বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫

নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি ও ফস্কা গেরো

লিখেছেন জর্জ মিয়া

ফেসবুক বন্ধ রাখায় মানুষজন খুব  বিরক্ত হয়নি, কথাটা ঠিক। এর কারণ কী, সেটা আমরা সবাই জানি। সাকা আর মুজাহিদের মত পশুদের ফাঁসি কার্যকর করায় শুধু ফেসবুক কেন, সমগ্র ইন্টারনেট গেটওয়ে বন্ধ রাখলেও মানুষ বিরক্ত হতো না। কিন্তু কথা হচ্ছে, ফাঁসির রায় কার্যকর হয়ে গেছে। দুটোকেই হুরের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখনো কেন তবে ফেসবুক বন্ধ? নিউজে পড়লাম, তারানা হালিম বলছেন, যতদিন পর্যন্ত দেশের একজন মানুষও নিরাপদ না, ততদিন ফেসবুক বন্ধ রাখা হবে। দেশের মানুষ অনিরাপদ কী কারণে, সেটা সম্ভবত তাঁর জানা নেই। অবশ্য আশাও করি না যে, তিনি জানবেন। কেননা, যেখানে সেন্টিমেন্ট থিওরি কাজ করে, সেখানে এসব জানার কথা নয়। 

আর এ ব্যাপারে মিডিয়াও এখন নিশ্চুপ। বর্তমানে মিডিয়া জোর ইজতেমা, বিপিএল নিয়ে হেব্বি ব্যস্ত। এরকম অনলাইন মাধ্যম বন্ধ করে কোনো দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, এমন নজির আমি কোথাও দেখিনি। অন্তত কোনো প্রগতিশীল দাবিদার সরকার-মিডিয়া এমন কাণ্ড করেননি। রাজাকারের ফাঁসি নিশ্চিত করতে ফেসবুক, ভাইবারসহ অন্য আরও কিছু সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেয়ার পরে সাধারণ জনতা এটাই ভেবেছিলো; ফাঁসি হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখনই প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের মুখে নিরাপত্তার কথাটা উঠেছে, সেখানে এও পরিষ্কার বলা দরকার ছিলো যে, কারা ফেসবুকের মাধ্যমে নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে? দেশের প্রায় ৯৭% মানুষ মুছলিম। তাদের ধর্ম ইছলাম। এখানের সবাই ইজতেমায় যাবে, লক্ষ-লক্ষ মুছলিম জুম্মাবারে নামাজ পড়বে। পাকিস্তান, (পড়ুন জঙ্গিস্তান), মিয়ানমারসহ বিশ্বের প্রায় সব মুছলিম দেশ থেকে মুছলিমরা আসবে। দেশের মানুষ উর্দুতে বয়ান শুনবে। আল্লা-নবীর গুণগান হবে।

এদিকে খবরে প্রকাশ ‘বাংলাদেশে নেতা পেয়েছে আইএস’ আইএস এর জঙ্গিরা বাংলাদেশে একজন ‘আঞ্চলিক নেতার অধীনে’ নতুন হামলার জন্য সংগঠিত হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে এই দলের মাসিক পত্রিকা ‘দাবিক’-এর সর্বশেষ সংখ্যায়। আর এই আইএস-এর জিহাদিরাই ঢুকে পড়বে দেশে এই মহাপুণ্যের বিশ্ব ইজতেমায়।

ছোটবেলায় আমরা অনেকেই বনভোজন করেছি। ইজতেমা, তাবলীগ - এগুলেকে বনভোজনের সাথে তুলনা করা যায়। আমি জানি না,  নবী মোহাম্মদ কোনোদিন এমন বনভোজন করেছেন কি না। তিনি যেটা করেছেন, সেটা হচ্ছে - হিজরত (পলায়ন), যার সাথে আমি প্যারিসে হামলাকারী ঐ মুছলিমটির বেশ মিল দেখতে পাই। হামলা করে সেও পালাবার ধান্দায় ব্যস্ত। নিরাপত্তার প্রশ্নে এখানে দেখা দরকার ছিলো আসলে, কোন সমস্যার কারণে নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ? কারাই বা এসব করে থাকে? সারা বিশ্বে এখন রক্তের হলি খেলছে কারা? 

ইজতেমা মুলত তাবলিগারদের মিলনমেলা। এখান থেকেই শুরু হয় ১ চিল্লা থেকে ৩ চিল্লা পর্যন্ত। জোর ইজতেমার পরে শুরু হবে ১ম এবং ২য় পর্ব। এই মিলন মেলায় যারা আসে, তারা সবাই এখান থেকে দলে দলে ভাগ হয়ে যায়, যাকে কাফেলা বলা হয়। এই এক-একটা কাফেলা পৃথিবীর নানা দেশের দুর্গম অঞ্চলে গিয়েও ইছলাম প্রচার করার দায়িত্ব পালন করে, যাকে তাবলীগ বলে। 

এই তাবলিগের শিক্ষাটা কী, আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এখানে কয়েকটা ধাপে তালিম (জ্ঞান) দেয়া হয়ে থাকে। যেখানে জিহাদের ব্যাপারটাও উল্লেখযোগ্য। এখানে স্পষ্টভাবেই শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে - যখন দলের লোকবল, অর্থবল, সামর্থ্যবল কম, তখন ইছলামের দাওয়াত এইভাবে দুর্গম অঞ্চল অব্দি পৌছে দাও। আর যখন দলের সামর্থ্য বাড়তে থাকবে, ঝাঁপিয়ে পড়ো অমুছলিমদের ওপরে। কতল করো অবশ্বাসীদেরকে, লুট করে নাও তাদের সম্পদ ও নারীদেরকে। যাকে মালে গণিমত বলা হয়ে থাকে। 

বোঝাই যাচ্ছে তাবলীগ হচ্ছে ইছলামী খেলাফতের মোহাম্মদ ও খোলাফায়ে রাশিদিন পরবর্তী নয়া তরিকা। আওয়ামীলিগের প্রভাবশালী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকি ব্যক্তিগতভাবে তাবলীগবিরোধী মত প্রকাশ করায় তাকে মন্ত্রীত্ব হারাতে হয়েছে। আমরা নবীর জীবনীর দিকে তাকালেই দেখতে পাই, তিনি মক্কায় থাকাকালীন তার ধর্মে অনুসারী কম থাকায় প্রচলিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে নির্যাতিত ও সুবিধাবঞ্চিতদের কিয়দংশ তার মতবাদে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যেসব কথাবার্তা সেই সময়ে বলেছিলেন, সেসবই কোরানে ঠাই পেয়েছে মক্কী সুরা হিসেবে। আবার যখন তার এই শ’খানেক ইছলামী মতের লোক ফুলে-ফেঁপে কয়েকগুন বেড়ে গেল, ঠিক সে সময়েই তিনি হামলা করেন কাবায়। ভেঙে ফেলতে সচেষ্ট হন প্যাগানদের ধর্মীয় দেবতাদের মুর্তি। মালে গনিমত ও নারীসম্পদের লোভে (ইয়াসরিব) মদিনায় অবস্থান করলেন, তখন প্রতিটা যুদ্ধ কেমন হয়েছে, তার বিশদ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মাদানি সুরাগুলোতে। মাদানি সুরাতে আমরা আরও দেখতে পাই দেশের শাসন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা বিধিকে ইছলাম তার সুবিধেমত করে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করেছে। সুস্পষ্ট ভাবে দেখতে পারি, সেখান ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদেরকে কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বা সাজা পেতে হয়েছে। ঘরবাড়ি, সম্পদ ও নারীদের ইছলামী সাহাবীদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হওয়াই অন্য মতের মানুষদের নিয়তি ছিলো। এরপরেও আরও ছিলো ‘যিযিয়া কর’।

লক্ষ্য করলে নবীজির মক্কা এবং মদিনা অবস্থান; তাবলীগ-জামায়াত ও আইএস-এর সাথে নিবিড় মিল সাদা চোখেই ধরা পড়বে। দেশের ইজতেমার পরে বাংলাদেশে যারা থেকে যায়, তারা সবাই এখন ঢাকায় কাকরাইলে অবস্থিত মার্কাস মসজিদে। কোন দল কোথায় যাবে, সেটা এখানে বসে ঠিক করা হয়ে থাকে। এই ইজতেমায় অংশ নেবে আইএস, বোকো হারামসহ প্রায় সব জঙ্গি গোষ্ঠী। ভাগ হয়ে যাবে একাধিক কাফেলায়। উদ্দেশ্য তাদের শুধুই ইছলাম প্রচার করা ও কোরান-হাদিস অনুযায়ী পরবর্তী দিকনির্দেশনা দেয়া। সেখান থেকেই দেশে বসে সারাজীবনে অন্যায় পথে উপার্জন করা অর্থের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছেন এমন কোনো ব্যক্তি এই তাবলীগারদের খেদমতে (সেবায়) অর্থ দান করতে থাকবেন পুণ্যের আশায়, টাকাকে হালাল করার নেশায়। এই অর্থই হবে পরবর্তীতে জিহাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তাদের মুলধন। দেশী-বিদেশী অগণিত এমন দাতা আছে, যারা তাবলিগ জামায়তে দু'হাত ঢেলে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। এখানে চলে মুলত ব্রেইনওয়াশ করার কাজ। কীভাবে একজন সাহাবীর ন্যায় সহি জিহাদি হতে পারে কোনো মুমিন, তার আদ্যোপান্ত দীক্ষা এখান থেকেই দেয়া হয়। এই তাবলীগ জামাতে যারা আসে, তারা যে কোনো ধরনের মুমিনই হতে পারে। তবে বেশির ভাগই আসে মহল্লার ছিঁচকে সন্ত্রাসী, ঘুষখোর সরকারী কর্মকর্তা, ধর্ষক, নেশাসক্ত। এদেরকে প্রথমেই ১ চিল্লায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। এরা প্রথমে ৩ দিন, এরপরে এক সপ্তাহ - এভাবে ধীরে ধীরে দিন বাড়াতে থাকে। যে মসজিদে এই তাবলীগওলারা অবস্থান নেয়, তাদের বিশেষ সেবার নিয়োজিত করা হয় মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে। এই ছাত্রদের মধ্যে যারা ক্বারী কিংবা এমন টাইটেলপ্রাপ্ত, তাদেরকে দেয়া হয় বিদেশী তাবলীগ করতে আসা লোকদের খেদমতের ভার। সেখান থেকেই এই ক্বারী কিংবা মাওলানাকে পাঠানো হয় প্রশিক্ষণ মিশনে। এসব ক্বারী ও মাওলানাদের দেখাদেখি অন্যরাও যোগ দেয়। কার্যক্রমটা এভাবেই এগোয়। 

প্রতিদিন বিকালে ও সকালে নিয়ম করে মানুষদেরকে দাওয়াত দিয়ে আনা হয় মসজিদে। আসলে এটাকে দাওয়াত বলে কীভাবে, আমি জানি না। আপনি যদি যেতে ইচ্ছুক না হন, তবে আপনাকে দেখানো হবে দোযখের, কবরের শাস্তির ভয়। এরপরে যদি যেতে না চান, তাহলে আপনার মুছলিমত্ব নিয়েই এরা টান দেবে। যদি মুছলিম হয়েই থাকেন, তবে কেন আল্লার রাস্তায় সময় দেবেন না? 

আমার একটা অভিজ্ঞতা এখানে বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে, বোধহয়। অফিস থেকে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরছি হেঁটেই। পথিমধ্যে মসজিদের সামনে ৩ জন ব্যক্তি পথ আগলে দাঁড়ালো আমার। কান থেকে হেডফোন খুলতে বলে সালাম দিলো। কতক্ষণ গ্যাঁজাইল। আমার ব্যস্ততার কথা তাদেরকে বললাম। সেই একই কথা তাদের, আল্যার রাস্তায় একটু সময় দিলে তেমন বেশি সমস্যা হবে না। আমি তাদেরকে আমার কোনো এক কলিগ অসুস্থ, এটা জানানোর পরেও তাদের ঐ একই কথা। আল্লা ভালো করে দেবেন। মেজাজ এমন চড়ে গিয়েছিলো, বলার বাইরে! আমি বললাম, "ভাই, এভাবে মানুষকে কেন হয়রানি করছেন? আমি ব্যস্ত আছি, ওখানে যাওয়ার মত সময় আমার হাতে নেই। আমার কলিগ অসুস্থ তাকেও দেখতে যেতে হবে। আপনি বললেন, আল্লা ভালো করে দেবেন। আমার কলিগ খ্রিষ্টান। কোনো খৃষ্টানকে আল্লা ভালো করেছেন, এমন কথা আমি কোথাও শুনিনি। পথ ছাড়েন, যাইতে দেন। ডাঃ ছাড়া আল্লা ওনারে ভালো করতে পারবে না।" এক প্রকার জোর করেই সেদিন আমি চলে এসেছিলাম বাসায়। 

সরকারের নীতি-নির্ধারকদের তাই বলছি, এখনো সময় আছে, ফেসবুক নয়, ইজতেমায় নজর দিন, মাদ্রাসাশিক্ষাকে নিষিদ্ধ করুন। ধর্মকে তোষামোদ করা বাদ দিন। নাহলে শুধু ফেসবুক নয়, সাবমেরিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সমগ্র ইন্টারনেট গেটওয়ে বিকল করে দিলেও দেশের নিরাপত্তাটা দিতে সফল কোনোভাবেই হবেন না। কারণ সমস্যাটা ফেসবুকে নয়, সমস্যাটা সেন্টিমেন্টে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন