লিখেছেন সেক্যুলার ফ্রাইডে
বাংলায় 'জার' শব্দটি যখন বিশেষ্য, তখন তার একটি অর্থ হয়ে ওঠে - গুপ্ত প্রণয়ী; সমাজের চোখে সম্পর্কটি বৈধ নয় এবং সে প্রণয়ের ফলে জন্মে যে-শিশু, তার প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠে - সে জারজাত বা জারজ। বস্তুত বৈজ্ঞানিক ও মানবতাবাদী দৃষ্টিতে জারজ বলে কিছু নেই, কোনো শিশু, কোনো মানুষই অবৈধ নয়; শুধুমাত্র ধর্মের প্রভাবে ধর্মসিদ্ধ বিবাহ-আচারটি ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজ-সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবার তাগিদে সমাজবদ্ধ মানুষেরা এই 'জারজ' শব্দটিকে পরিণত করেছে অত্যন্ত নেতিবাচক একটি শব্দে, মিশ্রিত করেছে স্ব-আরোপিত ঘৃণার সাথে, এবং বঞ্চিত করেছে সামাজিক পরিচয়, উত্তরাধিকার ও বংশবৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত সকল অধিকার হতে; এমনকি প্রণয়ের এই সম্পর্কটিকে ব্যভিচার নামে আখ্যা দিয়ে ভিন্ন-ভিন্ন সমাজব্যবস্থা নির্ধারণ করেছে ভিন্ন-ভিন্ন শাস্তির, যার সবচাইতে বর্বর রূপটি পাওয়া যায় প্রাচীন মরুসংস্কৃতিতে, যার নাম রজম বা পাথর ছুঁড়ে হত্যা।
রজমের ভয়াবহ বর্বর দিকটি সম্পর্কে মুমিনেরা অবগত; অতি নির্মমতার কারণেই এই প্রথাটি মেনে নেওয়া অসম্ভবও; কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে - অধিকাংশ মুসলমান এ নিয়ে মুখ না খুললেও প্রকারান্তরে পুরুতান্ত্রিকতার প্রবল সহিংস প্রকাশটিকে সমর্থনই করেন। এরই বিপরীত চিত্র হচ্ছে - ব্যভিচারকে চরম বর্বরভাবে দেখলেও, জারজ সে শিশুকে সকল সামাজিক পরিচয় ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও সেই মরুসংস্কৃতিই আবার জারজ শিশুটির প্রতি প্রশংসনীয় সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। পিতৃ-পরিচয় না জানলে তাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য করার উপদেশও দিয়েছে [সূরা আল-আহযাব ৩৩/৫]; খ্রিষ্টধর্মেও জারজ সন্তানদেরকে ঘৃণা করাকে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
বহু জারজ সন্তান এবং দাসী-সন্তান খলিফাও হয়েছেন, এমনকি আরবদের পিতা ইসমাইল নিজেও দাসী-পুত্রই। আশ্চর্যজনক অপর একটি সত্য হল - অধিকাংশ কথিত নবী-রসুলদের সুস্পষ্ট পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় না, অথবা যেগুলো পাওয়া যায়, তার প্রায় সকল তথ্যই অসত্য এবং মিথ্যা দাবির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পিতা ছাড়াই যিশু খ্রিষ্টের জন্মকে ব্যভিচারের লজ্জা থেকে বাঁচাতে যে-অলৌকিক গল্পের অবতারণা করা হয়, সেটা কেবল হাস্যকর প্রমাদই নয়, গোটা মানবগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণাও বটে; কিন্তু তাবত মুমিন, কোনও এক অদ্ভুত কারণে, আজও এই মিথ্যাকে পরম শ্রদ্ধায় বিশ্বাস করে চলেছেন।
অপর বিখ্যাত নবী মুহাম্মদের জন্মকাহিনীও দারুণ রহস্যভরা; তাঁর জন্মের ঔরস নিয়ে যুগে যুগে সংশয় প্রকাশ করে গেছেন সকল ঐতিহাসিকই, আর ইসলামের নব্য ঐতিহাসিকেরা প্রবল শঠতায় সেগুলোকে ধামা চাপা দেয়ার প্রবণতায় সৃষ্টি করেছেন কৌতূহলোদ্দীপক সব গল্পের। এমনকি ইসলামের ইতিহাসের মৌলিক সূত্র ইবনে ইসহাক, আল তাবারি, আল হালাবি, ইবনে কাথিরের মত সর্বকালীন স্কলারদেরও তাঁরা অবজ্ঞা ভরে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেন। প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত এবং প্রখ্যাত প্রকাশনার এনসাইক্লোপিডিয়াগুলোও তাঁদের চোখে ষড়যন্ত্র মাত্র।
মুহাম্মদের জন্মরহস্যের মৌলিক সূত্রটি নিহিত কুরাইশ বংশের ইতিহাসে, অপরাপর সূত্রগুলোর মধ্যে তৎকালীন আরবীয় গোত্রগুলোর বৈবাহিক প্রথা, যৌনাচার, পারিবারিক সংস্কৃতি ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। মুহাম্মদ-মৃত্যুপরবর্তীকালে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং সেই জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতা সংহত করার রাজনৈতিক কৌশলের ধারাটির অনুধাবনও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনার দাবি রাখে।
মক্কায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত গোত্রগুলোর মধ্যে কাবার তত্ত্বাবধায়কের কাজটি ন্যস্ত ছিল কুরাইশদের হাতে। অর্থোপার্জনের অন্যতম এই উৎসটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে গোত্রদ্বন্দ্বের অন্যতম একটি কারণ এবং বহুধা বিভক্ত কুরাইশদের মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রধান দুটি গোত্রের - হাশিমি গোত্র ও উমাইয়া গোত্র। উমাইয়া ও হাশিমি - এই দুই গোত্রের দ্বন্দ্ব এসে চরমাকার ধারণ করে হাশিমি নেতা আব্দুল মুত্তালিবের সময়ে; এই আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ঔরসে দশ পুত্র ও ছয় কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পুত্ররা হলেন: আল-আব্বাস, হামযা, আবদুল্লাহ, আবুতালিব, যুবায়ের, হারেস, হাজলা, মুকাওয়েম, দিরা, আবু লাহাব (প্রকৃত নাম আবদুল উয্যা) এবং কন্যারা হলেনঃ সাফিয়া, উম্মে হাকিম আল বায়দা, আতিকা, উমায়মা, আরওয়া, বাররাহ।
আবদুল মুত্তালিবের অন্যতম একটি সাফল্য ছিল যমযম কূপ পুনঃখনন ও তার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মরুভুমির পরিবেশে যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ। তিনি এক পর্যায়ে মানত করেছিলেন যে, যদি তাঁর দশটি সন্তান জন্মে এবং তারা তাঁর জীবদ্দশায় বয়োপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি একটি সন্তানকে কা’বার পাশে কুরবানী করবেন। এ ধরনের মানতের জন্য নির্ধারিত প্রথা ছিল তীর টানার মধ্য দিয়ে ‘হুবাল’ দেবমূর্তির কাছে ভাগ্য পরীক্ষা; তীরে যা লেখা থাকবে সে ফায়সালাই হবে চূড়ান্ত ফায়সালা; তীরের এই পরীক্ষায় আবদুল্লাহ'র নাম উঠে এলে আবদুল মুত্তালিব তাকেই কুরবানি করতে উদ্যত হন; পরবর্তীতে অন্যান্য কোরাইশ নেতা ও তার পুত্রদের অনুরোধে মুক্তিপণ দিয়ে অব্যাহতি নেন, উল্লেখ্য যে এই মুক্তিপনের জন্য দশ বার তীর টানা হয় এবং একশত উটের বিনিময়ে আবদুল্লাহ তার প্রাণভিক্ষা পান।
মুহাম্মদের দাদা মুত্তালিব আরবদের স্বাভাবিক নারী-পাগল প্রবণতার বাইরে ছিলেন না, তিনি নিজেও একাধিক বিবাহ করেন; এমনকি তিনি যখন তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ'র সাথে অয়াহাব ইবন আবদ মানাফের কন্যা আমেনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান, তখন কথাবার্তা চালাতে গিয়ে অয়াহাবের ভাগ্নি হালার রূপদর্শন করে মোহিত হন এবং তার পাণিপ্রার্থী হন। অয়াহাব তাতে সম্মত হলে পিতা ও পুত্রের বিয়ের অনুষ্ঠানও একই দিনে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়।
আবদুল মুত্তালিব আর হালার ঘরে যে পুত্রসন্তান জন্মায় তারই নাম হামজা; ইনি মুহাম্মদের অন্যতম খ্যাতনামা সাহাবি ছিলেন, এবং ইসলামী সূত্রমতে - তিনি মুহাম্মদের চাইতে বয়েসে চার বছরের বড় ছিলেন। আবদুল্লাহ ও আমিনার বৈবাহিক সম্পর্কটি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; বিয়ের ৬ মাসের মধ্যেই আবদুল্লাহ অকাল মৃত্যুবরণ করেন। ইসলামী সূত্রমতে - এ সময় আমিনা গর্ভবতী ছিলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে মুহাম্মদ জন্মগ্রহন করেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: এই হামজা মুহাম্মদের চাচা হলে এবং তিনি বয়েসে মুহাম্মদের চাইতে চার বছরের বড় হলে এবং মুহাম্মদ আবদুল্লাহ'র ঔরসজাত সন্তান হলে আমেনা কি সকল লৌকিক নিয়মের বাইরে চার বছরব্যাপী গর্ভবতী ছিলেন? সেটিও কি একটি মু'জেজা? তবে এই বিশেষ মু'জেজাকে কেন গোপন করবার চেষ্টা করা হয়? সুরা রা'দ, আয়াত ৮-এ কি তাই আল্যা বলেছেন, "আল্লাহ জানেন প্রত্যেক নারী যা গর্ভধারণ করে এবং গর্ভাশয়ে যা সঙ্কুচিত ও বর্ধিত হয়। এবং তাঁর কাছে প্রত্যেক বস্তুরই একটা পরিমাণ রয়েছে।"
জাগতিক নিয়ম মেনে মুহাম্মদ আমেনার পুত্র হলেও আবদুল্লাহ'র ঔরসজাত সন্তান হতে পারেন না; জাগতিক নিয়মে ও ধর্মের সংজ্ঞায় তিনিও একজন জারজ সন্তান। গুপ্ত সে প্রণয় আজও গুপ্তই রয়ে গেছে।
সূত্র:
1. Prophet Muhammad (S) and His Family: A Sociological Perspective By Aleem
2. The Life of Muhammad: Al-Waqidi's Kitab Al-Maghazi
3. Muhammad ibn Saad, Tabaqat vol. 3. Translated by Bewley, A. (2013). The Companions of Badr, London: Ta-Ha Publishers
4. Ibn Ishaq, The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq's Sirat Rasul Allah, Translated by A. Guillaume, Oxford University Press, Oxford, England,
5. Al-Tabari (838? – 923 A.D.), The History of al-Tabari (Ta’rikh al-rusul wa’l-muluk), Translated by W. M. Watt and M.V. McDonald, State University of New York Press, Albany, NY, 1988
--------------
ধর্মপচারক-এর পক্ষ থেকে:
'নাস্তিকদের বাপের/জন্মের ঠিক নাই' - এমন কথা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় আস্তিকীয় খিস্তিখেউড়ে। এদের মতে, ধর্মসম্মত উপায়ে রেজিস্ট্রিকৃত বিবাহবন্ধনে দম্পতিদের জন্ম দেয়া সন্তানগুলো ছাড়া বাকি সমস্ত সন্তান জারজ।
নিজের জন্মের ওপরে কারুর হাত থাকে না। আর তাই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও সন্তান অবৈধ তথা জারজ ঘোষিত হলেও তাকে ঘৃণা, অবজ্ঞা বা হেয় করার ভেতরে আছে ছোটোলোকি, অমানবিকতা ও বর্বরতা।
ওপরের নিবন্ধ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়: ইছলামের নবীর জন্ম, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, নিশ্চিতভাবেই অবৈধ। কিন্তু আমরা, অন্তত এ বিষয় নিয়ে, ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ করবো না। তার কঠোর সমালোচনা আমরা করবো তার কর্মকাণ্ডের জন্য, কিন্তু গালিকামিল মমিনদের পথ ধরে আমরা অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলবো না, "দ্যাখ, তোদের নবীর বাপের/জন্মের ঠিক নাই।"
ইছলামের নবীর জন্মরহস্য বিষয়ে একটি তথ্যবহুল ভিডিও দেখুন:
ভিডিও লিংক: http://youtu.be/eppDnzmPJfk
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন