লিখেছেন ক্যাটম্যান
মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার ও প্রসারের কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় ও ফয়সল আরেফিন দীপন সহ নিহত ও আহত সকল মুক্তচিন্তকের স্মরণে এই লেখাটি অপরিমেয় ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ নিবেদন করছি।
মূলত এটি ছিল ইস্রায়েলের জনগণের উদ্দেশে মূসার পরিকল্পিত নাটকের সুকৌশলী মঞ্চায়ন। আর এমন নাটকের ফাঁদে পা দিয়ে ইস্রায়েলের জনগণ নিজেদের আনুগত্যসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে নিম্নোক্ত ভাষায়:
কিন্তু আমরা এখন কেন মরব ? সেই মহা আগুন তো আমাদের গ্রাস করবে; আমরা যদি আমাদের পরমেশ্বর প্রভুর কন্ঠ শুনতে থাকি, তবে মারা পড়ব। কেননা মরণশীলদের মধ্যে এমন কে আছে যে, আমাদের মত আগুনের মধ্য থেকে জীবনময় পরমেশ্বরের কন্ঠ কথা বলতে শুনে বেঁচেছে ? তুমিই এগিয়ে গিয়ে আমাদের পরমেশ্বর প্রভু যে সমস্ত কথা বলবেন, তা শোন; আমাদের পরমেশ্বর প্রভু তোমাকে যা কিছু বলবেন, সেই সমস্ত কথা তুমি আমাদের জানাও; আমরা তা শুনব ও পালন করব। [দ্বিতীয় বিবরণ ৫:২৫-২৭]
ইস্রায়েলের বোকা জনগণের ওপরোক্ত অভিব্যক্তিসমূহ জানতে পেরে মূসার পরমেশ্বর খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাদের নিকট থেকে যে-মানের ভীরুতা ও আনুগত্য পরমেশ্বর প্রত্যাশা করেছিলেন, এতদিনে তারা তা প্রদর্শন করায় তিনি তাদের চিরস্থায়ী মঙ্গল কামনা করে বলেন:
তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রভু তোমাদের এই কথা শুনলেন, তখন প্রভু আমাকে বললেন, এই জনগণ তোমাকে যা কিছু বলেছে, তাদের সেই সমস্ত কথা আমি শুনলাম; ওরা যা বলেছে তা ঠিক। ওদের ও ওদের সন্তানদের যেন চিরস্থায়ী মঙ্গল হয়, আহা আমাকে ভয় করতে ও আমার আজ্ঞাগুলি পালন করতে যদি ওদের তেমন মন সবসময়ই থাকত ! তুমি যাও, ওদের বল, নিজ নিজ তাবুঁতে ফিরে যাও; কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এখানে থাক, তুমি ওদের যা কিছু শিক্ষা দেবে, আমি তোমাকে সেই সমস্ত আজ্ঞা, বিধি ও নিয়মনীতি বলে দেব, আমি যে দেশ ওদের অধিকারে দিতে যাচ্ছি, সেই দেশে ওরা যেন তা পালন করে। [দ্বিতীয় বিবরণ ৫:২৮-৩১]
বস্তুত এটি ছিল কল্পিত পরমেশ্বরের ভূমিকায় মূসার সুচারু অভিনয়। কারণ মূসা প্রথম থেকেই স্বীয় পরিকল্পনার অনুকূলে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। তাই নিজের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে মূসা যে সংলাপ ঝেড়েছেন, তার অন্তর্নিহিত সুরের সাথে মূসার পরমেশ্বর প্রদত্ত সংলাপের অন্তর্নিহিত সুর হুবহু মিলে যায়। তাই মূসা যে নিজেই নিজের পরিকল্পিত পরমেশ্বরের পক্ষে ওকালতি ও তার হয়ে অভিনয় করেছেন, এ বিষয়ে আমাদের আর কোনো সন্দেহ অবশিষ্ট থাকে না। এক্ষেত্রে মূসার সংলাপ নিম্নরূপ:
প্রভু পর্বতে আগুনের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে কথা বললেন। সেসময় আমিই প্রভুর বাণী তোমাদের জানিয়ে দেবার জন্য প্রভুর ও তোমাদের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম, যেহেতু আগুনের সামনে ভয় পেয়ে তোমরা পর্বতে ওঠনি। [দ্বিতীয় বিবরণ ৫:৪]
এক্ষেত্রে ঐশ্বরিক আগুন ও ভীতি একাকার হয়ে ইস্রায়েলের জনগণের মাঝে এক জটিল আবহ সৃষ্টি করেছে। আর সৃষ্ট সেই আবহের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মূসা ইস্রায়েলের জনগণের উদ্দেশে পরমেশ্বরের নামে নাটকীয়ভাবে দশটি আজ্ঞা প্রসব করেন, যা ইস্রায়েলের জনগণের সাথে মূসার কল্পিত পরমেশ্বরের সন্ধি স্থাপনের ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। আজ্ঞাসমূহ নিম্নরূপ:
প্রথম আজ্ঞা: “তখন পরমেশ্বর এই সমস্ত কথা বললেন, 'আমি তোমার পরমেশ্বর প্রভু, যিনি মিশর দেশ থেকে, দাসত্ব-অবস্থা থেকে তোমাকে বের করে এনেছেন: আমার প্রতিপক্ষ কোন দেবতা যেন তোমার না থাকে! [যাত্রাপুস্তক ২০:১-৩]
বাইবেলের প্রথম আজ্ঞায় বর্ণিত ১-২ নম্বর শ্লোকের সাথে মিল রেখে মুহম্মদি কুরআনেও বলা হয়েছে: “আর (আল্লাহ বলেন) সেই সময়ের কথা স্মরণ করো যখন আমি ফেরাউনের লোকদের কবল থেকে তোমাদের মুক্তি দিয়েছিলাম। [সূরা আরাফ: ১৪ ]
দ্বিতীয় আজ্ঞা: “তুমি তোমার জন্য খোদাই করা কোন প্রতিমূর্তি তৈরি করবে না; উপরে সেই আকাশে, নিচে এই পৃথিবীতে ও পৃথিবীর নিচে জলরাশির মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তার সাদৃশ্যেও কোন কিছুই তৈরি করবে না। তুমি তেমন বস্তুগুলির উদ্দেশে প্রণিপাত করবে না, সেগুলির সেবাও করবে না; কেননা আমি, তোমার পরমেশ্বর প্রভু যিনি, আমি এমন ঈশ্বর, যিনি কোন প্রতিপক্ষকে সহ্য করেন না; যারা আমাকে ঘৃণা করে, তাদের বেলায় আমি পিতার শঠতার দন্ড সন্তানদের উপরে ডেকে আনি— তাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত; কিন্তু যারা আমাকে ভালবাসে ও আমার আজ্ঞাগুলি পালন করে, আমি সহস্র পুরুষ পর্যন্তই তাদের প্রতি কৃপা দেখাই। [যাত্রাপুস্তক ২০:৪-৬]
তৃতীয় আজ্ঞা: “তোমার পরমেশ্বর প্রভুর নাম তুমি অযথা নেবে না, কারণ যে কেউ তাঁর নাম অযথা নেয়, প্রভু তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন না। [যাত্রাপুস্তক ২০:৭]
চতুর্থ আজ্ঞা: “সাব্বাৎ দিনের কথা এমনভাবে স্মরণ করবে, যেন তার পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখ। পরিশ্রম করার জন্য ও তোমার যাবতীয় কাজ করার জন্য তোমার ছ’দিন আছে; কিন্তু সপ্তম দিনটি তোমার পরমেশ্বর প্রভুর উদ্দেশ্যে সাব্বাৎ: সেদিন তুমি কোন কাজ করবে না— তুমিও নয়, তোমার ছেলেমেয়েও নয়, তোমার দাস-দাসীও নয়, তোমার পশুও নয়, তোমার সঙ্গে বাস করে এমন প্রবাসী মানুষও নয়; কেননা প্রভু ছ’দিনে আকাশ, পৃথিবী ও সমুদ্র এবং সেগুলির মধ্যে যা কিছু আছে, সমস্তই নির্মান করেছেন, কিন্তু সপ্তম দিনে বিশ্রাম করেছেন; এজন্য প্রভু সাব্বাৎকে আশীর্বাদ করেছেন ও পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। [যাত্রাপুস্তক ২০:৮-১১]
বাইবেলের চতুর্থ আজ্ঞার প্রতি মুহম্মদি কুরআনেও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইহুদিদের সাব্বাৎ দিন বা ইহুদি রীতিতে শনিবার পালনের প্রতি আরবের পৌত্তলিক বংশোদ্ভুত হাইব্রিড আল্লাহও বিশেষ প্রীতিভাজন। তাই মুহম্মদি কুরআনের অন্তত পাঁচটি আয়াতে সাব্বাৎ দিনের প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন:
১ম আয়াত: “তোমাদের মধ্যে যাহারা শনিবার সম্পর্কে সীমালংঘন করিয়াছিল তাহােদরকে তোমরা নিশ্চিতভাবে জান। আমি তাহাদের বলিয়াছিলাম, ‘ তোমরা ঘৃণিত বানর হও।’ [সূরা আল বাকারা: ৬৫]
২য় আয়াত: “ওহে! যাহাদেরকে কিতাব দেওয়া হইয়াছে, তোমাদের নিকট যাহা আছে তাহার প্রত্যায়নকারীরূপে আমি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি তাহাতে তোমরা ঈমান আন, আমি মুখমন্ডলসমূহ বিকৃত করিয়া অতঃপর সেইগুলিকে পিছনের দিকে ফিরাইয়া দেওয়ার পূর্বে অথবা আসহাবুস সাব্তকে যেরূপ লা’নত করিয়াছিলাম সেইরূপ তাহাদেরকে লা’নত করিবার পূর্বে। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হইয়াই থাকে। [সূরা নিসা: ৪৭]
৩য় আয়াত: “তাহাদের অঙ্গীকারের জন্য তূর পর্বতকে আমি তাহাদের ঊর্ধ্বে উত্তোলন করিয়াছিলাম এবং তাহাদেরকে বলিয়াছিলাম, ‘ নতশিরে দ্বার দিয়া প্রবেশ কর।’ তাহাদেরকে আরও বলিয়াছিলাম ‘শনিবার সম্পর্কে’ সীমালংঘন করিও না এবং তাহাদের নিকট হইতে দৃঢ় অঙ্গীকার লইয়াছিলাম। [সূরা নিসা: ১৫৪]
৪র্থ আয়াত: “তাহাদেরকে সমুদ্রতীরবর্তী জনপদবাসীদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা কর, তাহারা শনিবারের সীমালংঘন করিত। শনিবার উদযাপনের দিন মাছ পানিতে ভাসিয়া তাহাদের নিকট আসিত। কিন্তু যেদিন তাহারা শনিবার উদযাপন করিত না সেদিন উহারা তাহাদের নিকট আসিত না। এইভাবে আমি তাহাদেরকে পরীক্ষা করিয়াছিলাম, যেহেতু তাহারা সত্য ত্যাগ করিত। [সূরা আল আরাফ: ১৬৩]
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন