লিখেছেন লুক্স
আমাদের ভূগোল স্যার আসলে ভূগোল স্যার ছিলেন না। তিনি ভূগোলের চেয়েও বেশি ইসলাম ধর্ম পড়াতেন। পড়াতেন মানে সারাক্ষণ কোরান-হাদিসের আলোকে জীবন গড়ার জন্য আমাদের পিছে সুপার-গ্লুর মতো লেগে থাকতেন। আর পরীক্ষা শেষ হলেই আমাদেরকে ছোঁ মেরে তাবলিগে নিয়ে যাবার ধান্দা করতেন।
আমার জীবনে তিনিই একমাত্র শিক্ষক ছিলেন, যিনি ছাত্রদেরকে নামাজ না পড়ার জন্য মারতেন। সেকি আর যেন তেনো মাইর, জালি বেতের বাড়ি। বেতের বাড়িগুলো কালো হয়ে শরীরে জমে থাকতো পুরা এক সপ্তাহ।
স্কুলের পাঠ্যক্রমে নামাজ পড়া অন্তর্ভূক্ত না থাকলেও স্যারের মাইর খেয়ে বেহেস্তে যাওয়া যাবে ভেবে আমরা সে মাইরের কথা ভুলে যেতাম। স্যার আমাদেরকে নামাজ না পড়ার কারণে মেরেছেন শুনলে আমাদের সবার বাবা-মা'রাও খুশি হতেন।
এরকম ঘটনা আপনাদের প্রায় সবার জীবনেই আছে আন্দাজ করতে পারছি। বাংলাদেশে এমন ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক ঘটনা হচ্ছে, আমার সেই ভূগোল স্যার শুধু আমাদেরকে নামাজ পড়িয়েই ছাড়েননি। স্যারের কড়া হুকুম ছিল - আমাদের কপালে নামাজ পড়ার কালো দাগ থাকতে হবে। মুমিন মুসলমানের কপালে নামাজের কালো দাগ থাকা সুন্নত এবং তার সৌন্দর্য নূরের আলোর মতো। তাই স্যার দেখা হলেই কড়া গলায় জিজ্ঞেস করতেন, "কিও মিয়া, কপালে নামাজের দাগ নাই কেন তোমার? মুমিন মুসলমানের বাচ্চা না তুমি? পরকালে আল্লাহরে কি জবাব দিবা?"
বলতাম, "স্যার, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তো পড়তেছি। কপালে দাগ না পড়লে কি করবো স্যার? সময় দেন স্যার, দাগ পড়ে যাবে।"
আমি আমার শরীর আর চেহারার যত্ন নিতাম। তার ওপরে মনে মনে এরই মধ্যে নাস্তিক। ধর্মের ভগিজগি বুঝতে শুরু করেছি। নিজের কপালে নামাজ পড়ে দাগ ফেলার প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু আমার এক প্রিয় বন্ধুর ততোদিনে সর্বনাশ হয়ে গেছে। ভূগোল স্যার আর বাবা-মাকে খুশি করে আমার বন্ধুটা মসজিদের মেঝেতে সিজদা দিতে দিতে তার কপালে কালো দাগ ফেলে দিয়েছে। নামাজ যতো পড়ে তার কপালের দাগ ততো মোটা হয়। এসএসসি পাশ করতে করতে বন্ধুর কপালে সার্টিফিকেটের মতো জ্বলজ্বল করছিল সেই নামাজের নূরানী দাগ।
বন্ধু ভালো ছাত্র। আরো বছর তিনেক পর কলেজ পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেল ব্রিটেনে। আবারো সর্বনাশ হলো আমার প্রিয় বন্ধুর। উন্নত ব্রিটেনের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, সর্বত্র বিজ্ঞান ও সততার চর্চা, আর সমাজে এর প্রভাব দেখে আমার বন্ধু গেলো নাস্তিক হয়ে। নাস্তিকের কপালে নামাজের নূরানী দাগ, ব্রিটেনে বন্ধুর ঘুম হয় না।
আমাকে ফোন করে এর একটা সমাধান চাইলো বন্ধু, "কপালের দাগ তো যায় না রে, একটা কিছু উপায় বল, দোস্ত।"
আমি সেদিন রাগ করে বন্ধুকে বলেছিলাম, "তোর সেই পেয়ারের ভূগোল স্যারেরে জিগা।"
বন্ধু আসলেই ভাল ছাত্র ছিল। আজ বিশ বছর পর বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তার কপালের সেই নামাজের নূরানী দাগটি আর নেই। বন্ধু হেসে বললো, "ইংল্যান্ডের উন্নত চিকিৎসায় কপালের ভুল দাগ মুছে ফেলা যায়।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন