লিখেছেন সেক্যুলার ফ্রাইডে
শৈশব থেকে পাখিপড়ার মত করে প্রতিটি মুসলমান শিশু শেখে - দ্বীন আল্লাহর এবং তার রক্ষকও আল্লাহ। অথচ মুসলমানেরা সকলেই যদি একই ঐশীগ্রন্থ কোরআনেই বিশ্বাসী হবে, তাহলে তার এত ইন্টারপ্রিটেশন কেন, কেনইবা মুসলমানদের মধ্যে এত বিভক্তি, সে প্রশ্নের জবাবে সকলের মুখে পাওয়া যায় একই কৈফিয়তমূলক বুলি: "উহা সহি ইসলাম নহে"।
মডারেট মুসলমানদের অধিকাংশ কোরআন, হাদিস, সিরাত ও ইসলামের ইতিহাসের বিন্দুমাত্র পড়ে না বলেই ইসলাম সম্পর্কে এরা কিছুই জানে না; শুধুমাত্র পরিবারের গুরুজনদের মুখে শুনে, চেরি-পিকিং এর মত করে, পরিপ্রেক্ষিত-বিবর্জিতভাবে, কিছু আপাত নিরীহ আয়াতই তারা বলে ও পড়ে; ফলে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত এবং জীবনাচারে প্রবল ভ্রান্তিতে বসবাস করে।
ইসলাম সম্পর্কে খণ্ডিত ধারনায় এই মডারেট মুসলমানেরা জীবনভর ক্রমাগত সহি ইসলামের খোঁজ করে যায়, কিন্তু ভুলে যায় যে, আল্লাহর বাণী ইসলামের মৌলিক চরিত্র স্থির ও তা সংস্কারযোগ্য নয়।
পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান বলে দাবি করা কথিত মহাগ্রন্থ কোরআনের বাণীর অধিকাংশই ইসলামের নবী মুহাম্মদের জীবদ্দশাকালীন আরব ভূখণ্ডের সমসাময়িক ঘটনাবলীতে সংশ্লিষ্ট; আর সে কারনেই মুহাম্মদ ও ইসলামকে বুঝবার সরলতম ধারাটি হচ্ছে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিতসহ কোরআন ও হাদিস সম্যকভাবে পড়া। ইতিহাসের এই বিষয়গুলো প্রমাণের সর্বজনস্বীকৃত ধারাটি হল এক-কেন্দ্রাভিমুখী (Convergent) বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, যেমন তৎকালীন বিভিন্ন প্রামান্য দলিল দস্তাবেজ, গ্রহণযোগ্য নিদর্শন, ভিন্ন ভিন্ন গবেষণাপত্র, ভ্রমণ ও চাক্ষুষ সাক্ষ্য সম্বলিত ইতিহাস, ছবি, এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন লেখা ও সূত্র ।
কোরআনের কোন সুরাটি কখন, কোন পরিস্থিতিতে নাজেল হয়েছে সেই ইতিহাস ক্রম (chronology) অনুসরণ করাটাই এ ক্ষেত্রে যথার্থ, কারণ তা ইতিহাসের দাবি মেটায়; এই দাবিটি ছিল ইসলামের খলিফা আলীরও। তিনি নিজে সেই ক্রম অনুসারে সংকলিত একটি কোরান প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মূলত বিবি আয়েশার সক্রিয় প্রতিরোধের কারণে তিনি অসমর্থ হন; তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সূচনা হয় রক্তক্ষয়ী এক পারিবারিক যুদ্ধের, যার পরিসমাপ্তি গেল ১৪০০ বছরেও হয়নি এবং যার জের গোটা মুসলিম সমাজ আজও টেনে চলেছে, সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীবাসী সাধারণ মানুষেরাও।
ওপরে লেখা: muhammad says
স্পীচ-বাবলে লেখা: long live diversity
উসমানের সংকলিত কোরআনের যে সংস্করণটি আমরা আজ দেখি, সেটি কোরআনের নাজেলকৃত আয়াতগুলোর মূল ক্রমকে ধ্বংস করে দিয়ে, কোরআনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিনষ্ট করে গ্রন্থটিকে প্রবলভাবে হেঁয়ালিতে পরিপূর্ণ করেছে। একই সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্যে ইসলামের নামে সুন্নি ও শিয়া ধর্মগুরুরা প্রবর্তন করেছে ধর্মের হাদিস ও শরিয়া নামের ভয়ানক এক ডান্ডাবেড়ির, যা উৎসাহিত করেছে অনুধাবন ছাড়াই পুরোটা জীবনভর দুলে দুলে ধোঁয়াটে সুরেলা পংক্তিমালা মুখস্থ করাকে এবং ধর্মান্ধ সেই গোষ্ঠীর সহায়তায় স্বার্থবাদী এই গোষ্ঠীটি ইসলামকে পরিণত করতে পেরেছে সহিংস এক রাজনৈতিক মতবাদে। জিহাদি জোশের ইহলৌকিকতার সাথে এরা সমন্বয় করেছে জান্নাতি হুরীদের পারলৌকিক যৌনলালসাকে, যার ফলশ্রুতি দেশে দেশে আজকের আইসিস, বোকো হারাম, তালিবানের মত বর্বর সব খুনি চক্রের সদম্ভ উপস্থিতি।
কোরআনের অতি প্রাচীন এবং বাতিলযোগ্য ভ্রান্ত ধারণাগুলোর সাথে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতা ও নৈতিকতার কিছুমাত্র মিল নেই বলেই কথিত ধর্মপ্রাণ মডারেট মুসলমানেরা সলজ্জে ইসলামকে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে চলে; ধোঁয়াটে সুরেলা পংক্তিমালাগুলো আরও পরিপূর্ণ করে ছদ্মবিজ্ঞানে, এবং মুসলমানেরা হয়ে ওঠে আরও বিভ্রান্ত। ইসলামের বাণীগুলো ব্যাখ্যার জন্য সর্বজনস্বীকৃত কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই বলেই এই বিভ্রান্তি প্রতিনিয়ত বহুগুণে বাড়ছে, সেই সাথে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
কোরান বা হাদিসগ্রন্থগুলোর সম্যক অনুধাবন ছাড়াই, শুধুমাত্র অস্পষ্ট ধোঁয়াটে বাণীগুলোকে নিজ ধারণাপ্রসূত ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিশাল পণ্ডিতের মত মন্তব্য করা, নিজ অভিমতের বিরোধী যৌক্তিক অবস্থানকে হেলায় মিথ্যাচার বলে নিজেকে প্রবোধ দেয়া, গোঁয়ারের মত কোরান-হাদিসের বাণীকে শুধুমাত্র নিজ মতের পক্ষে বলে দাবি করা এবং সেই দাবির আলোকে ইসলামে বিশ্বাসী বলে দাবিদার আর সকলকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা দিয়ে বোকার স্বর্গেই বসবাস করার যে প্রবণতা, তারই নাম সহি ইসলাম।
সহী ইসলামের হদিস নাকি আছে কোরআনে; সেই কোরআনের অনুসারীরাই আবার বিভক্ত বিভিন্ন মাযহাব, ত্বরিকা, দল, মত ও পথে, যাদের মধ্যে আছে শিয়া, সুন্নী, মুতাজিলা, ওহাবী, কাদিয়ানী, খারিজী, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি ....
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে হানাফী, শাফি, মালেকী, হাম্বলী ইত্যাদি; এ দেশেই আবার হানাফীদের মধ্যে আছে তাবলিগী, জামাতী, দেওবন্দি, ভেরলভি, আহলে হাদিস, আহলে কোরআন ইত্যাদি; সূফীমতের নামে আছে পীরালি, যেমন, জৌনপুরি, ফুরফুরা, শর্ষিণা, চরমোনাই, কুতুববাগী, দেওয়ানবাগী, চন্দ্রপুরী ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি ....
শত সহস্র বিভক্তি, পারস্পরিক ঘৃণা, দ্বেষ ও হিংসার মধ্যে বসবাসকারী এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের বর্বর চিন্তা ও মননের মধ্যে এতটাই নিমজ্জিত, এতটাই নিমগ্ন যে, চরম নির্বুদ্ধিতায় এরা এমনকি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোকেও অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না। কথিত সত্য গ্রন্থের পবিত্রতা রক্ষায় ও কথিত নবীর সম্মান রক্ষায় দলে দলে প্রাণদান করা ও প্রাণ নেয়াও তাদের কাছে মর্যাদার। সে হুমকিও প্রকাশ্যেই তারা দেয় ও দিয়ে চলেছে ...
একবিংশ শতকে এসে রূপকথায় বিশ্বাস করা বর্বর এই গোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থান পৃথিবীবাসির জন্য যে কতটা কষ্টের, সে বোধটাই এদের নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন