শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ইসলাম - সাম্রাজ্যবাদী মরু-সংস্কৃতি

লিখেছেন Secular Friday

সংগঠিত ধর্ম মাত্রই একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান বা জীবনধারণ পদ্ধতি।

চরিত্রগতভাবেই এই সংগঠিত ধর্মগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় আঙ্গিক, আধ্যাত্মিক আঙ্গিক, সামাজিক আঙ্গিক, রাজনৈতিক আঙ্গিক, জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক, অর্থনৈতিক আঙ্গিক ও আইনি আঙ্গিকের প্রেক্ষাপটকে নির্দিষ্ট করে। 

জীবনধারনের এই পদ্ধতিগুলো কালোত্তীর্ণ নয়, এবং স্থির ও বদ্ধ চিন্তা থেকে উদ্ভুত বলেই পূর্ব নির্ধারিত। আর সে কারণে কোন ধরনের নতুন চিন্তার জন্য এগুলো আর উপযোগী নয়; শুধুমাত্র প্রবল চেষ্টায় অতি কষ্টে টিকে আছে বর্তমানের সাথে সমন্বয়বিধানের চেষ্টা করে, অতীতমুখিনতায়।

ইসলামও একটি জীবনবিধান; তবে এই জীবনবিধানটি তার প্রমত্ত রাজনৈতিক চরিত্রের কারণে আজ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চরিত্র হারিয়ে মরু-সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারায় পর্যবসিত হয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার প্রাবল্যের কারণেই কোনো অঞ্চলে সংস্কৃতির নামে চলমান কোনো আচারকেই ইসলাম ধর্ম তার সংস্কৃতির অংশ বলে মেনে নেয় না, বরং তীব্র বিরোধিতা করে চলে।

সংস্কৃতি হচ্ছে একটা অঞ্চলের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাষা, আচার, ব্যবহার, সাহিত্য, আনন্দ অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক সম্পর্ক, জীবিকা ইত্যাদির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবন বোধ ও অভিব্যক্তি। একটি অঞ্চলের মানুষ সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়েই নিজ নিজ সুকুমারবৃত্তিকে পরিশীলিত করে।

প্রচলিত ইসলামী সংস্কৃতি মানুষের জীবন ধারনকে বিকশিত করবার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত করে। ইসলাম যে শুধু কে কয়বার কিভাবে নামাজে দাঁড়াবে, হাত কিভাবে বাঁধবে, রুকু সেজদা কীভাবে দেবে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন দাবি করে, তা-ই না, বরং কোন অনুষ্ঠানটি পালন করা যাবে, কোনটা যাবে না; জীবিকার জন্য কী পেশা গ্রহণ করা যাবে, কোনটা যাবে না; কোন খাদ্য গ্রহণ করা যাবে, কোনটা যাবে না; কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, কাকে যাবে না; বিয়ে-শাদীর উৎসব কীভাবে হবে, আনন্দ অনুষ্ঠানের পরিধি কী হবে, চিত্ত বিনোদন কীভাবে হবে, এমনকি মলমুত্রত্যাগ বা সঙ্গম কীভাবে হবে, তার সবই নির্ধারণ করে দেয়।

প্রচলিত ইসলামের বিচারে ইসলামী সংস্কৃতি পালনের সামান্যতম বিচ্যুতিতে কথিত আল্লাহ রুষ্ট হন এবং ব্যক্তির দোজখ-বেহেশত সহ সকল পারলৌকিক প্রাপ্তি এই সব সংস্কৃতি পালনের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়।

সর্বগ্রাসী ইসলামী সংস্কৃতি আজ সকল শুভবোধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চায় শরিয়া আইন প্রবর্তন করে, দারুল ইসলাম বানিয়ে, খেলাফত প্রবর্তন করে।

ইসলাম কেন মরু-সংস্কৃতি, তা সহজেই অনুমেয়।
১. ইসলামের জন্ম ও বিকাশ কোথায়? আরবের মরুভূমিতে।
২. ইসলামের ভাষা কি? আরবি।
৩. ইসলামের নবী কাদের জন্য, কাদের মধ্যে এসেছেন? আরবের উম্মিদের জন্য [সূরা জুম'আ, আয়াত ২]
৪. ইসলাম মুলত কাদের জন্য নাজেল হয়েছিল? মক্কা ও তার আশপাশের লোকদের জন্য [সূরা আশ শুরা - ৪২: ৭]
৫. ইসলামে খলিফা হওয়ার অধিকার কাদের? শুধুমাত্র কুরাইশদের [সহিহ বুখারী, খন্ড ৯, অধ্যায় ৮৯, হাদিস ২৫৪]
৬. ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান হজ্ব কোথায় হয়? মক্কায়।
৭. একজন মুসলমানের জন্য জিহাদ, হজ্জের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। [রিয়াযুস স্বা-লিহীন, বই ১২, হাদিস ১২৮৫]; এমনকি নবী নিজেও মাত্র একবার হজ্জ করেছেন (বিদায় হজ্জ ১০ম হিজরী), কিন্তু যুদ্ধ করেছেন ন্যুনতম ঊনিশবার। [সহিহ মুসলিম, বই ১৯, হাদিস ৪৪৬৫]
৭. সেমিটিক সভ্যতায় প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানের বহির্ভূত কোনো আচার-অনুষ্ঠানই ইসলামে স্বীকৃত নয়।
কোরআনের কয়েকটি সুরা পড়লেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ইসলাম মরুসংস্কৃতি হিসেবেই আবির্ভূত। উদাহরন স্বরুপ:
(৬.৯২) এ কোরআন এমন গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি; বরকতময়, পূর্ববর্তী গ্রন্থের সত্যতা প্রমাণকারী এবং যাতে আপনি মক্কাবাসী ও পার্শ্ববর্তীদেরকে ভয় প্রদর্শন করেন। যারা পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে তারা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তারা স্বীয় নামায সংরক্ষণ করে।
(১০.৪৭) আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একেকজন রসূল রয়েছে। যখন তাদের কাছে তাদের রসূল ন্যায়দন্ডসহ উপস্থিত হল, তখন আর তাদের উপর জুলুম হয় না।
(১৪.৪) আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, পথঃভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।
(৪৩.৪৩) অতএব, আপনার প্রতি যে ওহী নাযিল করা হয়, তা দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করুন। নিঃসন্দেহে আপনি সরল পথে রয়েছেন।
(৪৩.৪৪) এটা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে উল্লেখিত থাকবে এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন।
(৪৮.২৩) এটাই আল্লাহর রীতি, যা পূর্ব থেকে চালু আছে। তুমি আল্লাহর রীতিতে কোন পরিবর্তন পাবে না।
আল্লাহ নিজেই বলছেন, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নবী আছেন এবং আল্লাহর এই রীতিতে কোনো পরিবর্তন হয় না। সব পয়গম্বরকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করা হয়, এবং কোরআন এমন গ্রন্থ, যা অবতীর্ন করা হয়েছে পূর্ববর্তী গ্রন্থের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য এবং মক্কাবাসী ও পাশ্ববর্তীদেরকে ভয় প্রদর্শন করার জন্য।

সেই একই গ্রন্থ কোরআনেই বলা আছে:
(২৬.১৯৮) যদি আমি একে কোন ভিন্নভাষীর প্রতি অবতীর্ণ করতাম
(২৬.১৯৯) অতঃপর তিনি তা তাদের কাছে পাঠ করতেন, তবে তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করত না।
আয়াত দু’টোতে আল্লাহ নিজেই বলছেন যে, আরবি কোরান ঠিকঠাকভাবে পড়ে শোনালেও অনারব (বা আরবি জানে না) এমন ব্যক্তিরা তা প্রত্যাখ্যান করবে, সেটাই আল্লাহর কাছে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এর মানে, আল্লাহ নিজেই মনে করেন, আরবি কোরানে বিশ্বাস করা অনারব (বা আরবি জানে না) এমন মানুষদের জন্য উচিত নয়।

কাজেই এটা স্পষ্ট যে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেই:
১. ইসলাম ও কোরআন এসেছে আরব ভাষাভাষীদের জন্য, মুলত মক্কাবাসী ও পাশ্ববর্তীদের জন্য;
২. আল্লাহ এটাও বলছেন, কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য, তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ, এবং বিশ্ববাসীর জন্যে এক উপদেশ। ইসলামে বর্ণিত এই উপদেশ থেকে শিক্ষা নেয়াটা বিশ্ববাসীর জন্য প্রযোজ্য হলেও ইসলামের সংস্কৃতি শুধুমাত্র আরবদের জন্য প্রযোজ্য;
৩. আল্লাহ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রসূল প্রেরন করেন এবং তিনি সে জাতির ভাষাভাষী হিসেবেই আসেন।
স্পষ্টতই ইসলামের এই শিক্ষা আজ দু'টি প্রধান ধারায় বিভক্ত।

প্রথমটি নবী মুহাম্মদ প্রচারিত এবং দ্বিতীয়টি নবীর মৃত্যু পরবর্তীকালে তাঁর অনুসারীদের প্রবর্তিত।

প্রথমটি ছিল প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে একটি সমাজ পরিবর্তনের ধারা, যা ইসলাম প্রচারে ও আরব জাতীয়তা বিকাশে অনন্য ভুমিকা রেখেছে, দ্বিতীয়টি রাষ্ট্র ক্ষমতা সংহত করার সেই জাতিগত পরিচয়কে ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের ধারার জন্ম দিয়েছে। ইসলামকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার অপচেষ্টায় পরিণত হয়েছে মরু-সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদে। আজ সেই দ্বিতীয় ধারাটিই হয়ে উঠেছে মুখ্য।

ধর্মের ছায়ায় এই মরু-সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার প্রসার অবশ্যই বর্জনীয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন