শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

হ্যাংলা ধর্ম, বর্বর ধর্ম, সত্যবিমুখ ধর্ম

লিখেছেন শোভন

ধর্ম আর বিজ্ঞান - দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। ধর্মের ভিত্তি যেখানে অন্ধবিশ্বাস, বিজ্ঞানে সেখানে বিশ্বাসের কোনো জায়গাই নেই, যদি আপনি উপযুক্ত প্রমাণ আর যুক্তি দেখাতে পারেন, তবেই কেবলমাত্র আপনার কথাটাকে গ্রাহ্য করা হবে। তা না হলে আপনি কী বিশ্বাস করলেন না করলেন, সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। এখান থেকেই বোঝা যায়, ধর্ম আর বিজ্ঞান কতটা ভিন্নধর্মী। মোট কথা, ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের আপাত কোনো বিরোধও নেই, আবার বন্ধুত্বও নেই। বিজ্ঞানের সাথে সত্য ঘটনার বন্ধুত্ব আর মিথ্যা-কল্পনার বিরোধ। 

প্রাচীন কালে অনেক অনেক বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, দেবী হেরার মাতৃদুগ্ধ থেকে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে অ্যাটলাস-এর (গ্রিক মিথোলজি) মাথার ওপর পৃথিবী থাকা এবং সূর্যের পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরা - সবই প্রাচীন কালের বিশ্বাস এবং এগুলোকে তখন সত্য বলে মানা হত। এখনকার ধার্মিকদের জন্ম যদি সেই সময় হত, তাহলে তারাও এটাকে সত্য বলত, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের আলো এসব অন্ধকারকে দূর করে দিল। মিথ্যা কল্পনাকে দূর করে সত্যটা জানালো পুরো বিশ্বকে। পৃথিবী যে অ্যাটলাসের মাথার ওপর নেই, হেরার মাতৃদুগ্ধ হতে যে আমাদের গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়নি, পৃথিবীর চারদিকে যে সূর্য ঘোরে না, এসব এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য।

এর পরও যদি কেউ এই সমস্ত প্রাচীন বিশ্বাসকে সত্য ধরে বসে থাকে, তো সে হবে সবার কাছে হাসির পাত্র। সত্যটাকে প্রকাশ করার জন্য বিজ্ঞানকেও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বিরোধিতা এলো ধর্ম থেকেই, কারণ ধর্ম হল বিশ্বাস, আর বিশ্বাসকে মুছে দিয়ে জ্ঞানের আলো আনার প্রচেষ্টা করায় ধর্মরক্ষক ও ধর্মব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে লাগলো সত্য উদ্ঘাটনকারীদের পেছনে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল সক্রেটিস, গ্যালিলিও এবং জিওনার্দো ব্রুনোর মত জ্ঞানীদের। তাঁরা মারা গিয়েছেন, কিন্তু সত্য কিন্তু অপ্রকাশিত থাকেনি। তাদের প্রকাশ করা তথ্য এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার সবার সামনে।

এ সকল ঘটনা থেকে মানবজাতির একটা হলেও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত ছিল, সেটা হলো: আমরা ছোটবেলা থেকে যেটা বিশ্বাস করে আসছি, সেটা সত্য না-ও হতে পারে। সেটাকে ধরে বসে থাকলে আমরা সত্যটা কোনদিনও জানতে পারবো না। 

যদি মানুষ তাদের প্রাচীন বিশ্বাসকে ধরে বসে থাকতো, তো এখন এই মহাবিশ্বের অনেক রহস্যই আমাদের কাছে অজানা থেকে যেত, আমরা থেকে যেতাম অন্ধকারের ভেতরেই। বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকলে কোনোদিনও সম্ভব হবে না জ্ঞানের আলোয় আসা। কিন্তু মানবজাতি কি সে শিক্ষা গ্রহণ করেছে? না, তারা সেই পুরনো ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে এই একুশ শতকে এসেও। ভুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য এখনও প্রাণ দিতে হচ্ছে দাভোলকার, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার (থাবা বাবা), সফদর হাসমি, গোবিন্দ পানসারেরা, অভিজিৎ রায়-এর মত লোকদের। এখনও এমন অনেক বিশ্বাস আমাদের ভেতর প্রচলিত, ঠিক প্রাচীন কালের মত, যাকে ছাড়তে আমরা নারাজ, যাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য আমরা খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করি না, কারণ তা আমাদের ধর্মের অন্ধবিশ্বাস। 

কোনো এক বৃদ্ধ ঈশ্বর আকাশে বসে থেকে আমাদের পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আদমের পাঁজরের হাড্ডি থেকে সৃষ্টি হয়েছে হাওয়া, খোলা চোখে দেখলে বোঝা যায় যে, এসবের সাথে প্রাচীন ওইসকল বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। এক সময় সেগুলো সত্য ছিল, এখন সেগুলো রূপকথা, এখন যে প্রমাণহীন বিশ্বাসগুলোকে আমরা সত্য বলে ধরে বসে আছি, এসবও একদিন রূপকথায় পরিণত হবে। ব্রুনোকে পুড়িয়ে সত্যটা যেমন থামানো যায়নি, অভিজিৎকে মেরেও সত্যটা থামানো যাবে না। আজ যদি আপনি কারোর সামনে গিয়ে বলেন, "সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে", তখন আপনাকে নিয়ে হাস্য-কৌতুকের অন্ত থাকবে না, (যেমন, এখন মানুষ কৌতুক করছে সৌদির সেই "বিগ্যানী"-কে নিয়ে, যে বলেছে সূর্যই নাকি পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে), ঠিক তেমনি আজ থেকে কোনো এক নির্দিষ্ট সময় পর যখন আপনি কারোর কাছে বলবেন, "আদমের হাড্ডি থেকে হাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল", তখন আপনি যে উত্তরটা পাবেন, তা হলো "ড্যুড, তুমি কি এখনও সেই একুশ শতকের রূপকথাতে বিশ্বাস কর?! মাথায় সমস্যা আছে তোমার!" বিশ্বাসের পরিণতি চিরকাল এমনই ছিল, এমনই থেকে যাবে। বিজ্ঞানের কাজ হল এই অপ্রয়োজনীয় বিশ্বাস ভাঙার কাজটাকে তরাণ্বিত করা, আর ধর্মের কাজ হল কাজটার গতিকে বাধা দেয়া, মন্থর করে দেওয়া।

অধর্ম ঠেকিয়ে ধর্মকে বাঁচাতে ধার্মিকেরা এখনও দৃঢ়। তবে এখন তাদের পন্থাটা বদলে গেছে। তারা বুঝে গেছে যে, বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে তারা ইতিহাসে কখনও জিততে পারে নি, ভবিষ্যতেও পারবে না। সুতরাং বিজ্ঞানের সাথে লড়তে হলে লাগবে তাদের নিজেস্ব বিজ্ঞান। কিন্তু তারা এটা বুঝতে ভুল করেছে যে, বিজ্ঞানের কোন প্রকারভেদ নেই, বিজ্ঞান বিজ্ঞানই, এটা ধর্মেরও ধার ধারে না, অধর্মেরও ধার ধারে না। বিজ্ঞানকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়ে তারা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছে তাদের "স্যুডো বিজ্ঞান", যার ভিত্তি তাদের সেই পুরোন বস্তাপচা বিশ্বাস।

এই আধুনিক সমাজে হাজার হাজার ভণ্ড উদয় হয়েছে সকল ধর্ম থেকেই, যারা প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় ধর্মের সাথে বিজ্ঞানকে মেলানোর। তারা অপ্রাণ চেষ্টা করে যায় বিজ্ঞানের কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট পাবার যে "হ্যাঁ, এই ধর্মই বিজ্ঞানসম্মত, এই ধর্মই সত্য।" এর কারণ একটাই, যা আগেই বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের সাথে সত্যের বন্ধুত্ব, আর মিথ্যা-কল্পনার বিরোধ। তাই নিজের ধর্মকে সত্য প্রমাণ করার জন্য সেইসব ভণ্ডদের যা দরকার, তা হল বিজ্ঞানের কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট। তবে ধর্মের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বিজ্ঞানের কিন্তু কখনোই হয় না।

এই সার্টিফিকেট পাবার জন্য তারা পৃথিবী ওল্টাতেও দ্বিধাবোধ করে না। নিজেদের ধর্মগ্রন্থ থেকে আসা বিভিন্ন জিনিস থেকে তারা একটু ঘুুরিয়ে রং চড়িয়ে বিজ্ঞানের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে তাদের এ পাগলামি সীমা ছাড়িয়ে যায়, হাসির পাত্র হয়ে ওঠে তারা, যেমন এখন পৃথিবীর অন্যতম হাসির পাত্ররা হল জাকির নায়েক, জয়েল অস্টিন, জয়েস মায়ার, ইত্যাদি। বিজ্ঞান যখন কঠোর গবেষণা আর পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, ঠিক তখনই ঘন্টা বাজাতে বাজাতে উপস্থিত হন সেই ভণ্ডরা। "আমার ধর্ম গ্রন্থে এটা এত বছর আগেই লেখা ছিল! যেটা বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেল আজ!!" 

এই কাহিনীই চলে আসছে আদিকাল থেকে। বিজ্ঞান কিছু আবিষ্কার করে, আর ওমনি জাকির নায়েক, জোয়েল অস্টিন জাতীয় কেউ সেটা কোরান-বাইবেলে খুঁজে পায়। আজ পর্যন্ত এর উল্টোটা হতে দেখা যায় না যে, জোয়েল, জাকির কুরান বাইবেল থেকে কিছু আবিষ্কার করার পর তার শত বছর পরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখল - এটা সত্য। কুরান আর বাইবেলে যদি সকল বিজ্ঞান আগে থেকেই থাকতো, তবে চার্চের পাদ্রী আর মাদ্রাসার ছাত্ররা হত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ল্যাবরেটরির বদলে সকল স্থানে বসানো হত মাদ্রাসা আর চার্চ। 

মানুষ কি কোনোদিনও বুঝবে এই পরিষ্কার সত্যটা যে, চিরকাল পুরনো বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকা সম্ভব না এবং এটা করার চেষ্টা করাটাও বোকামি? এটা চিন্তা করে আমার খুবই দুঃখ লাগে যে, এখনও পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই যুক্তি, প্রমাণ এবং রিজোনিং-এর চেয়ে তাদের বস্তাপচা ধর্মীয় বিশ্বাসকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। তাদের অন্ধবিশ্বাসের পরিণতি সম্পর্কে এত ঘটনা, এত উদাহরণ তাদের চোখের সামনে পেশ করার পরও তারা অন্ধের মত অন্ধকার পথের দিকেই যায়। 

পৃথিবী কি এমনই থেকে যাবে চিরকাল? চিরকালই কি সত্য প্রকাশ করার জন্য ধর্মের কাছে প্রাণ হারাতে হবে ব্রুনো, গ্যালিলিও, অভিজিৎ আর হুমায়ুন আজাদের মত জ্ঞানীদের? হয়ত হবে। সত্য বলার অপরাধে ব্রুনোকে মরতে হয়েছিল, কিন্তু সত্যটা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। সত্য বলার অপরাধে অভিজিৎকে মরতে হল, কিন্তু সত্য ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে ও হবে, আবার হয়ত এমনই কোনো এক সত্য বলার অপরাধে ভবিষ্যতে কোনো এক মূল্যবান জীবন হারিয়ে যাবে, কিন্তু সত্যটা ঠিকই প্রকাশিত হবে। সত্যটা চিরকাল ঠিকই প্রকাশিত হবে। সত্যটা চিরকাল ঠিকই প্রকাশিত হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন