খেলা হিসেবে নয় বরং জিহাদের প্রশিক্ষণ হিসেবে।)
আর “আবূ দাউদ শরীফে” বর্ণিত আছে, “নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোকনা পাহ্লোয়ানকে কুস্তিতে ধরাশায়ী করেছিলেন।” (তবে তা অবশ্যই খেলা হিসেবে নয় বরং রিসালতের প্রমাণ ও মু’জিযা হিসেবে তিনি রোকনা পাহলোয়ানের সাথে কুস্তি করেছেন এবং তাকে পরাস্ত করেছেন।)
প্রকৃতপক্ষে হাদীছ শরীফে তথা শরীয়তে যেসব বিষয়ের অনুমোদন রয়েছে, তা ব্যতীত যত প্রকার খেলা রয়েছে তার প্রত্যেকটির মধ্যেই, না-কোন দ্বীনী ফায়দা রয়েছে এবং না-কোন দুনিয়াবী ফায়দা রয়েছে। বরং প্রতিটি খেলা তিনটি অবস্থার কোন এক অবস্থা থেকে খালি নয়।
(ক) হয় তা কুফরী হবে,
(খ) অথবা হারাম হবে,
(গ) আর না হয় তা মাকরূহ্ হবে।
(ক) যে খেলা বিধর্মীদের সাথে তাশাব্বুহ্ বা সাদৃশ্য রাখে অথবা দ্বীন ইসলাম থেকে সরিয়ে দেয় বা কুফরীতে নিমজ্জিত করে তা সম্পূর্ণ কুফরী। হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
عن عمرو بن شعب عن ابيه عن جده ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ليس منا من تشبه بغيرنا.
অর্থ: “হযরত আমর বিন শুয়াইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঐ ব্যক্তি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে বিজাতীয়দের সাথে সাদৃশ্য রাখে।” (মিশকাত শরীফ)
(খ) যে খেলা ইসলামী আক্বীদা থেকে সরিয়ে নেয়না কিন্তু হারাম ও গুণাহ্ কাজে লিপ্ত করে দেয়, তা কুফরী নয়, তবে কবীরা গুণাহ কারণ। অর্থাৎ হারাম।
কুরআন পাকে আছে:
تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدوان
অর্থ: “তোমরা পরস্পর পরস্পরকে নেক কাজ ও পরহিযগারীর মধ্যে সাহায্য কর, পাপ ও শত্রুতার মধ্যে সাহায্য করনা।” (সূরা মায়িদা-২)
(গ) আর যে সমস্ত খেলা কুফরী ও হারাম কোনটিই নয় কিন্তু প্রকাশ্যে তা পাপ বলেও মনে হয়না, মানুষ সাধারণভাবে সে সমস্ত খেলাকে জায়িয মনে করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তাও পাপেরই অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ মাকরূহ। এতে যেমন ইবাদত-বন্দিগীর ব্যাঘাত ঘটে এবং স্বাস্থ্য, সময় ও টাকা-পয়সার অপচয় হয়, তদ্রুপ পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষও পয়দা হয়।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ان المبذرين كانوا اخوان الشيطين.
অর্থ: “নিশ্চয়ই (সর্বপ্রকার) অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বণী ইসরাঈল-২৭)
আর হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে,
عن على بن حسين عليه السلام قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من حسن اسلام المرء تركه ما لايعنيه.
অর্থ: “হযরত আলী ইবনে হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোন ব্যক্তির জন্য দ্বীনের সৌন্দয্য হলো অহেতুক বা অপ্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা।” (তিরমিযী, মিশকাত)
উল্লেখ্য যে, শরীয়তের ফতওয়া হচ্ছে- যে কাজ হারাম ও কুফরী, তাকে হালাল মনে করা কুফরী। অর্থাৎ যে হালাল মনে করবে, সে কাফির বা মুরতাদ হয়ে যাবে। আর যে কাজ হারাম ও কুফরী নয় কিন্তু পাপের কারণ, আর সে পাপকে হালকা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করা অর্থাৎ এ ধরণের পাপ করলে কিছু হয়না ইত্যাদি মনে করাটাও কুফরী।
উল্লেখ্য, হাদীছ শরীফ বা শরীয়তে যে সমস্ত বিষয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সে সমস্ত বিষয়গুলি প্রকৃতপক্ষে খেলা বলতে যা বুঝায় তার অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ হাদীছ শরীফে তীর ধনুক চালনা করা, অশ্বকে প্রশিক্ষণ দেয়া, স্ত্রীর সাথে শরীয়ত সম্মত হাসিখুশী করা, সাঁতার কাটা, সূতা কাটা, দৌড় অনুশীলন করা ইত্যাদিকে যদিও শাব্দিক অর্থে খেলা বলা হয়েছে কিন্তু হাক্বীক্বত তা খেলা নয়। কারণ, উল্লিখিত বিষয়ের মধ্যে যেমন দ্বীনী ফায়দা রয়েছে, তেমনি দুনিয়াবী ফায়দাও নিহিত রয়েছে। যেমন- তীর চালনা করা, অশ্বকে প্রশিক্ষণ দেয়া, সাঁতার কাঁটা, দৌড় অনুশীলন ইত্যাদি জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাস্থ্যকে সুঠাম ও বলিষ্ঠ রাখার কারণ। হাদীছ শরীফে উল্লেখ রয়েছে,
প্রশ্ন: ২
খেলা দেখা কতটুকু জায়িয?
উত্তর: ২
এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, খেলা যেহেতু শরীয়তসম্মত নয় সেহেতু তা দেখাও হারাম।
প্রশ্ন: ৩
জয় কামনা করে দোয়া করা বা খেলার খবর শুনে খুশি প্রকাশ করা, হাতে তালি দেয়া, শুকরিয়া আদায় করা শরীয়ত সম্মত কি না?
উত্তর: ৩
এর জাওয়াবে বলতে হয় যে, “কোন দলকে সমর্থন করা বা কোন দলের জয় কামনা করে দোয়া করা বা রোযা রাখা, শুকরিয়া আদায় করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরী। এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে রয়েছে,
عن العرس بن عميرة رضى الله تعالى عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال اذا عملت الخطيئة فى الارض من شهدها فكرهها كان كمن غاب عنها ومن غاب فرضيها كان كمن شهدها.
অর্থ: হযরত উরস্ বিন উমাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন। নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যখন পৃথিবীতে কোথাও কোন পাপ কাজ সংঘটিত হয়, তখন যে ব্যক্তি উক্ত স্থানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও উহাকে ঘৃণা করে, সে ব্যক্তি এরূপ যেন উহা হতে দূরে ছিল। আর যে ব্যক্তি দূরে থেকেও উক্ত পাপের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, সে এরূপ যেন তথায় উপস্থিত ছিল।” (আবূ দাউদ, মিশকাত)
অর্থাৎ গুণাহ্ কাজ যে স্থানেই সংঘটিত হোক না কেন, তাতে যে ব্যক্তি সম্মতি পেশ করবে অথবা সমর্থন করবে, সে ব্যক্তিই সেই গুণাহে গুণাহ্গার হবে। সেখানে তার উপস্থিত থাকা বা না থাকা উভয়টাই বরাবর। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা শুধু রেডিওতে খেলার খবর শুনেছে, টেলিভিশনে খেলা দেখেছে, তারা সকলেই কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার হবে। এবং তাদের মধ্যেও দু’শ্রেণী হবে। এক শ্রেণী- যারা হারাম ও নাজায়িয মনে করে শুনেছে ও দেখেছে, তারা ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত। আর যারা হালাল ও জায়িয মনে করে শুনেছে ও দেখেছে, তাদের উপরও কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে।
এরপর যারা খেলার সংবাদ শুনে খুশী প্রকাশ করেছে, তারা সকলেই কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার হবে। তারাও দু’শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত:
(১) যারা হারাম ও নাজায়িয মনে করে খুশী প্রকাশ করেছে, তারা ফাসেক হবে।
(২) যারা হালাল ও জায়িয মনে করে শোকর আদায় করেছে ও খুশী প্রকাশ করেছে, তাদের উপরও কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে।
এছাড়া যারা রং ছিটিয়ে খুশী প্রকাশ করেছে এমনকি রং ছিটাতে গিয়ে কাদা মাটি ও নোংরা পানি পর্যন্ত ছিটিয়েছে। এরা সকলেই কবীরা গুনাহে গুনাহগার হবে। তারাও দুই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত:
(১) যারা হারাম ও নাজায়িজ মনে করে রং কাদামাটি ও নোংরা পানি ছিটিয়েছে তারা ফাসিক হবে।
(২) যারা হালাল ও জায়িয মনে করে রং, কাদামাটি ও নোংড়াপানি ছিটিয়েছে তাদের উপর কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে।
যারা রং ছিটিয়ে খুশী প্রকাশ করেছে তাদের কাজটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলি পূজার অনুরূপ হয়েছে। যার ফলে তাদের হাশর-নশরও হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (মুসনদে আহমদ, সুনানে আবূ দাউদ)
যারা খেলা দেখে খুশী হয়ে হাতে তালি দিল তারা সকলেই কবীরা গুণাহে গুণাহ্গার হবে। তাদের মধ্যে দু’শ্রেণী হবে।
(১) যারা নাজায়েয জেনে হাতে তালি দিয়েছে তারা ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত হবে,
(২) আর যারা জায়েয মনে করে দিয়েছে তাদের উপর কুফরীর ফতওয়া বর্তাবে।
প্রশ্ন: ৪
খেলায় কোন দেশকে সমর্থন করা, প্রশংসা করা ও পতাকা উড়ানোর ব্যাপারে শরীয়তের ফায়ছালা কি?
লেখায় কোন দলকে সমর্থন করা, প্রশংসা করা ও কোন দলের পতাকা উড়ানো, চাই তা বিধর্মী দেশ হোক অথবা মুসলিম দেশ সেটা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরী। কারণ, এতে প্রথমত: বিধর্মী ও ফাসিক ফুজ্জারকে সমর্থন বা মুহব্বত করা হয়। অথচ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن عبد الله بن مسعود رضى الله تعالى عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم انه قال المرء مع من احب.
অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, নিশ্চয়ই নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে যাকে মুহব্বত করে বা সমর্থন করবে তার হাশর-নশর তার সাথেই হবে।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মুসনাদে আহমদ শরীফ)
عن انس رضى الله تعالى قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا مدح الفاسق غضب الرب تعالى واهتزله العرش.
অর্থ: “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ফাসিকের প্রশংসা করা হলে আল্লাহ গোস্সা করেন এবং সে কারণে আরশ মুবারক কেঁপে উঠে।” (বাইহাক্বী, মিশকাত-১১৪)
শুধু এতটুকুই নয় হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,
عن ابراهيم بن ميسرة رحمة الله عليه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من وقر صاحب بدعة فقد اعان على هدم الاسلام.
অর্থ: “তাবিয়ী হযরত ইব্রাহীম ইবনে মাইসারা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন বিদ্য়াতী তথা ফাসিককে সম্মান করলো, সে মূলত: দ্বীন ইসলাম ধ্বংসের কাজে সাহায্য করলো।” (বাইহাক্বী, মিশকাত)
উল্লেখ্য, কোনো ফাসিক ও বিদ্য়াতীকে সম্মান করা ও প্রশংসা করার কারণে যদি আল্লাহ তায়ালার আরশ কেঁপে উঠে ও আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং ইসলামের ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে তবে কাফির বা বেদ্বীন যারা আল্লাহ নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্টপ্রাণী তাদের প্রশংসা করলে আল্লাহ কতটুকু অসন্তুষ্ট হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ কাফিরদের প্রশংসা করা কুফরী।
আর পতাকা উড়ানোর ব্যাপারে শরীয়তের ফায়ছালা হচ্ছে, তা চরম অপব্যয়।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
ولا تسرفوا انه لايحب المسرفين
অর্থ: “তোমরা অপব্যয় করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আনয়াম-১৪১) কারণ, অপব্যয়কারীরা হচ্ছে শয়তানের ভাই এবং তারা জাহান্নামী।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,
ان المبذرين كانوا اخوان الشيطين
অর্থ: “নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বণী ইসরাঈল- ২৭)
ان المسرفين هم اصحاب النار
অর্থ: “নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা জাহান্নামী।” (সূরা মু’মিন-৪৩)
প্রশ্ন: ৫
কোন দেশ বা দল কোন কারণে হঠাৎ জয়লাভ করায় অনেকে বলেছে যে, ‘স্বয়ং আল্লাহ ফিরিশতা দিয়ে দেশ বা দলকে জিতিয়ে দিয়েছেন।’ এ কথাটি কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
উত্তর: ৫
কোন দুর্বল দেশ বা দল কোন কারণে হঠাৎ জয়লাভ করার কারণে অনেকে বলেছে যে, স্বয়ং আল্লাহ নিজ হাতে দুর্বল দেশ বা দলকে জিতিয়ে দিয়েছেন কিংবা আল্লাহ ফিরিশতা দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাদের এ কথাটি বলাও শুদ্ধ হয়নি। বরং কুফরী হয়েছে। কারণ আল্লাহ বলেন,
تعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدوان واتقوا الله ان الله شديد العقاب.
অর্থ: “তোমরা পরস্পর পরস্পরকে নেক কাজ ও পরহেযগারীর মধ্যে সাহায্য কর, পাপ ও শত্রুতার মধ্যে সাহায্য করনা। (এ বিষয়) তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কঠিন শাস্তিদাতা।” (সূরা মায়িদা-২)
উক্ত আয়াত শরীফে আল্লাহ নিজেই তাঁর বান্দাদেরকে পাপ কাজে সাহায্য করতে নিষেধ করেছেন। তাহলে আল্লাহ স্বয়ং নিজেই কি করে পাপ কাজে সাহায্য করবেন? কাজেই, যদি কেউ বলে যে, ‘আল্লাহ স্বয়ং নিজে পাপ কাজে বা হারাম কাজে সাহায্য করেন’ তাহলে সেটা কুফরী হবে। মূলতঃ আল্লাহ কোন হারাম কাজে সাহায্য করেননা।
প্রশ্ন: ৬
‘ছওয়াবের নিয়তে খেলা দেখতে যাব। আর খেলা দেখার সময় দোয়া করব যাতে মুসলমান দেশ বা দল জয়লাভ করে।’ এ কথাটিইবা কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
উত্তর: ৬
কোন মুসলমান দেশ বা দলের খেলার দিন অনেকে বলেছে, ছওয়াবের নিয়তে খেলা দেখতে যাব আর খেলা দেখার সময় দোয়া করব যাতে মুসলমান দেশ বা দল জয়লাভ করে। একথা বলা শুদ্ধ নয়। বরং কুফরী। কেননা, শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম কাজের জন্য দোয়া করা যেরূপ হারাম ও কুফরী তদ্রুপ হারাম কাজে মশগুল ব্যক্তি বা দলের জন্যও দোয়া করা হারাম। এর প্রমাণ হাদীছ শরীফেই রয়েছে। যেমন, ইরশাদ হয়েছে,
عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنه قال مر رجل وعليه ثوبان احمران فسلم على النبى صلى الله عليه وسلم فلم يرد عليه النبى صلى الله عليه وسلم السلام.
অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা লাল বর্ণের দু’টি কাপড় (ইযার ও চাদর) পরিহিত এক ব্যক্তি হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে সালাম দিল। কিন্তু হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সালামের জাওয়াব দেননি।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, মিশকাত, নাইলুল আওতার)
উক্ত হাদীছ শরীফদ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, পুরুষদের জন্য লাল কাপড় পরিধান করা নিষেধ বা হারাম। আর হারাম কাজে মশগুল এমন ব্যক্তির সালামের জাওয়াব দেয়াও নিষেধ। উল্লেখ্য, ‘সালাম’ হচ্ছে একজন মুসলমানের তরফ থেকে আরেকজন মুসলমানের প্রতি সাধারণভাবে দোয়াস্বরূপ। এখন এই সাধারণ দোয়াটাই যদি হারাম আমলকারী ব্যক্তির জন্য দেয়া বা করা নিষেধ হয় অর্থাৎ সালামের জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও হারামে মশগুল থাকার কারণে যদি ওয়াজিব সাকেত হয়ে যায় তাহলে খেলাধুলার মত এত বড় হারাম কাজে মশগুল ব্যক্তিদের জন্যে দোয়া করা কত বড় গুনাহ্র কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শরীয়তের মাসয়ালা হলো, হারাম কাজে মশগুল ব্যক্তির হারাম কাজে তরক্কীর জন্য দোয়া করা কুফরী।
প্রশ্ন: ৭
লেখাধূলার পক্ষে মাও. আশরাফ আলী থানভী ও পাকিস্তানের মুফতী শফির খেলা সম্পর্কিত বক্তব্য কতটুকু সঠিক?
উত্তর: ৭
অনেকে আশরাফ আলী থানভী ছাহেবের ‘বেহেস্তী জিওরের’ এবং পাকিস্তানের মুফ্তী শফি ছাহেবের অনুবাদকৃত “আদাবুন্ নবী” কিতাবের বরাত দিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ এ সমস্ত খেলাকে মুবাহ বা পছন্দনীয় সাব্যস্ত করতে চায়, যা সম্পূর্ণ ভুল ও নফজ পূজারই নামান্তর। কেননা কোন ব্যক্তি বিশেষকে চাই আশরাফ আলী থানভী ছাহেব হোক বা মুফ্তী শফি ছাহেব হোক অথবা অন্য কাউকে শরীয়ত দলীল হিসেবে সাব্যস্ত করেনা।
অর্থাৎ আশরাফ আলী থানভী ছাহেব ও মুফ্তী শফি ছাহেব কোন বিষয়ে জায়িয ফতওয়া দিলেই তা জায়িয হবে অথবা নাজায়িয ফতওয়া দিলেই তা নাজায়িয হবে, তা শরীয়তের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বরং শরীয়তের দলীল হচ্ছে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ ও তার আলোকে ইজ্মা ও ক্বিয়াস।
আশরাফ আলী থানভী ছাহেব ও মুফ্তী শফি ছাহেব তাদের উল্লিখিত কিতাবদ্বয়ে ফুটবল, হকি ও ক্রিকেট খেলাকে মুবাহ্ ও পছন্দনীয় বলেছে, তবে তারা তার আগে ও পরে কিছু শর্ত শারায়েতও উল্লেখ করেছে। সে সমস্ত শর্ত শারায়েতের কারণে কোন প্রকার খেলাই জায়িয হতে পারেনা, যা শরীয়ত নিষেধ করেছে।
আশরাফ আলী থানভী ছাহেবের প্রদত্ত শর্তগুলি হলো:
(১) সময় নষ্ট,
(২) পয়সা নষ্ট,
(৩) কাজ নষ্ট,
(৪) নামাজ ক্বাজা,
(৫) ছতর খোলা,
(৬) কুসংসর্গে মেশা ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে পারলে মুবাহ্ হবে।
আর মুফ্তী শফি ছাহেবের প্রদত্ত শর্তগুলি হলোঃ
(১) ফরজ তরক,
(২) হারামে পতিত ও
(৩) কাফেরদের নির্ধারিত নিয়মাবলীর মধ্যে খেলা ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে পারলে মুবাহ্ বা পছন্দনীয় হবে।
মূলতঃ এসব খেলাতে উপরোক্ত শর্ত সমূহের কোন কোনটা থেকে যদিও বেঁচে থাকা সম্ভব হয়, কিন্তু সময় নষ্ট, বিধর্মীদের নিয়মনীতি অনুসরণ, স্বাস্থ্য নষ্ট, পয়সা নষ্ট, কাজ নষ্ট ইত্যাদি শর্ত থেকে বেঁচে থাকা কখনই সম্ভব হবেনা। এরপরেও বলতে হয় যে, উপরোক্ত শর্ত-শারায়েত দিয়ে উল্লিখিত খেলা সমূহকে মুবাহ্ বা পছন্দনীয় বলে উল্লেখ করাটা আশরাফ আলী থানভী ছাহেব এবং মুফ্তী শফি ছাহেবের জন্যও সঠিক হয়নি। কেননা তাদের এ ফতওয়ার কারণে অনেকেই ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হারামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর অনেকেই হারামকে হালাল করার পায়তারা করছে। অথচ তাদের উল্লিখিত শর্ত-শারায়েত ছাড়াও খেলা হারাম হওয়া সম্পর্কে আরো অনেক কারণ উল্লেখ করেছেন অন্যান্য ইমাম-মুজ্তাহিদগণ।
যেমন:
(১) স্বাস্থ্য নষ্ট হয়,
(২) খেলায় প্রতিযোগীতা থাকে,
(৩) বাজি ধরে,
(৪) পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পয়দা হয়,
(৫) খেলার কারণে সমাজে ফিৎনার সৃষ্টি হয়,
(৬) বেদ্বীন ও বদ্দ্বীনী আমল করে,
(৭) রং ছিটাছিটি করে,
(৮) বেপর্দা হয়,
(৯) সমাজ ও দেশ-বিদেশের লোকেরা হারাম কাজে মশগুল হয়,
(১০) হারাম কাজে উৎসাহিত করে,
(১১) বাহবা দেয়,
(১২) হাতে তালি দেয়,
(১৩) অভিনন্দন জানায়,
(১৪) আর্থিক সহযোগীতা করে,
(১৫) খুশী প্রকাশ করে,
(১৬) হারামকে হালাল বলে,
(১৭) ঈমান নষ্ট করে,
(১৮) বিধর্মীদের অনুসরন করে,
(১৯) মারামারি কাটাকাটি করে,
(২০) খুন খারাবি করে ও
(২১) রক্ত প্রবাহিত করে ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, কোন হারামকে শর্ত সাপেক্ষে মোবাহ বলে ফতওয়া দেয়ার অর্থ হলো হারামকে হালাল বলে সাব্যস্ত করার নামান্তর। যা শক্ত গুনাহ্’র অন্তর্ভুক্ত। এখন অনেকে বলতে পারে যে, “শরীয়তে মৃত গরু, ছাগল, বকরী, ভেড়া ইত্যাদি খাওয়া নাজায়িয। কিন্ত যদি কেউ তিন দিন না খেয়ে থাকে তাহলে তার জন্য জরুরত আন্দাজ উল্লিখিত মৃত প্রাণীর গোশ্ত খাওয়া মুবাহ। তাহলে কি এখানে এ ফতওয়ার দ্বারা হারামকে হালাল বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে? কেননা এখানেও শর্ত দিয়ে মৃত প্রাণীর গোশ্ত খাওয়াকে মোবাহ্ বলা হয়েছে।”
এর জাওয়াব হচ্ছে, প্রাণ বা জান রক্ষা করা হচ্ছে ফরজ। আর প্রাণ রক্ষা করার জন্য খাদ্য গ্রহণ করা বা খাওয়াও ফরজ। সুতরাং প্রাণ রক্ষা করার জন্য যদি কেউ হালাল খাদ্যের ব্যবস্থা করতে না পারে এমতাবস্থায় তিনদিন অতীত হয়ে যায়।
অর্থাৎ তিনদিন অনাহারে কেটে যায় অথচ ফরজ পরিমাণ খাদ্য সে সংগ্রহ করতে পারল না, তখন সে মাজুর হয়ে যায় এবং তখনই তার জন্য অর্থাৎ এই মাজুরের জন্য হারাম মোবাহ হয়ে যায়। শরীয়তের দৃষ্টিতে মাজুর ঐ ব্যক্তি যাকে জীবন রক্ষা বা ফরয-ওয়াজিব পালন করার পূর্ব শর্ত হিসেবে শরীয়তের খেলাফ কোন কাজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও করতে হয়। আর এ সমস্ত খেলাধুলা কারো জন্য ফরজ-ওয়াজিব নয় এবং এ সমস্ত খেলাধুলার জন্য কোন ব্যক্তি কখনই মাজুরও হয় না। কাজেই কোন ব্যক্তি যদি কোন বিষয় মাজুর না হয় তাহলে তার জন্য শর্ত শারায়েতের কি প্রয়োজন থাকতে পারে?
মাওলানা মুহম্মদ রুহুল আমীন বশীরহাটি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“জায়িয কাজ দ্বারা যখন ব্যায়াম করার উপায় আছে, তখন নাজায়েয কাজের দ্বারা কিরূপে জায়েয হবে? খেলার প্রতিযোগীতা করলে কি ফল হবে? কিন্তু লাঠি, তীর ছোড়া, তরবারী ভাঁজা, ঘোড়-দৌড় ইত্যাদিতে শত্রুদের হস্ত হতে কতকটা নিষ্কৃতি লাভের উপায় হতে পারে। পক্ষান্তরে খেলাতে এই প্রকার কোন লাভ হতে পারে না। বরং ওটা খাঁটি খেলবাজি ভিন্ন আর কিছুই নয়। কাজেই ওটা কিছুতেই জায়িয হতে পারে না। কেবল দুনিয়াদার স্বার্থপর আলেম দু’একজন ওটা জায়েয হওয়ার ফতওয়া দিয়েছেন। তাদের ফতওয়া কিছুতেই গ্রহণীয় হতে পারে না। (ফতওয়ায়ে আমিনিয়া)
অতএব, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ইত্যাদি সম্পর্কিত থানবী ও শফি ছাহেবের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ভুল ও দলীলবিহীন, তাই তাদের উক্ত বক্তব্য দলীল হিসেবে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বরং শরীয়তের ফায়ছালা হলো, প্রত্যেক প্রকার খেলাই নাজায়িয ও হারাম।
এক মুসলমান ভাই, অন্য মুসলমান ভাইয়ের জন্য আয়না স্বরূপ, একজন ভুল করলে অন্যজন তা ধরিয়ে দেয়াই মুসলিম ভাইয়ের কাজ। মনে রাখতে হবে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, পরকাল চিরস্থায়ী। তাই কেউ না বুজে না জেনে কোন হারাম করলে তা শুধরিয়ে দেয়া উচিন, না হলে পরকালে প্রত্যেককেই তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন