শুক্রবার, ২৯ মে, ২০১৫

খন্দক যুদ্ধ -৩: সালমান ফারসীর উপাখ্যান!: কুরানে বিগ্যান (পর্ব- ৭৯): ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ – তেপ্পান্ন

লিখেছেন গোলাপ

পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫ > পর্ব ১৬ > পর্ব ১৭ > পর্ব ১৮ > পর্ব ১৯ > পর্ব ২০ > পর্ব ২১ > পর্ব ২২ > পর্ব ২৩ > পর্ব ২৪ > পর্ব ২৫ > পর্ব ২৬ > পর্ব ২৭ > পর্ব ২৮ > পর্ব ২৯ > পর্ব ৩০ > পর্ব ৩১ > পর্ব ৩২ > পর্ব ৩৩ > পর্ব ৩৪ > পর্ব ৩৫ > পর্ব ৩৬ > পর্ব ৩৭ > পর্ব ৩৮ > পর্ব ৩৯পর্ব ৪০ > পর্ব ৪১ > পর্ব ৪২ > পর্ব ৪৩ > পর্ব ৪৪ > পর্ব ৪৫ > পর্ব ৪৬ > পর্ব ৪৭ > পর্ব ৪৮ > পর্ব ৪৯ > পর্ব ৫০ > পর্ব ৫১ > পর্ব ৫২ > পর্ব ৫৩ > পর্ব ৫৪ > পর্ব ৫৫ > পর্ব ৫৬ > পর্ব ৫৭ > পর্ব ৫৮ > পর্ব ৫৯ > পর্ব ৬০ > পর্ব ৬১ > পর্ব ৬২ > পর্ব ৬৩ > পর্ব ৬৪ > পর্ব ৬৫ > পর্ব ৬৬ > পর্ব ৬৭ > পর্ব ৬৮ > পর্ব ৬৯ > পর্ব ৭০ > পর্ব ৭১ > পর্ব ৭২ > পর্ব ৭৩ > পর্ব ৭৪ > পর্ব ৭৫ > পর্ব ৭৬ > পর্ব ৭৭ > পর্ব ৭৮

সালমান ফারসী নামের এক অনুসারীর পরামর্শে স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীরা মদিনার উত্তর দিকে কীভাবে খন্দক খনন করেছিলেন; খন্দকটি তারা কোথা থেকে কোথায় সংযোগ করেছিলেন; মুহাম্মদের নেতৃত্বে মুসলমান বাহিনী, আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে কুরাইশ বাহিনী এবং ইউয়েনা বিন হিসন, আল-হারিথ বিন আউফ ও মিসা'র বিন রুখায়েলার নেতৃত্বে ঘাতাফান বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রের কোথায় অবস্থান নিয়েছিলেন; মদিনার তিনটি সম্পদশালী ইহুদি গোত্রের দুইটিকে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা জোরপূর্বক বিতাড়িত করার পর একমাত্র অবশিষ্ট বনি কুরাইজা গোত্রের অবস্থান কোথায় ছিল - ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে। 

খন্দক খননের মাধ্যমে শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করার কৌশল তৎকালীন আরবের লোকেরা জানতেন না। মুহাম্মদও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।

কিন্তু পারস্যবাসীরা তা জানতেন। শত্রু-কবলিত হওয়ার আশংকা কালে প্রয়োজনবোধে তারা এই প্রতিরক্ষা কৌশলটি অবলম্বন করতেন। সালমান ফারসীর 'খন্দক খনন পরামর্শ ও তার বাস্তবায়নের' মাধ্যমে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা খন্দক যুদ্ধে তাদের সম্ভাব্য চরম বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কে এই সালমান ফারসী?

মুহাম্মদ ইবনে ইশাক "কীভাবে সালমান মুসলমান হয়েছিলেন (How Salman became a Muslim)" শিরোনামে সালমান ফারসীর উপাখ্যান লিপিবদ্ধ করেছেন। 

মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) সেই বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার: [1]

আবদুল্লাহ বিন আব্বাসের কাছ থেকে প্রাপ্ত মাহমুদ বিন লাবিদের তথ্যের ভিত্তিতে, আসিম বিন উমর বিন কাতাদা আল-আনসারি আমাকে [মুহাম্মদ ইবনে ইশাক] যা বর্ণনা করেছেন:

সালমানের নিজের বর্ণনায় আমি [আবদুল্লাহ বিন আব্বাস] যা শুনেছি তা হলো,

“আমার আদি নিবাস ছিল পারস্যের [বর্তমান ইরান] ইস্পাহান প্রদেশের জেয়য়ি (Jayy) নামক গ্রামে। আমার পিতা ছিলেন ঐ গ্রামের প্রধান জোতদার (land owner), তার কাছে আমি ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ এত গভীর ছিল যে, তিনি আমাকে সর্বদাই বাড়ির ভেতরে রাখতেন, যেন আমি ছিলাম এক ক্রীতদাস।

আমি প্রবল আগ্রহে পারস্য পুরোহিতদের মত ‘পবিত্র অগ্নিশিখা’জ্বালিয়ে রাখার কাজে নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত করেছিলাম যে, আমি এক মুহূর্তের জন্যও অগ্নি নির্বাপিত হতে দিতাম না।

আমার পিতা ছিলেন এক বিশাল কৃষি ফার্মের মালিক। একদিন যখন তিনি তাঁর ফার্মে উপস্থিত হতে পারেননি, তিনি তখন আমাকে সেখানে যেতে বলেন ও এ বিষয়ে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করতে বলেন। এ ব্যাপারে তিনি আমাকে কিছু নির্দেশ দেন। 

তিনি বলেন, ‘ওখানকার কাজে নিজেকে বেশিক্ষণ আটকে রাখবে না, কারণ তুমি আমার কাছে এই ফার্মের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ; তাতে তোমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমার কাজের ব্যাঘাত হবে।’

তাই আমি ফার্মে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই। যখন আমি একটি খ্রিষ্টান চার্চের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমি সেখানকার লোকদের প্রার্থনার শব্দ শুনতে পাই। আমি তাদের সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, কারণ আমার পিতা আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না।

তাদের প্রার্থনার শব্দ শোনার পর তারা কী করছে তা দেখার জন্য আমি সেখানে যাই। তাদের প্রার্থনা আমাকে তৃপ্ত করে ও আমি তাদের উপাসনায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ি এবং আমার মনে হয়, তাদের ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে উত্তম। আমি সিদ্ধান্ত নিই, সূর্যাস্তের আগে আমি তাদেরকে ছেড়ে চলে যাব না। তাই আমার আর ফার্মে যাওয়া হয় না।

যখন আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি যে, তাদের ধর্মের উৎস স্থান কোথায়, তারা বলে, 'সিরিয়া'।

আমি আমার পিতার কাছে ফিরে আসি। তিনি আমাকে খোঁজার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন ও আমার জন্য এমন দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে, তাঁর সারাদিনের সমস্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটেছিল। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চান, আমি কোথায় ছিলাম। তাঁর নির্দেশ পালন না করার জন্য তিনি আমাকে বকাবকি করেন। 

আমি তাকে জানাই যে, চার্চে প্রার্থনারত কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তা দেখে তাদের ধর্মের প্রতি আমি এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ি যে, সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি তাদের সঙ্গেই সময় কাটাই।

তিনি বলেন, 'বৎস, ঐ ধর্ম ভাল নয়; তোমার পূর্বপুরুষের ধর্ম তার চেয়ে ভাল।'

আমি বলি, 'না! তাদের ধর্ম আমাদের ধর্মের চেয়ে ভাল।'

আমি কী করবো, তা ভেবে আমার পিতা শঙ্কিত হয়ে পড়েন, তাই তিনি আমার পায়ে শেকল বেঁধে বাড়িতে বন্দী করে রাখেন।

আমি ঐ খ্রিষ্টানদের কাছে খবর পাঠিয়ে জানতে চাই, কখন সিরিয়া থেকে খ্রিষ্টান বণিকদের কাফেলা আসবে। তারা তা আমাকে জানায় এবং আমি তাদেরকে বলি:

'যখন তারা তাদের ব্যবসার কাজ শেষ করে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবে, তখন তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, তারা আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাবে কি না।'

তারা তা-ই করে। আমি আমার পায়ের শেকল ছিঁড়ে তাদের সাথে সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা হই।

সেখানে পৌঁছার পর আমি জানতে চাই, তাদের ধর্মের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিটি কে; তারা তাদের বিশপের [উচ্চপদস্থ খ্রিষ্টীয় যাজক] প্রতি আমাকে নির্দেশ করে। আমি তার কাছে গমন করি ও তাকে বলি যে, তাদের ধর্ম আমার পছন্দ এবং আমি তার সঙ্গে থেকে গির্জায় সাহায্য, ধর্ম শিক্ষা ও প্রার্থনা করতে আগ্রহী। সে আমাকে ভিতরে ঢোকার আমন্ত্রণ করে ও আমি তা-ই করি।

তবে সে ছিল অসৎ প্রকৃতির লোক। সে ভক্তদের হুকুম করতো দান-খয়রাত করতে ও এই কাজে তাদের রাজি করাতো। যখন ভক্তরা তার কাছে টাকা-পয়সা নিয়ে আসতো, তখন সে তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ না করে নিজের ভাণ্ডারে জমা করতো। এভাবে সে সাত ভাণ্ড (jar) ভর্তি সোনা ও রূপা মজুত করে।

এই দৃশ্য অবলোকন করার পর তার প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মে। কিছুদিন পর যখন সে মারা যায় ও খ্রিষ্টানরা তাকে সমাহিত করার জন্য একত্রে জড়ো হয়, আমি তাদেরকে তার অসৎ কর্মের খবর জানাই।

তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চায়, কীভাবে আমি এই খবরগুলো জানতে পেরেছি। আমি তাদেরকে তার অর্থ-ভাণ্ডারের (Treasure) কাছে নিয়ে যাই ও জায়গাটি দেখাই। তারা সেখান থেকে সাত ভাণ্ড সোনা ও রূপা উদ্ধার করে।

সেগুলো প্রত্যক্ষ করা মাত্র তারা বলে,

'খোদার কসম, আমরা এই লোককে কখনো সমাধিস্থ করবো না’; তারা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে ও তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করে। এরপর তারা নতুন বিশপ নিয়োগ করে।

আমি এমন কোনো অ-মুসলিমকে দেখিনি, যে এই লোকটির [নব-নিযুক্ত বিশপ] চেয়ে অধিক ধর্মচারী, তপস্বী, পরকালে ব্রতী ও দৃঢ়-সর্বদা। আমি তাঁর অনুরাগী হয়ে পড়ি। এর আগে আমি কখনো কারও অনুরাগী হইনি।

বহু বছর যাবত আমি তাঁর সাহচর্যে অবস্থান করি, যতদিনে না তাঁর মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়। তাঁর প্রতি আমার কীরূপ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা, তা তার মৃত্যুকালে আমি তাঁকে অবহিত করি ও তাঁর কাছে আমি জানতে চাই, তাঁর এই শেষ অবস্থায় তিনি আমাকে কার উপর আস্থা রাখার পরামর্শ দেবেন ও কী আদেশ মান্য করতে বলবেন।  

তিনি বলেন, 'বৎস, আমি এমন কাউকে জানি না, যে আমার মত। অধিকাংশ লোক তাদের আসল ধর্ম হয় বিকৃত করে অথবা বর্জন করে, ব্যতিক্রম হলো 'মওসিল (Mausil)' এর এক লোক; যে লোকটি আমার মতই বিশ্বাসী, তুমি নিজেকে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করো।'

তাই তার মৃত্যু ও সমাধিকর্ম সম্পন্ন করার পর, আমি নিজেকে মওসিলের বিশপের সাথে জড়িত করি। আমি তাকে বলি, অমুক লোক [আগের বিশপ], তাঁর মৃত্যুকালে আমাকে তার সন্ধান জানিয়েছেন। 

আমি তাঁর সঙ্গে অবস্থান করি ও আবিষ্কার করি যে, তাঁর সম্বন্ধে আমাকে যা যা বলা হয়েছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কিন্তু অচিরেই তাঁর মৃত্যুকাল উপস্থিত হয় ও আগের বিশপের মত তাঁর কাছেও আমি সেই একই প্রশ্ন করি।

তিনি জবাবে বলেন যে, 'নাসবিন (Nasibin)' নামক স্থানে একজন আছে, যে তাঁর মত একই পথ অনুসরণ করে; তিনি আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার সুপারিশ করেন।

(তারপর বিভিন্ন স্থানে একইরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি; একইরূপ বাক্য প্রয়োগ ও বিস্তারিত বর্ণনা, পার্থক্য শুধু স্থানের নাম: মওসিল (Mausil), নাসবিন (Nasibin), আম্মূরিয়া (Ammuriya) ও অবশেষে মুহাম্মদ - তাই অনুবাদকারী তাঁর অনুবাদ সংক্ষিপ্ত করেছেন)

আমি নাসবিনের সেই ভাল লোকটির সাথে কিছুদিন অবস্থান করি। তার মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে আম্মূরিয়ায় তার এক সহকর্মীর কাছে যাওয়ার সুপারিশ করেন।

আমি তার সাথে কিছুদিন অবস্থান করি ও নিজেকে শ্রমসাধ্য কাজে নিয়োজিত করার মাধ্যমে কিছু গবাদিপশু ও ছোট এক পাল ভেড়ার মালিক হই। তারপর যখন তাঁর মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়, তিনি কোন লোকের সুপারিশ করেন কি না, আমি তা জিজ্ঞাসা করি।

তিনি বলেন, এমন কাউকে তিনি চেনেন না, যে তাঁর মতই জীবন অতিবাহিত করে; কিন্তু ইব্রাহিমের ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে শীঘ্রই এক নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তাঁর জন্ম হবে আরবে ও দেশান্তরিত হয়ে (migrate) তিনি যাবেন এমন এক দেশে, যার অবস্থান হবে দুই লাভা বেল্টের মাঝখানে ও যার মাঝখানে থাকবে পাম গাছ (তালজাতীয় বৃক্ষ)। 

যে চিহ্নের সাহায্যে তাঁকে অভ্রান্ত ভাবে চেনা যাবে তা হলো:

১) তাঁকে কোনো কিছু খাবারের জন্য দেয়া হলে তা তিনি ভক্ষণ করবেন; তবে
২) তাঁকে কোনো দানসামগ্রী (Alms) দেয়া হলে তা থেকে তিনি কিছুই নেবেন না; আর
৩) তাঁর দুই স্কন্ধের মাঝখানে থাকবে নবুয়তের সীল। [পর্ব: ৪৬]।

'যদি তুমি সক্ষম হও, তবে সেই দেশে গমন করো।'

(“He told me that he knew of no one who followed his way of life, but that a prophet was about to arise who would be sent with the religion of Abraham; he would come forth in Arabia and would migrate to a country between two lava belts, between which were palms. He has unmistakable marks. He will eat what is given to him but not things given as alms. Between his shoulders is the seal of prophecy.  ‘If you are able to go to that country, do so.’”) 

তার মৃত্যুর পর আল্লাহর যতদিন ইচ্ছা ছিল ততদিন আমি আম্মূরিয়ায় অবস্থান করি। এরপর কালবাইট (Kalbite) গোত্রের বণিকদের একটি দল আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, আমার মালিকানাধীন গবাদি-পশু ও ভেড়ার পালের বিনিময়ে তারা আমাকে তাদের সঙ্গে আরবে নিয়ে যেতে রাজি কি না। [2]

আমার সেই প্রস্তাবে তারা রাজি হয় ও আমি তাদের সঙ্গে আরবের উদ্দেশে যাত্রা করি। কিন্তু ওয়াদি'ল কুরা (Wadi’l Qura) নামক স্থানে পৌঁছার পর তারা আমাকে এক ইহুদির কাছে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়।

আমি অনেকগুলো পাম গাছ দেখি ও আশা করি, হয়তো এইটিই সেই শহর, যার বর্ণনা আমার গুরু (Master) আমাকে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না। 

অতঃপর মদিনার বানু-কুরাইজা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত আমার মনিবের এক জ্ঞাতি ভাই (cousin) আমাকে কিনে নেয় ও মদিনায় নিয়ে আসে। আল্লাহর কসম, এই জায়গাটি দেখামাত্র আমার গুরুর বর্ণনা মতে আমি তা চিনতে পারি।

আমি সেখানেই বসবাস করি, আর আল্লাহ নবী প্রেরিত হন ও বসবাস করেন মক্কায়। কিন্তু আমি তার কোন খবর জানাতাম না, কারণ আমি সম্পূর্ণরূপে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।  অতঃপর তিনি মদিনায় হিজরত করেন।

আমার মনিবের এক পাম গাছের চুড়ায় যখন আমি কাজে নিয়োজিত ছিলাম ও আমার মনিব ঐ গাছের নিচে বসেছিলেন, তখন হঠাৎ মনিবের এক জ্ঞাতিভাই (Cousin) তার কাছ এসে বলে, 

'বানু কেইলার (‘Qayla’) উপর আল্লাহর গজব পড়ুক! তারা এই মুহূর্তে কুবায় ('Quba') এক লোককে ঘিরে সমবেত হয়েছে, লোকটি আজকে মক্কা থেকে এসেছে ও দাবি করছে যে, সে একজন নবী।' [3]

আমি তা শুনতে পেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠি, আমার মনে হয়, আমি মনিবের ওপর পড়ে যাব। আমি পাম গাছ থেকে নিচে নামি ও তার জ্ঞাতিভাই কে বলা শুরু করি,

'কী বললে? কী বললে তুমি?"

আমার মনিব ভীষণ ক্ষেপে ওঠেন ও আমাকে একটা ঘুষি দিয়ে বলেন, 'এর দ্বারা তুই কী বুঝাতে চাস? তুই তোর কাজে যা?'

আমি বলি, 'কিছু মনে করবেন না, আমি শুধু এই খবরের সত্যতা জানতে চাচ্ছিলাম।'

আমার কাছে সামান্য কিছু খাবার ছিল, যা আমি সংরক্ষণ করেছিলাম। সেই সন্ধ্যায় তা নিয়ে আমি আল্লাহর নবীর কাছে গমন করি; তিনি তখন কুবায়। আমি তাঁকে বলি, 'আমি শুনেছি যে আপনি একজন সৎ মানুষ ও আপনার সহচররা অপরিচিত বিদেশী। এখানে কিছু দানসামগ্রী আছে ও আমি মনে করি, এর ওপর আপনার দাবি অন্যদের চেয়ে বেশি।'

তারপর আমি তাকে সেটা দিই। আল্লাহর নবী তাঁর সহচরদের বলেন, 'খাও!', কিন্তু তিনি নিজে তাতে তাঁর হাত লাগালেন না ও তার কিছুই খেলেন না। আমি নিজেকে বলি, 'এটি হলো এক।'

তারপর আমি আল্লাহর নবীর কাছ থেকে চলে আসি ও কিছু খাবার সংগ্রহ করি। অত:পর তা আমি তার কাছে নিয়ে আসি ও বলি, 'আমি দেখেছি যে আপনি দানসামগ্রী খাদ্য থেকে কিছুই খান না; এখানে কিছু খাবার আছে, যা আমি স্বেচ্ছায় আপনাকে দিলাম।' আল্লাহর নবী তা খেলেন ও তাঁর অনুসারীদেরও কিছু দিলেন। আমি মনে মনে বলি, 'এই হলো দুই!' 

তারপর আমি আল্লাহর নবীর কাছে আবার আসি, তখন তিনি ছিলেন ‘বাকি উল-ঘারকাদ('Baqi`u-'l-Gharqad')’; যেখানে তিনি তাঁর এক সহচরের লাশের কফিন বহনকারী লোকদের অনুসরণ করছিলেন। [4]

যখন তিনি তাঁর সহচরদের সাথে বসেছিলেন, আমি তাঁকে সালাম করি ও তাঁর পিছন দিকে এসে তাঁর পিঠের 'সীল' দেখার চেষ্টা করি; যার বর্ণনা আমার গুরু আমাকে দিয়েছিলেন।  

যখন আল্লাহর নবী দেখতে পান যে আমি তার পিঠ দেখার চেষ্টা করছি, তিনি বুঝতে পারেন যে আমি সত্যকে জানার চেষ্টা করছি। তাই তিনি তাঁর চাদরটি ফেলে দেন ও তাঁর পৃষ্ঠদেশ অনাবৃত রেখে শুয়ে পড়েন। তার পিঠের সীলটি দেখে আমি তা চিনতে পারি।

তারপর আমি তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ি, তাঁকে চুম্বন করি ও কাঁদতে থাকি।

আল্লাহর নবী বলেন, 'এখানে এসো।'

আমি তাঁর সামনে এসে বসে পড়ি ও আমার ঘটনাগুলো তাঁকে খুলে বলি; যা আমি তোমাকে শোনাচ্ছি, হে ইবনে আব্বাস।

আল্লাহর নবী চাইতেন যে, আমার জীবনের ঘটনাগুলো তাঁর সহচররা শুনুক।"

তারপর,

মুহাম্মদের পরামর্শে সালমান তার ইহুদি মনিবের সাথে 'মুক্তিপণের'ব্যাপারে এই চুক্তিতে রাজি হন যে, তিনি ৩০০ টি গর্ত খুঁড়ে সেখানে তার মনিবের জন্য ৩০০টি পাম-গাছ লাগিয়ে দেবেন; এবং আরও দেবেন ৪০ ওকিয়া (okes/Uqiyahs) সোনা। মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা সালমানকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। সেই 'মুক্তিপণের' বিণিময়ে সালমান হন দাসত্ব-মুক্ত, এক মুক্ত মানুষ। [5]

দাসত্বের কারণে সালমান বদর ও ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নাই। দাসত্বে মুক্ত হয়ে মুক্ত মানুষ হিসাবে সালমান খন্দক যুদ্ধেই প্রথম অংশ গ্রহণ করেন

- (অনুবাদ, টাইটেল, [**] ও নম্বর যোগ - লেখক)।

>>> A. GUILLAUME অনুদিত মুহাম্মদ ইবনে ইশাক রচিত ও ইবনে হিশাম সম্পাদিত 'সিরাত রাসুল আল্লাহ’ নামক ৬২১ পৃষ্ঠার মুহাম্মদের সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ জীবনীগ্রন্থে (Complete Biography) "নব্য মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের অকথ্য অত্যাচারের উপাখ্যান" লিপিবদ্ধ আছে মাত্র আড়াই পৃষ্ঠা।

অন্যদিকে ঐ একই গ্রন্থে "কী ভাবে সালমান মুসলমান হয়েছিলেন" তার বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে চার পৃষ্ঠা ব্যাপী!

অর্থাৎ,

মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের অকথ্য অত্যাচারের বর্ণনার চেয়ে সালমান ফারসীর মুসলমান হওয়ার বর্ণনা দেড়গুণেরও বেশি!

শুধু তাইই নয়, 'মদিনা সনদ' উপাখ্যানের মতই, মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের অকথ্য অত্যাচারের বর্ণনায় ও মুহাম্মদ ইবনে ইশাক কোন তথ্য-সূত্রের (ইসনাদ) উল্লেখ করেননি। কিন্তু সালমান ফারসীর মুসলমান হওয়ার বর্ণনায় তিনি উদ্ধৃত করেছেন সু-নির্দিষ্ট তথ্য-সূত্র। (পর্ব: ৪৪-৪৫)

তা সত্ত্বেও,

কী কারণে সালমান ফারসীর উপাখ্যানের সাথে সাধারণ মুসলমানদের পরিচিতি “যৎসামান্য”; অথচ নব্য মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের অকথ্য অত্যাচারের উপাখ্যান জগতের প্রায় প্রত্যেকটি ইসলাম বিশ্বাসী ও অনেক অবিশ্বাসীর "অতি পরিচিত” তার বিস্তারিত আলোচনা পর্ব: ৪৩-এ করা হয়েছে।

(চলবে)

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:

[1] “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ:  A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৯৫-৯৮

[2] কালবাইট গোত্র: সম্ভবত, তারা আরবের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বসবাস করতেন।

[3]'বানু কেইলার (‘Qayla’):  জনসাধারণের পরিগণিত ধারণা এই যে, আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা ছিলেন মাতা 'কেইলার' বংশধর’ (পর্ব-৪৬)। 'কেইলা' ছিলেন কাহিল বিন উধরা বিন সা"দ বিন যায়েদ বিন লেইথ বিন সু'দ বিন আসলাম বিন আল-হাফ বিন কুদাহর কন্যা (Ibid: ইবনে ইশাক- পৃষ্ঠা ৭১৩)।

[4] ‘বাকি উল-ঘারকাদ ('Baqi`u-'l-Gharqad')’: মদিনার এক কবরস্থান, যার অবস্থান ছিল শহরের বাহিরে।

[5] ওকিয়া (oke/Uqiyah): একটি সাধারণ মধ্যযুগীয় পণ্য ওজন পরিমাপ। এক ওকিয়া (oke/Uqiyah) = মোটামুটি এক আউন্স।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন