সোমবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৪

একটি ইসলামী দাওয়াতী বা নাস্তিক চ্যালেঞ্জিং পোস্ট ও আস্তিকীয় মনস্তত্ত্ব

লিখেছেন শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল

ফেসবুকে একজন মুমিন গ্রুপে একটি কপি-পেস্ট দাওয়াতী / নাস্তিক চ্যালেঞ্জিং মিরাক্কেল-ভর্তি পোস্ট দিয়েছেন এবং তাতে লাইক ও সুবহানাল্লাহর বন্যা বয়ে গেছে। মন্তব্যে সবাই জিজ্ঞেস করছে, নাস্তিকরা এত বেকুব? এসব দেখেও তারা ঈমান আনে না? ইত্যাদি।

আসুন, আমরা সেই পোস্টটায় একটু চোখ বোলাই।
Shaon Rahman > আস্তিক বনাম নাস্তিক(গঠনমুলক আলোচনা )
dont misss any nastik
১ – বিজ্ঞান কিছুদিন আগে জেনেছে চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূরা ফুরক্বানের ৬১ নং আয়াতে কুরআনে এই কথা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে।
যে কেউই পড়ে আশ্চর্য হবে, "ওরে বাবা রে বাবা! কোরানে ১৪০০ বছর আগেই এটা বলা কীভাবে সম্ভব! কী আশ্চর্য জ্ঞানের বই রে বাবা, নিশ্চয়ই ইসলামই সত্য।"

আয়াত উল্লেখ না করেই "কুরআনে এই কথা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে", এটা পড়ে ফুরক্বানের ৬১ নং আয়াত সম্পর্কে যে কারো কনসেপশান হয় কি? যে কারো মাথায় আসে যে, আয়াতটা নিশ্চয়ই এমন:
"অবিশ্বাসীরা কি দেখে না চাঁদ নিজস্ব আলো না থাকা সত্ত্বেও সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করেই কীভাবে রাতে আলো দিয়ে থাকে? নিশ্চয়ই আল্লাহ সুকৌশলী ও প্রজ্ঞাবান।"

মুমিনদের সে কী সূক্ষ্ম ধোঁকাবাজি!

আসলে আয়াতটা কী, সেটা দেখেন।... না, আয়াতটা আমিও পোস্ট করবো না। নিজে একটু কষ্ট করুন। বাংলা কোরানটা খুলুন, আয়াতটা বের করুন, নিজে পড়ে চেক করুন।

আমি আয়াতটা দিয়ে দিলে এই পোস্টের উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়, আপনারা যাতে প্রতিটা জিনিস নিজে ভেরিফাই করতে শেখেন, কারো মুখের কথা না মেনে নিজে কোরান, হাদিস, তাফসির বের করে নিজে উল্টিয়ে নিজে পড়ে তারপর নিশ্চিত হন, সেই অভ্যাসটাই তো আমি আপনাদের ভিতর ঢোকাতে চাচ্ছি। নিজের ধর্মের প্রধান গ্রন্থটা নিজেরাই বুঝে পড়েন না, এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে।

আপনারা তো "বিশ্বাস" করেন যে, ধর্মগ্রন্থটি এই পুরো মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার বাণী, অথচ ফেসবুকিং কিংবা অন্য কোনো কাজে আপনাদের সময় হলেও সে ধর্মগ্রন্থটা বুঝে পড়ার সময় হয় না কেন? সৃষ্টিকর্তা অবসরে যাওয়ার আগে শেষবার তার মহাগ্রন্থে কী অমৃত অসাধারণ সব কথা বলে গেছেন, তা জানতে ইচ্ছা হয় না?

যাই হোক, মূল পয়েন্টে ফিরে আসি। আশা করি, কোরান উলটে সুরা ফুরক্বানের ৬১ নং আয়াতটির অনুবাদ দেখে নিয়েছেন। এবার বলুন, প্রকৃত আয়াত উল্লেখ না করে "চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই - সূরা ফুরক্বানের ৬১ নং আয়াতে কুরআনে এই কথা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে" - এই ধরনের বিভ্রান্তিকর কথা বলে মানুষকে বিস্মিত করার চেষ্টাটা কি প্রতারণা নয়?

চাঁদের আলো প্রতিফলিত, বিজ্ঞান এটা আবিষ্কারের আগে কিন্তু এই ধরনের দাবি মুসলিম উম্মাহ কখনো করেনি। কোনো একজন আলেম, কোনো একজন মুফতি, কেউ কখনো বলেনি যে, চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো। অথচ বিজ্ঞান এটা আবিষ্কার করার পরই কিন্তু মুমিনরা আজকাল এই আয়াতকে নতুনভাবে ব্যাখা করে, নতুন অর্থ বানিয়ে, Re-interpret করে, নতুন একটা অপব্যাখা দাঁড় করিয়ে সেটাকেই ১৪০০ বছর আগে বলেছে বলে চালিয়ে দিয়ে মিরাকল-মিরাকল চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছে।

অথচ তারা ইসলামী বিজ্ঞানের এই তথ্যটি আবিষ্কারের "আগের" কোনো একটি তাফসির-এ কি দেখাতে পারবে যে, এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে যে, এই আয়াতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত বোঝানো হয়েছে?

ইসলামী স্বর্ণযুগের কিংবা চার খলিফার খিলাফতের সেসব শ্রেষ্ঠ সব সহি তাফসির আনুন, যেগুলো আজও মাদ্রাসায় কোরান-হাদিসের সাথেই বিশাল গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। তাফসির ইবনে কাথির, ইবনে মাজাহ, আল মাসুদ, ইত্যাদি উলটে দেখুন। কোথাও কিন্তু এই আয়াতের ব্যাখ্যায় "চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই" - এই তথ্য বের করে নি।

সেই পোস্টের প্রতিটি পয়েন্টই হলো এরকম বিভিন্ন re-interpretation, অর্থবদল, নতুন অপব্যাখ্যা, অতি স্পেকুলেশান, স্ট্র ম্যান, বিজ্ঞানের মিসপ্রেজেন্টেশান, বায়াস, মিথ্যাচারসহ বিভিন্ন রকমের ভণ্ডামি ও প্রতারণা। প্রতিটা পয়েন্টে পয়েন্টে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এরা তাদেরকেই বোকা বানায়, যারা কখনো পুরো কোরান বাংলায় বুঝে পড়েনি, যারা পোস্টের ধোঁকাবাজি ধরতেই পারবে না, আয়াতটা কখনোই কোরান উলটে দেখবে না, সেই আয়াতের তাফসির কখনো পড়ে দেখবে না, সেসব বোকাসোকা নিরীহ ব্যক্তিরাই কিন্তু মুমিনদের এসব ভণ্ডামির টার্গেট। 

যে লোক এই কপি-পেস্ট পোস্টটা করেছে, সেও কিন্তু এই আয়াতগুলো চেক করেনি, তাফসির দেখেনি, সে নিজেও কিন্তু প্রতারণার শিকার।

এই পোস্টটি প্রথমবার লিখেছিল কোনো ধান্দাবাজ মুসলিম, তার কাছ থেকে এটি অন্ধবিশ্বাসে ভর করে ছড়িয়েছে MLM e-র মত। এটির রিপোস্টকারী নিজে প্রতারিত হচ্ছে এবং অন্যদেরও প্রতারিত করছে সে নিজের অজান্তেই। সে নিজেও জানে না যে, সে প্রতারিত এবং প্রতারক দুটোই। সে পোস্ট করেছে সরল বিশ্বাসে, আস্থায়, ঈমানে... আর সেই প্রতারণায় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কগনিটিভ ডিসোনেন্সে ভোগা মুসলিমরা সুবহানয়াল্লাহ সুবহানয়াল্লাহ বলে তাদের ঈমান নামক রোগের সিম্পটমগুলোই প্রকাশ করছে।

এইসব প্রতারণা প্রথম শুরু করেছিল তথাকথিত স্রষ্টার স্বঘোষিত ডাকপিয়নেরা, সেসব স্বঘোষিত ডাকপিয়নদেরও ধিক। ধিক প্রতারকদের, ধিক।

পুনশ্চ. পাঠকদের খাটনি কমাতে আয়াতটির লিংক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন