লিখেছেন ক্যাটম্যান
শুক্রবার সকালে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসব শুরু হয়েছে। ভোর ৫ টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে স্নান উৎসব শুরু হয়ে শনিবার ভোর ৬ টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে লগ্ন শেষ হয়। এক্ষেত্রে ভগবানেরও যে ঘন্টা, মিনিট ও সেকেন্ড সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রয়েছে, তা স্বীকার করতেই হবে।
যাই হোক, ততক্ষণে পুণ্যস্নানকে কেন্দ্র করে এক মহা অঘটন ঘটে গেছে। পুণ্যস্নান শুরু হওয়ার প্রায় দু’ ঘন্টার মাথায় পদদলিত হয়ে দশজন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে মাদারীপুর জেলার চর মুগরিয়া কলেজের একজন ছাগাধ্যাপকও রয়েছেন। যিনি তার জীবনে অর্জিত অজস্র পাপের ভার সইতে না পেরে নিজ জেলা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে এসেছিলেন পাপস্খলনের আশায়। কিন্তু নদের জলে পাপস্খলনের পরিবর্তে পাপী পুণ্যার্থীদের নির্মম পদাঘাতে জীবন-স্খলনের বন্দোবস্ত হয়ে গেছে তার। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কারণ অজস্র পাপে জর্জরিত দুর্বিসহ জীবন ধারণ করার চাইতে নির্মম পদাঘাতে অপমানজনক মৃত্যু অধিক উত্তম ও সম্মানের।
তাছাড়া নদের জলে মানুষের পাপস্খলনের সম্ভাবনা যতটুকু আছে, তার চেয়ে পাপী মানুষের পদাঘাতে পাপস্খলনের সম্ভাবনা অধিক। নরাধম পাপীর আত্মসম্মানবোধ না থাকতে পারে, তবে পাপের নিজস্ব সম্মানবোধ অবশ্যই রয়েছে। যে কারণে পাপ পৃথিবীর কোনও সাধারণ ও নিকৃষ্ট প্রাণীর জীবনে ভর না করে অসাধারণ ও উৎকৃষ্ট জীব মানুষের জীবনে ভর করে এবং তার জীবনকে পাপে জর্জরিত করার মধ্য দিয়ে দুর্বিসহ করে তোলে। এমন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন পাপ অন্যের পদাঘাতজনিত অপমান সহ্য করে পাপী ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে পড়ে থাকবে তেমন আশা আমরা করতে পারি না। তাই লাঙ্গলবন্দে নিহত দশজন ব্যক্তি পদাঘাতে জীবন হারিয়ে যারপর নাই লাভবান হয়েছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
যে রূপকথাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর লাঙ্গলবন্দে পাপস্খলনের এই মহাযজ্ঞ আয়োজন করা হয়ে থাকে, তা এতটাই হাস্যকর যে, না জানলে উপলব্ধি করা কঠিন হবে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ কতটা সনাতনি নরছাগ। পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায়:
একদিন পরশুরামের মা রেণুকাদেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ (মতান্তরে বেশ্যাদের সাথে) জলবিহার করছিলেন। পদ্মমালীর রূপ এবং বেশ্যাদের সমবেত জলবিহার অর্থাৎ জলে নেমে যৌনসঙ্গমের দৃশ্য অবলোকন করে রেণুকাদেবী এতটাই মোহিত হন যে, তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন আর সেইসাথে জলে নেমে পদ্মমালীর সাথে বেশ্যাদের অনুরূপ যৌনসঙ্গমের কামনা অনুভব করেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে গেলেও সেদিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরে পেলে রেণুকাদেবী কলস ভরে জল নিয়ে গিয়ে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ান। এদিকে ঋষি জমদগ্নি তপোবলে সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। পিতার এমন অন্যায় আদেশ শুনে প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীকালে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে পেতে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই থাকে। শত চেষ্টা করেও সে কুঠার খসাতে পারেন না তিনি। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করেন তার পাপ মুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বলেন, তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে, মনে রাখবে সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান। পিতার কথামতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে থাকেন। শেষে ভারতবর্ষের সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুন্ডের পুণ্যজলে স্নান করে তার হাতের কুঠার খসে পড়ে। পরশুরাম মনে মনে ভাবেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্তলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁওয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্য এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী ( অশোকাষ্টমী ) তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নান শাস্ত্রোক্ত মতে নির্ধারিত বিধায় প্রতি বছর উক্ত তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে পাপস্খলনের নিমিত্তে এই পুণ্যস্নান উৎসব পালিত হয়।
একজন মাতৃহন্তারকের মনগড়া ফর্মুলাকে পাপমুক্তির উপায় মেনে ছাগসনাতনি পাপী পুণ্যার্থীগণ ‘হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য তুমি আমার পাপ হরণ কর’ — এ মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী ফুল, বেলপাতা, ধান, দুর্বা, হরিতকী, ডাব, আমের পল্লব পণ্ঠভেতি দিয়ে তর্পণপূর্বক ব্রহ্মার নিকট কৃপা প্রার্থনা করে স্নান সম্পন্ন করেন। আর তা করতে গিয়ে পাপী সনাতনি নরছাগগণ নদ-নদী দূষণের ন্যায় মারাত্মক অপরাধ সংঘটনে অংশগ্রহণ করেন। এতদিন জানতাম নদ-নদী দূষণের জন্য শুধু শিল্প-বর্জ্য দায়ী, কিন্তু এখন দেখছি, মানুষের পাপও নদ-নদী দূষণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। মানুষ দিনে দিনে শুধু পাপ কামাবে, আর নদ-নদী, সাগরে গিয়ে তা ঢেলে দিয়ে জল দূষিত করবে, এমন অন্যায় মেনে নেয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে আইন হওয়া উচিত এবং পাপী মানুষের পাপ দ্বারা সংঘটিত জল দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও আরও সক্রিয় হতে হবে। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষার্থে পাপী মানুষের কর্তব্য হওয়া উচিত, নিজেদের অর্জিত পাপ ঢেলে নদ-নদী ও সাগরের জল ঘোলা ও দূষিত না করে নিজ নিজ স্নানাগার বা গোসলখানায় ই. টি. পি. স্থাপন করে নিজেদের পাপ-বর্জ্য নিজ উদ্যোগে পরিশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এতদিন জানতাম গাধা জল ঘোলা করে, এখন দেখছি গাধার সাথে পাল্লা দিয়ে পাপী মানুষেরাও নিজেদের পাপ-বর্জ্য ঢেলে জল ঘোলা করে। হায়রে নরছাগ! হায়রে পাপ! হায়রে জল!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন