লিখেছেন মাহমুদুল হাসান শাওন
আজ শুক্রবার ঢাকায় সমাবেশ করতে আসার কথা 'ইসলামি আন্দোলন' নামের একটি দলের। তাদের দাবি:
১. লতিফ সিদ্দিকীর ফাসি
২. নাস্তিকদের আচরণের বিরুদ্ধে সংসদের মাধ্যমে কঠোর আইন পাশ
এই স্বল্প পরিচিত সংগঠনের কাজকর্মের সাথে বেশ কিছু ঘটনার মিল পাচ্ছি। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার রাস্তায় 'সম্মিলিত ইসলামি জনতা' নামে একটি সংগঠন বেশ অ্যাক্টিভ ছিল। তারা বিভিন্ন জায়গায় মিটিং-মিছিল-মানববন্ধন-প্রেস কনফারেন্স-লিফলেটিং করত। তাদের দাবি ছিল - দেশে পবিত্র কোরানের শাসন চালু করা। বিশেষ করে তারা জোর দিয়েছিল অ্যালকোহল বিষয়ক ইসলামিক অনুশাসনকে। মহানবী মদ-ব্যবসার সাথে জড়িত ১০ ব্যবসায়িক ক্যাটাগরির (উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, বিক্রেতা ইত্যাদি) লোকদের ওপর লানত দিয়েছেন - এই ধরনের অসংখ্য কোরান হাদিসের বাণী দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে মোটিভেট করত।
বাংলাদেশ সরকারের কাছে তারা স্মারক লিপি দিয়ে দাবি জানিয়েছিল দেশের ভেতরে যে সকল কোম্পানি মদ বানায় তাদের ব্যবসায়িক লাইসেন্স কেড়ে নেওয়ার এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার। পুরা দেশে 'সম্মিলিত ইসলামি জনতা' এই ধরনের মদ বানানো একটি মাত্র কোম্পানিই খুঁজে পেয়েছিল। তার নাম যমুনা গ্রুপ। এরা ক্রাউন এবং হান্টার নামে এনার্জি ড্রিঙ্কস বানায়, যার ভেতরে কম বেশি ১০% বিয়ার থাকে। তাই তারা যমুনা গ্রুপ এবং এর চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করল। ইতিহাসের কিছু অজানা সূত্র মিলিয়ে মিলিয়ে তাঁকে রাজাকার বানাল। তাঁকে ফাসিতে ঝোলানোর দাবি নিয়ে পোস্টারিং করল। আর পরিশেষে যমুনা ফিউচার পার্ক ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে সরকারি খরচে যমুনা জামে মসজিদ বানিয়ে দেওয়ার আবদার করল। এক পর্যায়ে তারা হরতাল ও ডাকার হুমকি দিয়েছিল।
সম্মিলিত ইসলামি জনতার প্রতিটি দাবি সত্য। যমুনা গ্রুপ বিয়ার বানায়। এবং ইসলাম অনুযায়ী, পৃথিবীতে মদ খাওয়া নিষেধ। বেহেস্তে খাওয়া যাবে। সেখানে শরাবুন তহুরা নামে মদের আস্ত একটা নদী আছে। (অনেক মুসলমান অবশ্য মদ খাওয়াকে জায়েজ করেছেন এই বলে যে , ইসলামে মাতলামি করা নিষেধ, মদ খাওয়া নিষেধ না। উদাহরণ - মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী)
কথা হচ্ছে এক বছর পরে আজ সম্মিলিত ইসলামী জনতার সেই জেহাদী জোশ গেল কোথায় ? যমুনা গ্রুপ তো এখনো ক্রাউন বিক্রি করেই যাচ্ছে। তাহলে ? এই সময়ের মাঝে নতুন ফতোয়া পেল নাকি সম্মিলিত ইসলামী জনতা ?
বাংলাদেশে ক্রাউন এবং হান্টার কিন্তু একমাত্র না। এই ধরনের আরো ড্রিঙ্কস বাজারে আছে। যেমন স্পিড, শার্ক, স্যাপিড ইত্যাদি। এছাড়া বিদেশি রেড বুল বা অন্যান্য বেশি অ্যালকোহলওয়ালা ড্রিঙ্কসও এখন ঢাকার মুদি দোকানে পাওয়া যায়। একটু অভিজাত দোকানে গেলেই আসল বিয়ারের ক্যান পাওয়া যাবে। দেশের ভেতরে প্রথম মদ বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল দর্শনাতে অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোং-কে। এটি মূলত চিনি বানানোর প্রতিষ্ঠান। সাথে উপজাত হিসেবে মদও বানাত, স্থানীয় বাজারে যে মদটি 'বাংলা কেরু' নামে পরিচিত।
সম্মিলিত ইসলামী জনতা এগুলোর একটার ব্যাপারেও কথা বলেনি। তারা নাম উল্লেখ করেছে শুধুমাত্র যমুনা গ্রুপের। যমুনাকে নিয়েই তাদের ধর্মানুভুতি জেগে উঠেছিল কেন?
(ভাল কথা , সম্মিলিত ইসলামী জনতা একা না। তাদের সাথে একই দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, মাদকবিরোধী আন্দোলন, খানকাহ এমদাদিয়া আশরাফিয়া, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কাউন্সিল, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক সাংবাদিক ইউনিয়ন, খাদিমুল হুফফাজ পরিষদ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন ইসলামী দল, সংগঠন, বরেণ্য পীর-মাশায়েখ ও বুজুর্গগণ। রেফারেন্স: বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম)
পুরো ব্যাপারটি ছিল আসলে ব্যবসায়িক সংঘাত। গত বছর যমুনা ফিউচার পার্ক চালুর সময় থেকে এর সূত্রপাত। প্রগতি সরনি মোড়ের যানজটের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ আর যমুনা গ্রুপ একে অপরকে দায়ী করতে লাগল। যমুনা বলল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জন্য এই যানজট। আর বসুন্ধরা বলল, যমুনা ফিউচার পার্কের জন্য এই যানজট। দু'পক্ষই নিজেদের মিডিয়া নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায়। বসুন্ধরার মিডিয়া হল বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কন্ঠ, ডেইলি সান আর বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম। আর যমুনার মিডিয়া হল দৈনিক যুগান্তর, এবং পরবর্তিতে যমুনা টিভি। বেশ কিছু কপি-পেস্ট সর্বস্ব অনলাইন নিউজ পেপারও অবশ্যি বুঝে বা না বুঝে এই নিউজগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো শুরু করেছিল।
এই যানজট নিয়ে যমুনা গ্রুপের ভাষ্যে কয়েকটি নিউজের লিঙ্ক দিলাম। দেখুন নিচের রেফারেন্স নাম্বার ১-এ। ২ নাম্বার রেফারেন্সে বসুন্ধরার নিউজের লিঙ্ক, আর ৩ নাম্বারে নিরপেক্ষ রিপোর্ট এর লিঙ্ক।
গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রী এলাকায় গিয়ে ২ গ্রুপের ২ চেয়ারম্যানের সাথে বৈঠকও করেন। কিন্তু কোনো ফলাফল আসে না।
এর পর থেকে দুই গ্রুপের মিডিয়া একে অপরকে নিয়ে আরো নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ে। এবার তাদের বিতর্কের বিষয় যানজট ছাড়িয়ে যায়। যুগান্তরে ছাপা হতে থাকে বসুন্ধরা গ্রুপের দুর্নীতি এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সীমাহীন অব্যবস্থাপনার কথা। (রেফারেন্স ৪ )
বসুন্ধরাও নামে যমুনার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোয়। এক পর্যায়ে তারাই যমুনার বিরুদ্ধে মদ ব্যবসার অভিযোগ এনে সম্মিলিত ইসলামী জনতাকে মাঠে নামায়। ইসলামী জনতার রাজপথের কার্যক্রম খুব ভাল কাভারেজ দিতে থাকে বসুন্ধরার মিডিয়াগুলো । (রেফারেন্স ৫ ও ৬)
পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি গড়িয়েছিল আদালতে পর্যন্তও। দু'পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিল। (রেফারেন্স ৭)
রোজা-ঈদ-পূজা-কোরবানি এবং নির্বাচনের ডামাডোলে এদের বিরোধ স্থগিত হয়ে যায়। পর্দার আড়ালে কী সমঝোতা হয়েছে, তা আর জানা যায়নি। তবে এরা এখন শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। কোনো বিরোধ নেই। কারো বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ নেই। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল যমুনা টিভি আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারে এলে সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান।
যেহেতু যমুনা আর বসুন্ধরার মাঝে এই মুহূর্তে কোনো বিরোধ নেই, তাই 'সম্মিলিত ইসলামী জনতা' এখন মাঠে নেই। বিয়ার ব্যবসা সম্ভবত এখন আবার হালাল হয়ে গেছে। ক্রাউন আর হান্টারের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়ার কেউ নেই। যমুনা ফিউচার পার্কে ডিজে পার্টি, অশ্লীল পাশ্চাত্য সিনেমা - সকল বেশরিয়তী কাজ পুরোদমে চলছে। যমুনা জামে মসজিদে নামাজ পড়ার দাবি নিয়ে কেউ নেই।
তবে আবারো কেউ তাদের ভাড়া করতে চাইলে সম্ভবত আবারো তাদের ধর্মানুভূতি চেগিয়ে উঠে নতুন নাম, নতুন ইস্যু, নতুন ফতোয়া নিয়ে মাঠে নেমে পড়বে ।
পুরো ঘটনা থেকে ৩ টা অবজার্ভেশন পাই।
১. মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার চেয়েও একজন আলেমের ফতোয়া শক্তিশালী। কারণ তিনি মানুষকে মোটিভেট করতে পারেন ধর্মের কথা বলে। অন্য যে কোনো ইস্যুর চেয়ে এই ইস্যুতে আমজনতা সংযুক্ত হতে চায় বেশি। তাদেরকে টেনে আনাও সহজ অনেক। মসজিদের ইমাম জুম্মার নামাজের খুতবায় ইসলাম বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে - এই কথা বললেই হাজার হাজার মানুষ মাঠে নেমে আসবে।
ওপরের ছবিতে অনেক আমজনতাকে কিন্তু দেখা যাচ্ছে মানব বন্ধনে দাড়িয়েছেন। তারা, সম্ভবত, বসুন্ধরার কোনো সম্পৃক্ততাও এখানে দেখেননি, শুধুমাত্র দেখেছেন অনৈসলামিক মদ ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে।
২. এই ধরনের ইস্যু নিয়ে মাঠে নামলে প্রচুর আনাকাংখিত সাহায্য পাওয়া যায়। আমজনতার সাহায্য তো পাওয়া যায়ই, প্রচুর সংগঠন তাদের সাংগঠনিক লাভের জন্য সাহায্য করে। সম্মিলিত ইসলামি জনতার এই আন্দোলনকে লুফে নিয়েছিল চরমোনাই পীর। সে তার নির্বাচনী প্রচারণায়, হাতপাখা মার্কায় ভোট চাইতে গিয়ে এই ইস্যু টেনে এনে বোঝাতে চাইতো তার ইসলাম অনুভূতি কত তীব্র। (কাছাকাছি একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। হেফাজতে ইসলামের লং মার্চে সাহায্য করেছিল এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের কয়েকজম এমপি)
৩. ভবিষ্যতে হয়তো মিডিয়া ভাড়া করার চেয়ে আলেম ভাড়া করার দিকেই সবাই ছুটবে। এবং এটা বেশি ইজি। মিডিয়ার কর্পোরেট হাউজের একটা লং টার্ম স্বার্থ থাকে। ধর্মব্যবসায়ীর সেটা থাকে না। কাজ শেষে ধর্মব্যবসায়িকে ব্যবহৃত কনডমের মত ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় ।
৪. আজ ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় ইসলামি আন্দোলন (চরমোনাই পীরের দল। ফেবু অফিসিয়াল পেজ) বিশাল প্রতিবাদি সমাবেশের ডাক দিয়েছে, লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুতে। এটা কি নিছক ধর্মানুভূতির জন্য, নাকি কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণ আছে?
রেফারেন্সেসমূহ:
১. যানজট নিয়ে যমুনার ব্যাখ্যা
২. যানজট নিয়ে বসুন্ধরার বক্তব্য
৩. যানজট নিয়ে দুই গ্রুপবহির্ভূত রিপোর্ট
৪. বসুন্ধরার দুর্নীতি (যমুনা-র মতে)
৫. যমুনার দুর্নীতি (বসুন্ধরা-র মতে)
৬. যমুনার মদ-ব্যবসার বিরুদ্ধে আলেম সমাজ (নাকি শুধুই বসুন্ধরা সমাজ?)
৭. মামলা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন