হুমায়ুন আজদের 'আমার অবিশ্বাস' নামের বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম বেশ আগে। ধর্মকারী তখন স্থগিতাবস্থায়। কিন্তু কিছুদূর পড়ার পরে লক্ষ্য করলাম, বইটিতে উদ্ধৃতিযোগ্য ছত্রের ছড়াছড়ি। পড়া তখনই থামিয়ে দিয়ে স্থির করলাম, ধর্মকারী আবার সচল হলে ধর্মকারীর পাঠকদের (অনেকেরই বইটা পড়া আছে, জানি, তবুও...) সঙ্গে টাটকা পাঠমুগ্ধতা ভাগাভাগি করবো। তাই পড়তে শুরু করলাম আবার। বিসমিল্যা।
২১.
জ্ঞান কি মুক্ত করছে না আমাদের অজ্ঞানতা থেকে? এখনকার কিশোররাও কি অনেক ব্যাপারে বেশি জানে না আরিস্ততল, মোজেস বা মহর্ষিদের থেকে? জ্ঞান আমাদের অজ্ঞান করে না, বরং ক্রমশ আমরা নির্মোহ সত্যের দিকে এগোই, জ্ঞানী হই, যেমন আমরা পুরনো ধ্যানীদের থেকে জানি অনেক বেশি। তাঁরা আসলে কোনো সত্যই উদঘাটন করেননি, উচ্চারণ করেছেন কিছু বিভ্রান্ত শ্লোক, ওই বিভ্রান্ত উচ্চারণকে জ্ঞান বলতে পারি না।
২২.
ঐশী গ্রন্থগুলোর প্রণেতারা আজকের জ্ঞানের বিকাশের কথা কখনো ভাবতে পারেন নি।
২৩.
দান্তের ঈশ্বর বিশ্ব সম্পর্কে বেশি জানতো না, যতোটুকু জানতো তাও শিখেছিলো আলেকজান্দ্রিয়ায় টলেমির বইপত্র থেকে। ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কল্পনা আগে থেকেই ছিলো, টলেমি তা বিধিবদ্ধ করেন, যা ষোড়শশতকে, দান্দের দু-শো বছর পর, বাতিল করে দেন কোপারনিকাস; এবং প্রতিষ্ঠা করেন সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্ব।
২৪.
তাঁদের (বাঙলা লেখকদের) অধিকংশই অবিকশিত, অনেকাংশে অজ্ঞান, বিশ্বজ্ঞানের অভাবে আদিম বিশ্বাস প্রবল তাদের; তাঁরা স্বস্তি পান কুসংস্কারে, পুরোনো বাজেকথায়। কুসংস্কারকীর্তনে তাঁরা অকুণ্ঠ।
২৫.
তরুণ বয়স থেকেই অস্বস্তি বোধ করি আমি নজহরুলের লেখা পড়ার সময়; তিনি মাঝারি লেখক ব'লে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত লেখক ব'লে। তিনি ভারী বোঝার মতো চেপে আছেন বাঙালি মুসলমানের ওপর; বাঙালি মুসলমান তাঁকে নির্মোহভাবে বিচার করতে পারবে না বহু দিন। বাঙালি মুসলমান প্রগতিশীলরাও যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল, আর তারা পড়ে না, নজরুলকেও পড়ে না, শুনে শুনে বিশ্বাস করে যে নজরুল বিদ্রোহী। প্রচারে প্রচারে তাঁকে আমি বিদ্রোহী ব'লেই মনে করেছি যখন বালক ছিলাম, বেশ কিছু পদ্যেগদ্যে দেখেছিও তাঁর বিদ্রোহীরূপ, কিন্তু তিনি বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান। বেশি ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। গানের পরে গানে তিনি লিখেছেন:
নামাজ পড়, রোজা রাখ, কলমা পড় ভাই
তোর আখেরের কাজ করে নে, সময় যে আর নাই
...
শোনো শোনো য়্যা এলাহি আমার মুনাজাত
তোমারি নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত
...
আল্লাহ নামের নায়ে চড়ে যাব মদিনায়
...
মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই
...
ওরে ও দরিয়ার মাঝি! মোরে নিয়া যা রে মদিনা
...
খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে
...
আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়
আমার নবী মোহাম্মদ, যাহার তারিফ জগৎময়
অবশ্য এগুলোকে অনেকে মনে করতে পারেন খুবই বিদ্রোহী ও প্রগতিশীল কাণ্ড; কিন্তু এখানে কোনো বিদ্রোহীকে পাচ্ছি না। পাচ্ছি ইসলাম অন্ধকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন