অনলাইনে দেশপ্রেমের জোয়ার ওঠে থেকে থেকেই। অনেকের কাছেই দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটি এরকম:
আমার দেশের সবকিছুই শ্রেষ্ঠ, এর একমাত্র কারণ - আমার জন্ম হয়েছে এখানে।
দেশপ্রেমের এই ধারণাটি অন্ধত্বসূচক বিধায় অগ্রহণযোগ্য হলেও অন্যদের জন্য হানিকর, খুব সম্ভব, নয়। তবে বর্তমানে চর্চিত দেশপ্রেমের একটি ভিন্নতর ও কুৎসিত বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষণীয় - নিজেদের হীনতা ও দীনতা যথাসম্ভব গোপন রেখে অন্য দেশগুলোকে হেয় করার মাধ্যমে নিজের দেশকে মহিমান্বিত করার কদর্য প্রবণতা, যেটাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে:
নিজেদের মলমণ্ডিত পশ্চাদ্দেশ সজ্ঞানে ও সযত্নে আড়াল করে রেখে অন্যদের পশ্চাদ্দেশে মল অন্বেষণের নাম দেশপ্রেম।
এই দেশপ্রেম মূলত দ্বেষপ্রেম - নিজের দেশকে ভালোবাসার নামে অন্য দেশ বা দেশগুলোর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তৃপ্তিলাভ।
এ নিয়ে লিখছেন তিনজন।
১.
দাঁড়িপাল্লা ধমাধম
একটি আনঅফিসিয়াল ইণ্ডিয়ানের মওকায় সমস্ত ইণ্ডিয়ানদের দোষ হয়; একটি ফেইক পাকিস্তানি প্লেয়ারের ফেইক টুইটে সমস্ত পাকিস্তানের দোষ হয় - একজন পাহাড়ি নির্যাতিত হলে কবে সমস্ত বাঙালীর দোষ হবে? একজন অভিজিৎ রায় খুন হলে কবে সমস্ত বাংলাদেশের দোষ হবে?
২.
জুলিয়াস সিজার
রাজনাধীর উত্তরায় একটি প্রাইভেট মেডিকেলে পড়া এক কাশ্মীরি মেয়ে বাংলাদেশি বীরপুরুষদের (!) হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কাশ্মীরী মেয়েটা বোকা না। বোঝে, লাল-সবুজের সেই সর্বশ্রেষ্ঠ শোনার (!) বাংলায় বিচার পাওয়া যাবে না। তিনি বাংলাদেশ ছেড়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে মনে মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম, কারণ এই নিকৃষ্ট, অন্যায়-অত্যাচার, অবিচারে ভরা এই ফালতু রাষ্ট্রটিতে আমার জন্ম হয়েছে এবং তিনি আমার দেশেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
একটি বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের অনলাইনে যেমন দেশপ্রেমিকের অভাব নেই, তেমনি অভাব নেই অফলাইনেও। পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম, কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের রাষ্ট্র এই ধর্ষণের ঘটনা চেপে গেছে, কারণ এই ধর্ষণের সাথে আমাদের দেশের মানসম্মান জড়িত! আমার দেশে কোটি কোটি দেশপ্রেমিক আছে। ভেবে দেখতে পারেন? যারা দেশের মানসম্মানের কথা চিন্তা করে একটি মেয়ের ওপরে ধর্ষণের মত ঘটনাও চেপে যায়। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে দেশপ্রেমের যে-অ্যাটম বোমা তৈরি হচ্ছে, একদিন যদি এই অ্যাটম বোমা বিস্ফোরিত হয়, তাহলে, আশা করি, বাংলাদেশ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ওদিকে এক মারমা গর্ভবতী মেয়েকে স্বাধীনতার মাসে ধর্ষণ করেছে তাঁর স্বামীকে আটকে রেখে স্বামীর সামনেই। আর ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্মরণীয় বিজয় উদযাপন করতে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে আবার এক কিশোরি চাকমা মেয়েকে। মহান স্বাধীনতার মাসে অনন্য অর্জন! এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! কবি যথার্থ বলেছেন।
আর এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই পাছা বন্ধক রাখা প্রজন্মের, একালের অনলাইন যোদ্ধাদের (কখনো আবার একালের মুক্তিযোদ্ধাও বলা হয়); তারা ইন্ডিয়াকে রেপিন্ডিয়া ডেকে সুখ খুঁজে পাচ্ছে। শুধু একটু পিছনে তাকিয়ে দেখে না যে, নিজের পাছাতেই কাপড় নেই।
কাশ্মীরী মেয়ের ধর্ষণের ঘটনার মতো পাহাড়িদের উপর ধর্ষণের ঘটনাও অধিকাংশ সময় চেপে যায় সরকার। বহির্বিশ্বে যেন বাঙালির সুনাম (!) ক্ষুন্ন না হয়। আশা করি, সামনে সমতলের মেয়েদের ওপর ধর্ষণে ঘটনা মিডিয়া চেপে যাবে। বাংলাদেশে কোনো ধর্ষণের ঘটনা পৃথিবীর মানুষ জানবে না। তারা জানবে, বাংলাদেশে কোনো ধর্ষণ হয় না।
আপনারা তো দেশপ্রেমিক। আপনারা তো দেশের সুনামই দেখতে চান, নাকি?
৩.
আশরাফুল আলম
'ইহা আসল ইসলাম নয়' কিম্বা 'মাইয়াটার কাপড় ঠিক ছিল না, ধর্ষণ তো লোকে করবেই' থিওরির চলন খুব। সংক্ষেপে এইটাকে ভণ্ডামি বলে। ভণ্ডামির সংজ্ঞা হইল গিয়া, নিজের বেলায় এক স্ট্যান্ডার্ড, অন্যের বেলায় আরেক স্ট্যান্ডার্ড। এক ইন্ডিয়ানের দোষে পুরা ইন্ডিয়ারে তুলাধুনা করা যাবে, কিন্তু দুই-একজন তথাকথিত খারাপ লোকের দোষে বাংলাদেশের ব্যাপারে বা ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না।
ইন্টারেস্টিংলি, আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষই ভণ্ড, তবে সেটা তারা স্বীকার করেন না। তারা হিন্দুদেরকে মালাউন বলতে বলতেই বড় হয়েছেন, তবে কেউ মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী বললে তারা সেইখানে রেসিজম খুঁজে পান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন