শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪

গোমূত্রপানপ্রথাপুরাণ

লিখেছেন সেক্যুলার ফ্রাইডে

প্রাচীন ভারতের পশুপালক সমাজে নারায়ণসম অতিথিকে আপ্যায়ন করা হত কচি বাছুরের মাংস দিয়ে; সে কারণেই অতিথিকে বলা হত গোঘ্ন। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ সূক্তের ৪৩ নং শ্লোকে পাই বৃষ মাংস খাওয়ার কথা, পঞ্চম মণ্ডলের ২৯ নং সূক্তের ৮ নং শ্লোকে পাই খাদ্য হিসেবে মহিষ মাংসের উল্লেখ। বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রেও গো-মাংস ভক্ষণের সমর্থনসুচক শ্লোক পাওয়া যায়।

সমাজ বিকাশের ধারায় প্রাচীন ভারতের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর জন্যে গো-সম্পদ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অপরিহার্য, সেই সাথে যোগ হয় ধর্মীয় সংঘাত, গোহত্যা বন্ধে সম্রাট অশোকের সক্রিয় আদেশ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অভ্যাসের পরিবর্তন। হিন্দুধর্মের মৌলিক স্তম্ভ হয়ে ওঠে গরু, সংস্কৃত ভাষা ও গীতা। প্রাণীটিকে মহিমান্বিত করতে এক দিকে মাতৃজ্ঞানে যেমন একে উপস্থাপন করা হয় দেবতার বাহন-সম শ্রেষ্ঠত্বে, আর অন্যদিকে চিত্রিত করা হয় সর্ব-অভীষ্টদায়িনী গাভী কামধেনুর রুপকথায়।

এমনকি ভজন-পূজন-সাধন-আরাধনাতেও উপাচারের ছলে দেখি পবিত্র জ্ঞানে পঞ্চগব্যের (দই, দুধ,ঘি, গোমুত্র, গোবর) বহুল ব্যবহার।

সামন্ততান্ত্রিক ভারতে গরুর মঙ্গল কামনায় প্রচলিত ছিল গোরোখ নামের গরুর পূজার আচার; ব্রাহ্মণকে গোদান করা হয়ে উঠেছিল স্বর্গপ্রাপ্তিসম পবিত্রতম কর্ম; এমনকি কালক্রমে এ ধারণাও ছড়িয়ে পড়ে যে, গো স্পর্শে রয়েছে পূণ্যকর্ম, গো সেবায় আছে বিত্তলাভ, গরুর ভিন্ন ভিন্ন অংশে অবস্থান করেন দেবতারা; মাথায় ব্রহ্মা, কাঁধে শিব, পিঠে নারায়ণ এবং আর চরণে বেদ। এমনকি গাভীর লোমে অবস্থান করেন অন্যান্য সকল দেবতা।

ইতিহাসের পটপরিবর্তন, পুঁজির বিকাশের ধারা এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে আধুনিক যুগে কৃষিকাজ আর গো-সম্পদের ওপর নির্ভরশীল না থাকলেও হিন্দুদের পশ্চাৎপদ মানসিকতায় গরু আজও পবিত্র জ্ঞানেই স্থাপিত। ধর্মব্যবসায়ী হিন্দু মৌলবাদীরা এরই সুযোগ ধরে শুধুমাত্র গোমাংস খাওয়াকে ব্রাত্যজ্ঞান করেনি, বরং ফেঁদে বসেছে গো-সংক্রান্ত বিভিন্ন আচার, এমনকি সম্প্রতি শুরু করেছে গোমূত্রকে পানীয় হিসেবে বেচবার বিকট ও বিশাল এক আন্তর্জাতিক ব্যবসা।


অত্যন্ত অবাক করা বিষয় হচ্ছে উৎকট এই পানীয়কে পবিত্র জ্ঞানে হিন্দুরা দল বেঁধে কিনেও নিচ্ছে, আর সেই সাথে ফুলে ফেঁপে উঠছে ধর্মব্যবসায়ীদের কোষাগার। ধর্মান্ধ হিন্দুরা এমনকি এর পক্ষে মেতে উঠছে বিতর্কে, চেষ্টা করছে এই গোমূত্রকে স্বাস্থ্যকর হিসেবে উপস্থাপনের। তাদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিজ্ঞানীরাও!

একবিংশ শতকের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, আধুনিক এই বিশ্বে হাস্যকর এই হীন অপচেষ্টাকে শুধুমাত্র শ্লেষভরে তাচ্ছিল্য করবার উপায় নেই; কারণ অদ্ভুত ও অস্বাস্থ্যকর এই অভ্যাস শুধুমাত্র ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণই নয়, সেই সাথে মৌলবাদী অর্থনীতির নিয়ামক শক্তিও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন