বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০১৪

Oh My God - নাস্তিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি রিভিউ

লিখেছেন ভীতুর ডিম

Oh My God” – একটি জনপ্রিয় হিন্দি মুভি। উমেশ শুক্লা নির্দেশিত এবং অক্ষয় কুমার ও পরেশ রাওয়াল প্রযোজিত ফিল্মটি বেশ দ্বন্দ্বমূলক। মুভিটি অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম “The Man Who Sued God” থেকে প্রভাবিত। দ্বন্দ্বমুলক এই কারণে বললাম, কারন ফিল্মটা রিলিজ করার পর জলন্ধর মহিলা কংগ্রেস-এর প্রেসিডেন্ট নিমিসা মেহতা অক্ষয় কুমার এবং পরেশ রাওয়ালের ওপর অভিযোগ জানান এই বলে যে, ফিল্মটাতে হিন্দুধর্মের বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হয়েছে। আর এই কারণে সেই সময় অক্ষয়কুমারের নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়, যাতে তার কোনো বিপদ না হয়। বেশ কিছু মুসলিম দেশে ফিল্মটি ব্যান করা হয়। কয়েকদিন আগে ১২ ই জুলাই ২০১৪ মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট নোটিশ দিয়েছে, এতে নাকি হিন্দুবিশ্বাসের উপর আঘাত হানা হয়েছে। হায়রে হিন্দু … হায়রে মুসলিম... কবে তোরা মানুষ হবি !

আমাদের আলোচনার বিষয় এই মুভিতে কে কেমন অভিনয় করেছে, তা নয়; কত টাকার ব্যবসা করেছে, তা-ও নয়; আলোচনার বিষয় হবে এর বিষয়বস্তু। এবং মুভিটি আমাদের কী মেসেজ দিতে চেয়েছে, তা নিয়ে।

তাহলে এগোন যাক! আমার বন্ধুদের অনেকেই হয়ত মুভিটি দেখেছেন! যদি না দেখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই দেখুন। তাই আমরা আগে এর বিষয়বস্তটা জেনে নিই, তাতে আমাদের আলোচনা করতে সুবিধা হবে।

কাঞ্জিলাল এক মূর্তি ব্যবসায়ী। তিনি নাস্তিক। সব সময় ঈশ্বরকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। একটা ভূমিকম্পে তার একমাত্র দোকান ভেঙে পড়ে। তখন সকলে তাকে বলতে থাকে, ঈশ্বরকে নিয়ে মস্করা করার জন্য এটা ঘটেছে। তিনি বীমা দাবী করেন, কিন্তু বীমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাবে না বলে দেয়, কারণ হিসেবে জানায়, ঈশ্বরের দ্বারা কোনো ক্ষতি হলে সেই ক্ষতিপুরণ দেওয়ার কোন দায় নেই। যেহেতু ভুমিকম্প, সুনামি, ঝড় এসবের পেছনে মানুষের কোনো হাত নেই, তাই তারা এর দায় নিতে নারাজ। কাঞ্জিলালের দোকানও বিক্রি হয় না, কারন সেটাতে নাকি অভিশাপ আছে। এই সময় তার মাথায় খেয়াল আসে, তিনি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কেস করবেন। কিন্তু কোনো উকিল এই কেস নিতে রাজি হয় না। অবশেষে হানিফ কুরেসি নামে এক উকিলের সাহায্যে তিনজন বড় ধর্ম-পুরোহিতকে নোটিশ পাঠান, কারণ তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে নিজেদের দাবি করেন। এবং নিজেই নিজের কেস লড়েন।

কাঞ্জিলালের যেহেতু অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, তাই কোর্ট এই কেসকে গ্রহণ করে। কাঞ্জিলাল এই সময় কিছু ধর্মান্ধ মানুষের খপ্পরে পরেন এবং তাকে বাঁচায় কৃষ্ণ বাসুদেব নামে এক রিয়াল এস্টেট এজেন্ট, যিনি নিজেকে ভগবান বলেন।

তিনি কাঞ্জিলালের ঘর কিনে নেন, এবং তাকে তাঁর ঘরে থাকার অনুমতি দেন। ভগবান কৃষ্ণের পরামর্শে কাঞ্জি মিডিয়ার সামনে আসেন। এবং সুন্দর যুক্তি দিয়ে ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামো সকলের সামনে খুলে দেন। এই সময় আরও বেশ কিছু পরিবার, যারা এই ধরনের ঈশ্বর বা আল্লাহ বা গডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সকলে অনুরোধ করলে তাদের সকলের কেস লড়ার জন্য রাজি হন।

কিন্তু কোর্ট এইসব কেস গ্রহণ করলেও এক মাস সময় দেওয়া হয় লিখিত প্রমাণ হাজির করার জন্য যে, ভুমিকম্প, সুনামি, ঝড় এই ধরনের ঘটনাগুলো ঈশ্বর বা আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়!

কাঞ্জিলাল চিন্তায় পড়ে যান, কোথা থেকে তিনি প্রমাণ হাজির করবেন! এই সময় কৃষ্ণ তাঁকে উদ্ধার করেন। তিনি কাঞ্জিকে গীতা, বাইবেল ও কোরান পড়তে বলেন। কাঞ্জি সেগুলো পড়েন। এবং শুনানির দিন তিনি এইসব ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রমাণ হাজির করেন - সবকিছু ঈশ্বর বা আল্লাহ বা গডের ইচ্ছাতে হয়। এবং তিনি ঈশ্বরের নামে উল্টোপাল্টা কথা বলতে থাকেন, ঈশ্বর নেই এটা বলেন। কৃষ্ণর ইচ্ছাতে তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান।

ভগবান কৃষ্ণই তাঁকে সুস্থ করেন, এবং বলেন কাঞ্জি এক মাস ধরে হসপিটালে ভর্তি আছেন ও এটাও বলেন, তাঁকে ধর্মীয় পুরোহিতরা ভগবান বানিয়ে তাঁর মন্দির বানিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। এবং তারাই তাঁর মৃত্যুদিন ঘোষণা করেছে। কাঞ্জি কৃষ্ণের সাহায্যে তার তৈরি হওয়া মন্দিরে যান। এবং নিজেই নিজের মন্দির ভাঙতে শুরু করেন ও জনগণকে বোঝান: এটা হল ভগবানকে নিয়ে ব্যবসা করা। এই সময় জনগণ উত্তেজিত হয়ে ধর্মীয় পুরোহিত যাঁরা কাঞ্জিকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, তাঁদের মারতে উদ্যত হলে কাঞ্জি তাদের শান্ত করেন, এবং ধর্মীয় পাণ্ডাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন।

ভগবান কৃষ্ণ সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর কাঞ্জি কৃষ্ণের ব্যবহৃত চাবির রিংটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিজের পকেটে রাখতে গেলে তিনি কৃষ্ণের আওয়াজ শুনতে পান... ভগবান বলেন যে, মাদুলি বানিয়ে কোনো জিনিস গলায় ঝুলিয়ে রাখার বিরুদ্ধে যে-লড়াই করেছে এতদিন, সেটাই সে করতে যাচ্ছে। তখন কাঞ্জি সেই রিং আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেন ও রিংটা আকাশে মিলিয়ে যায়।

এই হল মূল গল্প। একজন নাস্তিকের কাছে এই মুভিটা একটা বোগাস। কারণ মুভিটাতে এত অলৌকিক ব্যাপার আছে যে, এটাকে এক ধাক্কায় কাল্পনিক বলা যায়। আক্ষরিক অর্থে ফিল্মটি সত্যিই অবাস্তব - কৃষ্ণের অস্তিত্ব, ভগবান কৃষ্ণের সাথে কাঞ্জির কথোপকথন, কাঞ্জিকে উপদেশ দেওয়া, কাঞ্জিকে বাঁচানো, কাঞ্জিকে প্যারালাইজড করা, আবার তাকে ঠিক করা... সব কাল্পনিক।

আর একটা বিষয় মুভিতে দেখা যায়, সেটা হল হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিষ্টান ধর্মের সমন্বয়। সত্যি, এটা হল ঘোড়ার ডিমের মত ব্যাপার (আপনারা ভীতুর ডিমও বলতে পারেন); মানে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। সত্যি, আপনি চাইলেও কোনো দুটো ধর্মকে এক করতে পারবেন না। কারণ প্রতিটি ধর্মের মধ্যে এত অমিল যে, একটা যায় পূর্ব দিকে তো আর একটা পশ্চিম দিকে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

এই মুভিটাকে কখনও একজন প্রকৃত মুসলিম সত্য বলে মেনে নিতে পারবে না। কেন? কেন পারবে না? কারণটা হল, মুসলিম ধর্মের বিশ্বাস - আল্লাহর কোনো রূপ নেই। তিনি নিরাকার। তাই কৃষ্ণরূপে যে-ভগবানকে এখানে দেখানো হয়েছে, তা কখনো একজন মুসলিম সত্য বলে মেনে নিতে পারবে না। হিন্দুধর্মের মতে, আমরা যা কিছু দেখি, সব কিছুই ঈশ্বর! কিন্তু মুসলিম ধর্ম অনুসারে, আমরা যা কিছু দেখি, সব হল আল্লাহর সৃষ্টি, কিন্তু কোনো কিছুই আল্লাহ নয়। আল্লাহ হল নিরাকার, তিনি সব কিছু থেকে আলাদা। তাহলে বুঝতেই পারছেন, এক ধর্মকে স্বীকার করলে আর একটা ধর্মকে অস্বীকার করতে হয়। যদি কৃষ্ণকে স্বীকার করলে মুসলিম ধর্ম অস্বীকার করতে হবে। আর মুসলিম ধর্ম স্বীকার করলে কৃষ্ণকে।

তাহলে আজকাল যাঁরা ইদ ও পূজা দুটোতেই মেতে উঠছেন, তাঁরা কি সমন্বয় করছেন না? হ্যাঁ, সত্যি তাঁরা তাপি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। দুটো ভাঙ্গা কাচকে কি পুরোপুরি জোড়া লাগানো যায়। না, কখনই যায় না! সেটা তখনই এক হবে, যখন দুটো কাচকে গলিয়ে ফেলা হবে। অর্থাৎ দুটো ধর্ম তখনই এক হতে পারে, যখন দুটো ধর্ম বিলুপ্ত হবে তার আগে নয়।

একটা প্রচলিত ধারণা আছে, সেটা হল, নাস্তিকতা কেউ চিরকাল ধরে রাখতে পারে না। বয়স বেড়ে গেলে তারা আস্তিক হয়ে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে কথাটা সত্য হতে পারে বটে, তবে সময়ের সঙ্গে নাস্তিকের সংখ্যা বাড়ছে। নাস্তিকতা নিয়ে শুরু হয়েছে লেখালেখি, সাহিত্য এমনকি সিনেমা। কিন্ত বেশিরভাগ জায়গাতেই নাস্তিককে নাস্তিক রাখা হয় না। তাকে আস্তিক করে দেওয়া হয়। “Oh My God” মুভিটাও আলাদা নয়। এখানে কাঞ্জিলালকে নাস্তিক দেখালেও শেষ পর্যন্ত আস্তিক করে ছেড়েছে। 

কিন্ত বাস্তবে কিন্ত তা নয়। আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, যারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেদের আদর্শে ঠিক ছিল। তারা নাস্তিক হয়েছে, এবং নাস্তিকই থেকে গেছে। তাই সমাজে এই ধারণাটা পাল্টাতে হবে। নাস্তিকতা গরম রক্তের প্রকাশ নয়। তা যুক্তিশীলতার প্রকাশ। কাঞ্জিলালকে যখন "ঈশ্বর বা আল্লাহর ইচ্ছাতে হচ্ছে সবকিছু" তার লিখিত প্রমাণ আনতে বলা হল, তখন তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্ত বাস্তবে কিন্ত এটা হওয়া উচিত নয়।

প্রয়োজনের খাতিরে একজন নাস্তিককে অনেক সময় ধর্মগ্রন্থ নিয়ে অনেক পড়তে হয়। কিন্তু একজন আস্তিক কিছু না পড়েই ঈশ্বরের নাম গান করে যায়। কারণ একজন আস্তিক ধর্মগ্রন্থের একরত্তি না জেনেও আস্তিক হতে পারে। তবে যারা ভগবানের কাছে কিছু না পেয়ে নাস্তিক হয়েছে, তাদের নাস্তিকতা বেশিদিন টেকে না, তারা আসলে নাস্তিক নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন