লিখেছেন গোলাপ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬ > পর্ব ১৭ > পর্ব ১৮ > পর্ব ১৯ > পর্ব ২০ > পর্ব ২১ > পর্ব ২২ > পর্ব ২৩ > পর্ব ২৪ > পর্ব ২৫ > পর্ব ২৬ > পর্ব ২৭ > পর্ব ২৮ > পর্ব ২৯ > পর্ব ৩০ > পর্ব ৩১ > পর্ব ৩২ > পর্ব ৩৩ > পর্ব ৩৪ > পর্ব ৩৫ > পর্ব ৩৬ > পর্ব ৩৭ > পর্ব ৩৮ > পর্ব ৩৯> পর্ব ৪০ > পর্ব ৪১ > পর্ব ৪২ > পর্ব ৪৩
পৃথিবীর প্রায় সকল তথাকথিত মডারেট মুসলমান (ইসলামে কোন কোমল, মডারেট বা মৌলবাদী শ্রেণীবিভাগ নেই) গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে, স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর জীবনে অবিশ্বাসী কাফেরদের বিরুদ্ধে যতগুলো যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছেন তাঁর সমস্তই ছিল আত্মরক্ষামূলক। আক্রান্ত না হয়ে তিনি কাউকেই আক্রমণ করেননি। বিশেষ করে অতি-বৃদ্ধ, নারী ও দুর্বলদের বিরুদ্ধে তো নয়ই!
আদি ও বিশিষ্ট মুসলমানদেরই লিখিত ইতিহাসের পর্যালোচনায় আমরা জানতে পারি যে, ইসলামের হাজারও অতিকথার মতো তাঁদের এই বিশ্বাসেরও কোনো সত্যতা নেই। তাঁদের এই বিশ্বাস যে নিবেদিতপ্রাণ ইসলাম-বিশ্বাসীদের শত শত বছরের "ইসলামী মিথ্যাচার, চাতুরী ও প্রচারণার বাস্তব ফসল” তা বোঝা যায় মুহাম্মদের মৃত্যুপরবর্তী সময়ের সবচেয়ে আদি ও বিশিষ্ট ইসলাম-বিশ্বাসী ও অনুসারীদের লিখিত ইতিহাসের পর্যালোচনায়। আমরা জানতে পারি, তাঁদের ঐ দাবি ও বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
আদি উৎসের এ সকল বর্ণনা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের শৌর্যবীর্য ও ক্ষমতার উপাখ্যানের হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের পক্ষে ধারণা করাও সম্ভব ছিল না যে, তাঁদের লিখিত এই ঘটনাগুলো শত শত বছর পরে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের নৃশংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের “উল্লেখযোগ্য দলিল" হিসাবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিপাদ্য হবে।
মুহাম্মদের জীবনের “সর্বপ্রথম পুর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ”:
বইটি লিখেছেন মুহাম্মদ ইবনে ইশাক ইবনে ইয়াসার (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), আর তা লেখা হয়েছে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর নিরবিচ্ছিন্ন (Continuous) মুহাম্মদ-অনুসারী মুসলিম শাসন আমলের প্রায় ১১০ বছর পর। আর হাদিস সংকলন ও লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়েছে এরও ৯০ বছরের অধিক পর; মুহাম্মদের মৃত্যুর পর নিরবিচ্ছিন্ন মুসলিম শাসন আমলের ২০০ বছেরেরও অধিক পরে।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাক ইবনে ইয়াসারের জন্ম হিজরি ৮৫ সালে, মদিনায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেন হিজরি ১৫১ সালে, বাগদাদে। তিনি ছিলেন তৃতীয় প্রজন্মের ইসলামে নিবেদিতপ্রাণ বিশিষ্ট মুসলিম স্কলার।
তাঁর দাদা ইয়াসার বিন খেয়ার-কে খালিদ বিন ওয়ালিদ হিজরি ১২ সালে [৬৩৩ সাল] 'আয়েনুল তামীর [Aynu'l Tamir]' দখল করার পর ইরাক থেকে বন্দী করে অন্যান্য বন্দীদের সাথে মদিনায় খলিফা আবু বকরের কাছে পাঠিয়ে দেন। মদিনায় তাঁকে দাস হিসাবে কেয়াস বিন মাখরামা বিন আল-মুত্তালিব বিন আবদ-মানাফ নামক এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁর মুক্তি মেলে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে। [1]
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের বাবা ইশাক বিন ইয়াসার এর জন্ম হয় হিজরি ৫০ সালে। তাঁর বাবা এবং চাচা মুসা বিন ইয়াসার ছিলেন তৎকালীন সুপরিচিত মুহাদ্দিস। পারিবারিক শিক্ষা ও পরিবেশে মুহাম্মদ ইবনে ইশাক অল্প বয়সেই নিজেকে ইসলামিক স্কলার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি দ্বিতীয় প্রজন্মের বিশিষ্ট মুহাদ্দিসগণদের সাথে সংযুক্ত ছিলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন মুহাম্মদ ইবনে শিহাব আল-জুহরী [মৃত্যু ৭৪২ সাল], আসিম বিন উমর বিন কাতাদা এবং আবদুল্লাহ বিন আবু বকর।
৭৩৭ খৃষ্টাব্দে ইয়াজিদ বিন হাবিবের কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য মুহাম্মদ ইবনে ইশাক মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় গমন করেন। পরবর্তীতে এই ইয়াজিদ বিন হাবিবই ইবনে ইশাক-কে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানে তাঁর উদ্ধৃতি ব্যবহার করতেন।
এক কিংবা দুই বছর পর তিনি মদিনায় ফেরত আসেন। কিন্তু তিনি আবার মদিনা ছাড়তে বাধ্য হন, সম্ভবত, মালিক বিন আনাসের শত্রুতার কারণে (যদিও এই কারণটির ব্যাপারে মতভেদ আছে); তারপর তিনি বেশ কিছু বছর যাবত কুফা, বসরা, রেয় (Ray) সহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাদান করেন। তিনি, সম্ভবত, ৭৬৩ সালে বাগদাদে স্থায়ী হন। সেখানেই তিনি আনুমানিক ৭৬৮ সালে মৃত্যু বরণ করেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের রচিত মুহাম্মদের জীবনের “সর্বপ্রথম পুর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ” বইটির আগে মুহাম্মদের জীবনের ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা সংক্রান্ত লেখার’, যার অধিকাংশই লুণ্ঠন ও আক্রমণ (Raid/Maghazi) বিষয়ক, যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে।
তাই এই বইটিই মুহাম্মদ ইবনে ইশাক পরবর্তী ইসলাম ইতিহাসবিদদের লিখিত মুহাম্মদের জীবনীগ্রন্থের “মূল রেফারেন্স”। [2][3]
"মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের মূল পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে গিয়েছে।"
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের মূল পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে গিয়েছে, যা তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার মৌখিক বর্ণনা [Oral tradition] বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহের মাধ্যমে।
“মূল পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে গিয়েছে”, এই তথ্যটিকে পুঁজি করে ডিজিটাল যুগের তথাকথিত ইসলাম পণ্ডিত ও সুবিধাবাদীরা ঘোষণা দেন যে, মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের এই বিপুলায়তন গবেষণালব্ধ বইটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা বিভ্রান্ত করেন সাধারণ মুসলমানদের।
সত্য হচ্ছে, যে-কারণে এই সুবিধাবাদীরা মুহাম্মদের জীবনের নেতিবাচক হাদিস অথবা "সম্পূর্ণ হাদিস-গ্রন্থকেই" অস্বীকার করেন (Quran only Muslim), সেই একই কারণে তাঁরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের ‘সিরাত’-কেও অস্বীকার করেন। মুহাম্মদের জীবনের কোনো নেতিবাচক ইতিহাসকেই তাঁরা সঙ্গত কারণেই গ্রহণ করতে অসমর্থ। ইসলামের একান্ত প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত অনুযায়ী তাঁরা একেবারেই অসহায় (বিস্তারিত দশম পর্বে)! ইসলামী পরিভাষায় যার নাম আল ওয়ালা ওয়াল বারা (Al wala wal Bara)। [4]
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের বিপুলায়তন গবেষণালব্ধ লেখাগুলো বর্তমান যুগের বইয়ের মত গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। লিখাগুলোর অনুলিপি (Copy) ও তাঁর দেয়া শ্রুতলিপি (Dictation) সংরক্ষণ করেছিলেন তাঁর কিছু ছাত্র। পরবর্তীতে তাঁদের কাছ থেকে সংকলন করে ইসলামে নিবেদিত অন্যান্য বিশিষ্ট মুসলিম স্কলাররা তা বই আকারে প্রকাশ করেছেন।
কম পক্ষে ১৫ ব্যক্তি (Riwayas) মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের মূল লিখার (lost original) অনুলিপি ও শ্রুতলিপি সংরক্ষণ করেছিলেন। তাঁরা হলেন:
১) ইবরাহিম বিন সা'দ (১১০-১৮৪ হিজরি) - মদিনা
২) জিয়াদ বিন আবদুল্লাহ আল-বাক্কাই (মৃত্যু ১৮৩ হিজরি) - কুফা
৩) আবদুল্লাহ বিন ইদ্রিস আল-আউদি (১১৫-১৯২ হিজরি) - কুফা
৪) ইউনুস বিন বুকায়ের (মৃত্যু ১৯৯ হিজরি) - কুফা
৫) আবদা বিন সুলেইমান (মৃত্যু ১৮৭/১৮৮ হিজরি) - কুফা
৬) আবদুল্লাহ বিন নুমায়ের (১১৫-১৯৯ হিজরি) - কুফা
৭) ইয়াহায়া বিন সাইয়িদ আল-উমায়ায়ি (১১৪-১৯৪ হিজরি) - বাগদাদ
৮) জারির বিন হাজিম (৮৫-১৭০ হিজরি) - বসরা
৯) হারুন বিন আবু ইসা - বসরা?
১০) সালামাহ বিন আল ফাদল আল আবরাশ (মৃত্যু ১৯১ হিজরি) - রেয় (Ray)
১১) আলি বিন মুজাহিদ (মৃত্যু ১৮০ হিজরি) - রেয়
১২) ইবরাহিম বিন আল-মুখতার - রেয়
১৩) সাইয়িদ বিন বাজি - রেয়
১৪) উসমান বিন সায
১৫) মুহাম্মদ বিন সালামা আল-হাররানি (মৃত্যু ১৯১ হিজরি) [5]
জিয়াদ বিন আবদুল্লাহ আল-বাক্কায়ি ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের ছাত্র। তিনি ইবনে ইশাকের সম্পূর্ণ বইটির দু'টি কপি সংরক্ষণ করেছিলেন, যার একটি অবশ্যই আবু আল-মালিক বিন হিশামের [সংক্ষেপে, ইবনে হিশাম - মৃত্যু ৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ] কাছে পৌঁছেছিল। ইবনে হিশাম সেই বইটির কিছু অংশ বর্জন, সংক্ষিপ্ত, টীকাযুক্ত এবং কখনো সখনো পরিবর্তন করে সংশোধিত (Recension) রূপে ‘সিরাত রাসুল আল্লাহ’ নামে বই আকারে সম্পাদনা করেছেন। [6]
ইবনে হিশাম সম্পাদিত ‘সিরাত রাসুল আল্লাহ’ বইটিই হলো মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের মূল বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (Main body of knowledge) সংস্করণ।
ইবনে হিশাম যে মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের মূল বইটির কপি থেকে কিছু অংশ বর্জন, সংক্ষিপ্ত ও কখনো সখনো পরিবর্তন করেছেন তা তিনি গোপন করেননি।
ইবনে হিশাম তাঁর সম্পাদকীয় ব্যাখ্যায় (Editorial comments) লিখেছেন:
“আল্লাহর ইচ্ছায় আমি [ইবনে হিশাম] এই বইটি শুরু করবো ইবরাহিমের পুত্র ইসমাইল দ্বারা এবং একে একে উল্লেখ/বর্ণনা করবো তাঁদের সেই সন্তানদের বিষয়ে জানা বিবরণ, যাঁরা ছিলেন আল্লাহর নবীর পূর্বপুরুষ। সংক্ষিপ্ততার জন্য [আমি] ইসমাইলের অন্যান্য সন্তানদের বর্ণনায় যাব না। আমি নিজেকে সংযত রাখবো নবীর জীবন-কাহিনীর ওপর এবং ইবনে ইশাকের লিপিবদ্ধ কতিপয় ঘটনা বর্জন করবো:
[১] যেখানে আল্লাহর নবীর কোনো উল্লেখ নেই ও
[২] যে ব্যাপারে কুরানে কিছুই বলা হয়নি ও
[৩] যা এই বইয়ের কোনো বিষয়েরই সাথে প্রাসঙ্গিক নয় এবং যার কোনো ব্যাখ্যা বা সাক্ষ্য নেই;
[৪] তাঁর দেয়া কবিতার উদ্ধৃতি যা আমার জানা কোনো কর্তৃপক্ষ জ্ঞাত নয়;
[৫] যে বিষয়ের আলোচনা লজ্জাকর (disgraceful);
[৬] যে বিষয় কিছু মানুষের মর্মপীড়ার (distress) কারণ হতে পারে; এবং
[৭] ঐ সমস্ত বিষয় যা আল-বাক্কাই [ইবনে ইশাকের ছাত্র] আমাকে নির্ভরযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন
- এই সবকিছুই আমি বর্জন করেছি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি প্রাপ্ত বাকি সমস্ত বিষয়ের বিশদ বিবরণ পেশ করবো যা পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য।" [7]
- অনুবাদ, নম্বর যোগ ও [**] যোগ - লেখক।
“God willing I shall begin this book with Ismail son of Ibrahim and mention those of his offspring who were the ancestors of God’s apostle one by one with what is known about them, taking no account of Ismail’s other children, for the sake of brevity, confining myself to the prophet’s biography and omitting some of the things which I.I [Ibne Ishaq] has recorded in this book in which there is no mention of the apostle and about which the Quran says nothing and which are not relevant to anything in this book or an explanation of it or evidence for it; poems which he quotes that no authority in poetry whom I have met knows of; things which it is disgraceful to discuss; matters which would distress certain people; and such reports as al-Bakkai [Student of Ibn Ishaq] told me he could not accept as trustworthy – all these things I have omitted. But God willing I shall give a full account of everything else so far as it is known and trustworthy tradition is available.” [7]
>>> অর্থাৎ মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের রচিত "মুহাম্মদের জীবনীগ্রন্থ" এর যে-ভার্সনটি ইবনে হিশাম "সিরাত রাসুল আল্লাহ" নামে সংকলন করেছেন, শুধু সেই ভার্সনটি পড়ে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের জীবনের আর ও গভীর ও অন্ধকার কর্মকাণ্ডের ইতিহাস জানার কোনো সুযোগ নেই।
কারণ যদিও মুহাম্মদ ইবনে ইশাক তাঁর মূল পাণ্ডুলিপিতে সেই ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, ইবনে হিসাম তাঁর সংকলন গ্রন্থে তা বর্জন করেছেন, এই বিবেচনায় যে সেই সমস্ত বর্ণনাগুলো এতই লজ্জাকর যে, তা কিছু মানুষের মর্মপীড়ার কারণ হতে পারে।
মুহাম্মদের জীবনের আরও গভীর অন্ধকার ও লজ্জাকর ইতিহাস জেনে যে সমস্ত লোকের "মর্মপীড়া" হতে পারে, সেই "কিছু লোকেরা" কারা? নিশ্চয়ই তাঁরা কোনো মুহাম্মদ অবিশ্বাসী কাফের-মোনাফেক-মুরতাদকুলের সদস্য নয়?
তাঁরা নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ অনুসারী। নবী মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের গর্হিত কর্মকাণ্ডের পরিচয় পেয়ে মুহাম্মদ অনুসারী ভক্ত কুলের অনেকেই লজ্জিত ও মর্মাহত হতে পারেন, এমন বিবেচনা মাথায় রেখে ইবনে হিশাম তাঁর এই সংকলন গ্রন্থে ইবনে ইশাকের মূল বইটি থেকে এ সংক্রান্ত "বিশেষ অংশগুলো" বর্জন করেছেন।
ইবনে ইশাকের মূল বইটির যে-অংশগুলো ইবনে হিশাম বর্জন করেছেন, তার অনেক অংশই অন্যান্য উৎসগুলো থেকে পুনরুদ্ধার করা যায়। যেমন: [8]
১) সালামাহ বিন ফাদল আল-আবরাশ আল-আনসারী
মুহাম্মদ ইবনে যারির আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ সাল) তাঁর “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক” বইতে এই উৎসটি উদ্ধৃত করেছেন। [9]
২) ইউনুস বিন বুকায়ের
ইসমাইল ইবনে কাথির (১৩০১-১৩৭৩ সাল) তাঁর ‘Usdu'l-Ghaba’ বইতে এই উৎসটি ব্যবহার করেছেন। [10]
৩) হারুন বিন আবু ইসা
মুহাম্মদ ইবনে সা'দ (৭৮৪-৮৪৫ খৃষ্টাব্দ) ইউনুস বিন বুকায়ের ও এই উৎসটি তাঁর "কিতাব আল-তাবাকাত আল-কাবির'" গ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। [11]
৪) মুহাম্মদ বিন উমর আল-ওয়াকিদি (৭৪৭-৮২৩ সাল)
তাঁর অনেক লেখার মধ্যে বর্তমানে শুধু তাঁর কিতাব আল মাঘাজি (Maghazi) বইটিই টিকে আছে। [12]
৫) অন্যান্য: আবু আল ওয়ালিদ মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল-আজরাকি (মৃত্যু ২৩০ হিজরি); আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন মুসলিম বিন কেতায়েবা (মৃত্যু ২৭০ হিজরি); আহমদ বিন ইয়াহায়া আল-বালাধুরি (মৃত্যু ২৭৯ হিজরি); আবু সাইয়িদ আল হাসান বিন আবদুল্লাহ আল সিরাফি (মৃত্যু ৩৬৮ হিজরি); আবু আল হাসান বিন আলি আল আথির (মৃত্যু ৬৩০ হিজরি)।
>>> পাঠক, কল্পনা করুন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী জামাত-রাজাকার-আলবদর অথবা আফগানিস্তানের তালিবানদের নিরবচ্ছিন্ন ১১০ বছরের শাসন আমলের পর তাঁদেরই সর্বোচ্চ শীর্ষ নেতার “জীবনী-ইতিহাস" লিখেছেন সেই একই শীর্ষ নেতার অনুসারী গুণমুগ্ধ নিবেদিতপ্রাণ এক ব্যক্তি। কী ভাবে? তাঁর চারপাশের অন্যান্য গুণমুগ্ধ "ঐ একই নেতার" নিবেদিতপ্রাণ অনুসারীদের মৌখিক বর্ণনার উপর ভিত্তি করে।
আর সেই একই শাসক দলের ২০০ বছরের অধিক শাসন আমলের পর “হাদিস-গ্রন্থ” লিখেছেন সেই একই শীর্ষ নেতার গুণমুগ্ধ নিবেদিত প্রাণ কিছু অনুসারী তাঁদের চারিপাশের অন্যান্য গুণমুগ্ধ অনুসারীদের মৌখিক বর্ণনার উপর ভিত্তি করে।
বলা হয়, "ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল হলো কুরান"।
এই উক্তিটির মধ্যে যে সত্যতা আছে, তাকে "মন্দের ভাল" নামে আখ্যায়িত করা গেলেও উক্তিটির মধ্যে বাস্তবতার কোনো লেশমাত্র নেই! কারণ,
১) কুরান নামের এই গ্রন্থটিরও রচয়িতা ইসলামের শীর্ষ নেতা বিজয়ী মুহাম্মদ স্বয়ং!
অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে যে সকল বিবরণ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তা “সম্পূর্ণই বিজয়ী মুহাম্মদের বক্তব্য"! তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের কাছে পরাজিত কোনো অবিশ্বাসীর প্রামাণিক সাক্ষ্যের কোনো অস্তিত্বই এই গ্রন্থে নেই।
২) আরও সমস্যা হলো, এই গ্রন্থটি “এতই অসম্পূর্ণ” যে, তা বুঝতে দরকার হয় "শানে নজুল" নামক এক একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদানের।
শানে নজুল না জেনে শুধুমাত্র কুরান পড়ে কথিত এই "ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দলিল"-এর মর্ম উদ্ধার করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ, "শানে নজুল" নামক এই একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদানেই বর্ণিত আছে মুহাম্মদ তাঁর জীবনের কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে “কোন শ্লোক"-টি রচনা করেছিলেন।
সমস্যা হলো, মুহাম্মদের রচিত অসম্পূর্ণ কুরানের মর্ম উদ্ধারের জন্য "শানে নজুল" নামের এই একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদান কুরানে পাওয়া যায় না!
উপায়?
খোঁজ করুন সেই উৎসের, যেখানে "শানে নজুল" নামের এই একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়া যায়!
কী সেই উৎস?
"শানে নজুল" নামের এই একান্ত প্রয়োজনীয় মহামূল্যবান উপাদানটির একমাত্র উৎস হলো "সিরাত-হাদিস"।
কারা সেই "সিরাত-হাদিসের" জন্মদাতা?
তাঁরা হলেন, কুরান নামের অসম্পূর্ণ বইটির রচয়িতা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এরই একান্ত গুণমুগ্ধ নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী! যে অনুসারীদের (লেখক ও বর্ণনাকারী) একমাত্র কর্তব্য হলো সর্বাবস্থায় তাঁদের প্রিয় নবীর প্রশংসা করা ও তাঁর যাবতীয় কথা ও কাজের বৈধতা প্রদান করা। অন্যথায় তাঁদের সেই প্রিয় নবীরই অন্যান্য গুণমুগ্ধ নিবেদিতপ্রাণ অনুসারীদের হাতে তাঁদের "খুন হওয়ার" সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। [13]
জগতের প্রায় সকল ইসলাম-বিশ্বাসী "অবিশ্বাসীদের লেখা" কোনো ইসলামের ইতিহাসকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না।
কারণ, তাঁদের সদা সন্দেহ এই যে, অবিশ্বাসীরা চক্রান্ত করে ইসলামের ইতিহাস ও তাঁর প্রচারক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ইতিহাস বিকৃত করতে পারে।
অবিশ্বাসীরাও কি সেই একইভাবে সন্দেহ করতে পারেন না যে, মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের রচিত (কুরান, সিরাত-হাদিস) ইসলামের ইতিহাস পক্ষপাতদুষ্ট?
জবাব: অবশ্যই পারেন! কিন্তু তা একেবারেই অর্থহীন।
কারণ, অবিশ্বাসীদের সামনে ইসলামের ইতিহাস ও তাঁর প্রচারক মুহাম্মদকে জানার যে একটি মাত্র পথ খোলা আছে, তা হলো প্রচারক মুহাম্মদের স্বরচিত ব্যক্তিমানস জীবনী (Psycho-biography) কুরান ও তাঁর গুণমুগ্ধ অনুসারীদের নিরবচ্ছিন্ন দুইশত বছরের শাসন আমলে নিবেদিত প্রাণ অনুসারীদের লেখা সিরাত ও হাদিস।
তাঁরা অন্য কোনো বিকল্প ইতিহাসের অস্তিত্ব অবশিষ্ট রাখেননি। তাই, ইসলামের ইতিহাস জানার জন্য বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সবাইকেই "কুরান-সিরাত-হাদিস"-এর ওপরই নির্ভর করতে হয়। আমরা আলোচনা করছি তাঁদেরই রচিত ইসলামের ইতিহাসের আলোকে। অবিশ্বাসীদের লেখা কোনো ইতিহাস নিয়ে নয়।
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা
[1] মুহাম্মদ ইবনে ইশাক
[2] “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা (ভূমিকা) -xiii http://www.justislam.co.uk/images/Ibn%20Ishaq%20-%20Sirat%20Rasul%20Allah.pdf
[3] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৬, ইংরেজী অনুবাদ: W. Montogomery Watt and M.V. McDonald, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৮, ISBN 0-88706-706-9 [ISBN 0-88706-707-7 (pbk)], পৃষ্ঠা xii
[4] আল ওয়ালা ওয়াল বারা (Al wala wal Bara)
[5] Ibidইবনে ইশাক, A. Guillam introduction – পৃষ্ঠা (ভূমিকা) xxx
[6] Ibidইবনে ইশাক- A. Guillam introduction – পৃষ্ঠা (ভূমিকা) xvii
[7] Ibid ইবনে ইশাক - পৃষ্ঠা ৬৯১
[8] Ibidইবনে ইশাক- A. Guillam introduction – পৃষ্ঠা (ভূমিকা) xxxi-xxxiii
[9] মুহাম্মদ ইবনে যারির আল-তাবারী
[10] ইসমাইল ইবনে কাথির
[11] মুহাম্মদ ইবনে সা'দ
[12] মুহাম্মদ বিন উমর আল-ওয়াকিদি
[13] ইসলাম ত্যাগ ও তার সমালোচনার শাস্তি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন