লিখেছেন গোলাপ
(আগের পর্বগুলোর সূচী: এখানে)
"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"
উসমান ইবনে আফফানের কাছ থেকে স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মক্কা আগমনের উদ্দেশ্য জানার পর কুরাইশরা শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদের কাছে কোন তিনজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন ও তাদেরকে তাঁরা কী নির্দেশ দিয়েছিলেন; এই প্রতিনিধি দলের প্রধান সুহায়েল বিন আমর-কে দেখার পর মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে কী মন্তব্য করেছিলেন; সুহায়েল এর সঙ্গে মুহাম্মদ পরিবারের সম্পর্ক কী ছিল; চুক্তিপত্র লেখার সময় কী কারণে সুহায়েল আল্লাহ নামর সঙ্গে 'যিনি করুণাময় ও অতি দয়ালু’ ও মুহাম্মদ নামের সঙ্গে 'আল্লাহর নবী' শব্দটি যুক্ত করতে রাজি ছিলেন না - ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
মুহাম্মদ ও সুহায়েল তাঁদের শান্তি চুক্তি আলোচনা অব্যাহত রাখেন ও মুহাম্মদের নির্দেশে আলী ইবনে আবু তালিব তা লিপিবদ্ধ করতে থাকেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনার পুনরারম্ভ: [1] [2] [3]
পূর্ব প্রকাশিতের (পর্ব: ১১৮) পর:
‘আল্লাহর নবী বলেন, “লিখো, ‘এটি এই যা মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ একমত হয়েছে সুহায়েল বিন আমর এর সাথে: তারা এই মর্মে রাজি হয়েছে যে, তারা আগামী দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ রাখবে যাতে জনগণ সহিংসতা পরিহার করে নিরাপদে থাকতে পারে এই শর্তে যে, যদি কোনো ব্যক্তি তার অভিভাবকদের অনুমতি ব্যতিরেকে মুহাম্মদের কাছে আসে, তবে তিনি তাকে তাঁদের কাছে ফেরত দেবেন;কিন্তু মুহাম্মদের পক্ষের কোনো ব্যক্তি যদি কুরাইশদের কাছে আসে, তবে কুরাইশরা তাকে তাঁর কাছে ফেরত দেবেন না। আমরা একে অপরের প্রতি শত্রুতা (enmity) প্রদর্শন করবো না ও কোনোরূপ গোপন অভিসন্ধি বাপ্রতারণার আশ্রয় নেবো না। যে কোনো ব্যক্তি যদি মুহাম্মদের সঙ্গে সংযুক্ত ও চুক্তিবদ্ধ হতে ইচ্ছা করে, তবে সে তা করতে পারবে এবং যে কোনো ব্যক্তি যদি কুরাইশদের সঙ্গে সংযুক্ত ও চুক্তিবদ্ধ হতে ইচ্ছা করে, তবে সে তা করতে পারবে।’”
বানু খোজা গোত্র তৎক্ষণাৎ সেখানে ঘোষণা করে যে, “আমরা মুহাম্মদের সঙ্গে সংযুক্ত হলাম” এবং বানু বকর গোত্র তৎক্ষণাৎ একই ভাবে কুরাইশদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয়, আর যুক্ত করে: “তোমরা এই বছর অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করবে ও আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মক্কা প্রবেশ করবে না, আর পরের বছরআমরা তোমার আসার পথ পরিষ্কার রাখবো, তুমি তোমার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে পারবে ও সেখানে তিন রাত্রি পর্যন্ত অবস্থান করতে পারবে। তোমরা আরোহীদের মত অস্ত্র সঙ্গে আনতে পারবে, যেমন খাপের ভেতরে তলোয়ার। তোমরা এর চেয়ে বেশি কিছুই সঙ্গে আনতে পারবে না।”
আল্লাহর নবী ও সুহায়েল যখন এই চুক্তিপত্রটি লিখছিলেন, হঠাৎ সেখানে বেড়ি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আবু জানদাল বিন সুহায়েল এসে হাজির হয়, সে আল্লাহর নবীর কাছে পালিয়ে এসেছিল।’
(অনুবাদ ও টাইটেল - লেখক।)
ইমাম বুখারী (৮১০-৮৭০ সাল) ও ইমাম মুসলিম (৮২১-৮৭৫ সাল) এর বর্ণনা:
Ø এই প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (৫:৫৯:৫৫৩, ৩:৫০:৮৯১) ও ইমাম মুসলিমের (১৯:৪৪০৪) বর্ণনা মুহাম্মদ ইবনে ইশাক, আল-তাবারী ও আল-ওয়াকিদির (৭৪৮-৮২২) ওপরে বর্ণিত বর্ণনারই অনুরূপ। [4] [5]
>>> আদি উৎসের ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ও সুহায়েল বিন আমর যখন চুক্তির শর্তাবলী নিয়েআলাপ-আলোচনা করছিলেন ও আলী ইবনে আবু-তালিব সেই শর্তাবলী লিপিবদ্ধ করছিলেন, সেই অবস্থায় আবু জানদাল বিন সুহায়েল নামের এক মক্কাবাসী মুসলমান পায়ে শিকল পরিহিত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁদের কাছে এসে হাজির হয়। অতঃপর আবু জানদাল মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের কাছে এই মর্মে সাহায্যের অনুরোধ করেন যে, তাকে যেন পৌত্তলিক মুশরিক (polytheist) কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। মুহাম্মদ তা করতে রাজি হন, কিন্তু সুহায়েল বিন আমরের হস্তক্ষেপে মুহাম্মদ তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না (বিস্তারিত পরের পর্বে)।
ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা গত ১৪০০ বছর যাবত আবু জানদাল-এর এই উপাখ্যানটিকে হুদাইবিয়া সন্ধির প্রতি মুহাম্মদ যে কী পরিমাণ বিশ্বস্ত ছিলেন, তার এক অনন্য উদাহরণ হিসাবে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে 'বয়ান' করে আসছেন! এই উদাহরণের মাধ্যমে তাঁরা যে-বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তা হলো এই রকম:
"আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) 'হুদাইবিয়া সন্ধির' প্রতিটি শর্তের প্রতি এতই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, চুক্তি স্বাক্ষরের আগেইকুরাইশদের কাছে প্রতিশ্রুত “যদি কোনো ব্যক্তি তার অভিভাবকদের অনুমতি ব্যতিরেকে মুহাম্মদের কাছে আসে, তবে তিনি তাকে তাঁদের কাছে ফেরত দেবেন--” শর্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবু-জানদালকে কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন! তিনি তাঁর ওয়াদা পালনে এতই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, মক্কার কাফেররা পর্যন্ত হুজুরে পাক মুহাম্মদ (সাঃ) কে 'আল-আমিন' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন (বিস্তারিত: 'এ সেই কিতাব যাতে কোনোই সন্দেহ নেই!' [পর্ব: ১৮])। সুবহান আল্লাহ! সুবহান আল্লাহ!"
ইসলামের যাবতীয় ইতিহাস একপেশে (বিস্তারিত: ‘সিরাত রাসুল আল্লাহ’ [পর্ব-৪৪])।তার ওপর আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত শত সহস্র ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতদের সুবিধাজনক উদ্ধৃতি, বয়ান-বিবৃতি, তথ্য-বিকৃতি ও মিথ্যাচার (বিস্তারিত: "সিরাত এর ‘অ্যানাটমি’ [পর্ব-৪৫])।এই সব ইতিহাস থেকে সত্যকে খুঁজে বের করা অত্যন্ত দুরূহ ও গবেষণাধর্মী কার্যক্রম। আর তা খুঁজে বের করার পর তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত আরও বেশি বিপদজনক! পদে পদে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন (persecution) ও যে কোনো মুহূর্তে "সহি ইসলাম" বিশ্বাসী সৈনিকদের হাতে মৃত্যুঝুঁকির বাস্তবতা! ইন্টারনেট প্রযুক্তির আবিষ্কার ও প্রসার না হলে ইসলামের ইতিহাসের এ সকল গভীর অন্ধকার ইতিহাসের বিস্তারিত স্পষ্ট আলোচনা ও প্রকাশ সম্ভব ছিল না।
ইসলামের ইতিহাসে 'হুদাইবিয়া সন্ধি' এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; আর এই অধ্যায়ের স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে হুদাইবিয়া সন্ধি-পূর্ববর্তী মুহাম্মদের নবী জীবনের কর্মকাণ্ড, (বিস্তারিত: 'হুদাইবিয়া সন্ধি: প্রেক্ষাপট' [পর্ব-১১১]), এই সন্ধির সময় ও সন্ধি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের গভীর ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক। 'আবু জানদাল বিন আমর' উপাখ্যানের ফাঁকটি কোথায় ও ইসলাম-বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা (অধিকাংশই না জেনে) কীভাবে তা সুবিধাজনক (Selective) উদ্ধৃতি, বয়ান-বিবৃতি, তথ্য-বিকৃতি ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাধারণ মুসলমান ও অমুসলমানদের বিভ্রান্ত করেন, তার বিস্তারিত আলোচনা আগামী পর্বে করা হবে। The Devil is in the Detail (পর্ব-১১৩)!
(চলবে)
[1]“সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৫০৪-৫০৫
[2] “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৮, ইংরেজী অনুবাদ: Michael Fishbein, University of California, Los Angeles, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-7914-3150—9 (pbk), পৃষ্ঠা (Leiden) ১৫৪৬-১৫৪৮
ইংরেজি অনুবাদ: Rizwi Faizer, Amal Ismail and Abdul Kader Tayob; ISBN: 978-0-415-86485-5 (pbk); পৃষ্ঠা ৩০১
[4] অনুরূপ বর্ণনা- সহি বুখারী: ভলিউম ৫, বই ৫৯, নম্বর ৫৫৩
বড় হাদিস, এই পর্বের প্রাসঙ্গিক অংশ:
‘Narrated By Al-Bara : When the Prophet went out for the 'Umra in the month of Dhal-Qa'da, the people of Mecca did not allow him to enter Mecca till he agreed to conclude a peace treaty with them by virtue of which he would stay in Mecca for three days only (in the following year). When the agreement was being written, the Muslims wrote: "This is the peace treaty, which Muhammad, Apostle of Allah has concluded."
The infidels said (to the Prophet), "We do not agree with you on this, for if we knew that you are Apostle of Allah we would not have prevented you for anything (i.e. entering Mecca, etc.), but you are Muhammad, the son of 'Abdullah." Then he said to 'Ali, "Erase (the name of) 'Apostle of Allah'." 'Ali said, "No, by Allah, I will never erase you (i.e. your name)." Then Allah's Apostle took the writing sheet... and he did not know a better writing... and he wrote or got it the following written! "This is the peace treaty which Muhammad, the son of 'Abdullah, has concluded: "Muhammad should not bring arms into Mecca except sheathed swords, and should not take with him any person of the people of Mecca even if such a person wanted to follow him, and if any of his companions wants to stay in Mecca, he should not forbid him. -------"
সহি বুখারী: ভলিউম ৩, বই ৫০, নম্বর ৮৯১
অনেক বড় হাদিস, এই পর্বের প্রাসঙ্গিক অংশ:
‘---- Then Suhail said, "We also stipulate that you should return to us whoever comes to you from us, even if he embraced your religion."The Muslims said, "Glorified be Allah! How will such a person be returned to the pagans after he has become a Muslim? While they were in this state Abu- Jandal bin Suhailbin 'Amr came from the valley of Mecca staggering with his fetters and fell down amongst the Muslims. Suhail said, "O Muhammad! This is the very first term with which we make peace with you, i.e. you shall return Abu Jandal to me." The Prophet said, "The peace treaty has not been written yet." Suhail said, "I will never allow you to keep him." The Prophet said, "Yes, do." He said, "I won't do.: Mikraz said, "We allow you (to keep him)." Abu Jandal said, "O Muslims! Will I be returned to the pagans though I have come as a Muslim? Don't you see how much I have suffered?"Abu Jandal had been tortured severely for the Cause of Allah.’----
[5] সহি মুসলিম: বই নম্বর ১৯, হাদিস নম্বর ৪৪০৪:
এই পর্বের প্রাসঙ্গিক অংশ:‘--So the Holy Prophet (may peace be upon him) said: Write" From Muhammad b. 'Abdullah." They laid the condition on the Prophet (may peace be upon him) that anyone who joined them from the Muslims, the Meccans would not return him, and anyone who joined you (the Muslims) from them, you would send him back to them. The Companions said: Messenger of Allah, should we write this? He said: Yes. One who goes away from us to join them-may Allah keep him away! and one who comes to join us from them (and is sent back) Allah will provide him relief and a way of escape.’