লিখেছেন ক্যাটম্যান
মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার ও প্রসারের কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় ও ফয়সল আরেফিন দীপন সহ নিহত ও আহত সকল মুক্তচিন্তকের স্মরণে এই লেখাটি অপরিমেয় ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ নিবেদন করছি।
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪
মূসা তার পরিকল্পিত পরমেশ্বরকে প্রদর্শনের লক্ষ্যে প্রথমবার যে-নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন, তখন তিনি তার সমস্ত জনগণকে শিবির থেকে নিয়ে গিয়ে সিনাই পর্বতের পাদদেশে দাঁড় করিয়ে সুউচ্চ পর্বতচূড়ায় আগুন ও ধোঁয়ার বিস্তার দেখিয়ে ছিলেন। সেদিন প্রকৃতপক্ষে কোনও ঈশ্বরের উপস্থিতি না থাকলেও পর্বতচূড়ার সেই আগুন ও ধোঁয়াকেই মূসা তার জনগণের নিকট স্বীয় পরমেশ্বরের উপস্থিতিসূচক চিহ্ন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ বিষয়ে বাইবেলে বলা হয়েছে:
মোশী লোক সকলকে শিবিরের মধ্য থেকে পরমেশ্বরের দিকে নিয়ে গেলেন, আর তারা পর্বতের পাদদেশে দাঁড়িয়ে রইল। সিনাই পর্বত সম্পূর্ণই ধূমময় ছিল, কেননা প্রভু তার উপরে আগুনের মধ্যেই নেমে এসেছিলেন, আর তার ধূম অগ্নিকুণ্ডের ধূমের মত ঊর্ধ্বে উঠছিল আর সমস্ত পর্বত প্রচণ্ড ভাবে কাঁপছিল। [যাত্রাপুস্তক ১৯:১৭-১৮]
উক্ত বর্ণনানুযায়ী ইস্রায়েলের জনগণ মূসার পরমেশ্বরের পরিবর্তে আগুন ও ধোঁয়া ছাড়া যে কিছুই দেখেননি, তা স্পষ্ট। সিনাই পর্বতচূড়ায় অবস্থিত ঝোপঝাড়ে কৃত্রিমভাবে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আগুন ও ধোঁয়া পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবে অগ্নিময় ঈশ্বর-প্রদর্শনের লক্ষ্যে আগুনে-মঞ্চসজ্জার প্রয়োজনে মূসা হাতে রেখেছিলেন দু'দিনের অতিরিক্ত সময়; যে সময়ে তিনি প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেছিলেন, যেন নির্ধারিত তৃতীয় দিনে ঈশ্বর প্রদর্শনের বিশেষ সময়ে সিনাই পর্বতচূড়ার বিস্তৃত অংশজুড়ে ব্যাপকভাবে আগুনের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন। এ বিষয়ে বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে:
প্রভু মোশীকে বললেন, ‘লোকদের কাছে যাও, আজ ও আগামীকাল তারা নিজেদের পবিত্রিত করুক, নিজ নিজ পোশাক ধুয়ে নিক আর তৃতীয় দিনের জন্য সকলে প্রস্তুত হোক; কেননা তৃতীয় দিনে প্রভু সকল লোকের দৃষ্টিগোচরে সিনাই পর্বতের উপরে নেমে আসবেন। [যাত্রাপুস্তক ১৯:১০-১১]
তাছাড়া সেই অগ্নিময় ঈশ্বর প্রদর্শনের সময় ইস্রায়েলের জনগণ পরমেশ্বরের অবস্থানস্থল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেখানে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরকে দেখার কোনও সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ে বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে:
গোটা জনগণ সেই বজ্রনাদ, বিদ্যুৎ-ঝলক, তুরিধ্বনি ও ধূমময় পর্বত দেখতে পাচ্ছিল। তা দেখে জনগণ সন্ত্রাসিত হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। [যাত্রাপুস্তক ২০:১৮]
একই পুস্তকের একই অধ্যায়ে পুনরায় ব্যক্ত হয়েছে:
তাই জনগণ দূরে দাঁড়িয়ে রইল, আর ইতিমধ্যে মোশী সেই ঘোর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেলেন যেখানে স্বয়ং পরমেশ্বর ছিলেন। [যাত্রাপুস্তক ২০:২১]
উক্ত বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, ইস্রায়েলের জনগণ পরমেশ্বরের অবস্থানস্থল থেকে শুধু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তা-ই নয়, একইসাথে পরমেশ্বরের অবস্থানস্থল ছিল ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন; যে-অন্ধকারের দিকে মূসা এগিয়ে গিয়েছিলেন। বিধায় সেদিন সিনাই পর্বতচূড়ায় আগুন ও ধোঁয়ার মাঝে যেমন প্রকৃতপক্ষে কোনও পরমেশ্বরের উপস্থিতি ছিল না, তেমনি পরমেশ্বরের কথিত অবস্থানস্থল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ইস্রায়েলের জনগণ সিনাই পর্বতের ঘোর অন্ধকারের মাঝে অন্ধকার ছাড়া কোনও পরমেশ্বরকে দেখেননি। এভাবে মূসার পরমেশ্বরকে দেখতে না পেয়ে ইস্রায়েলের জনগণ যেমন হতাশ হয়েছিল, তেমনি পরিকল্পিত পরমেশ্বরকে প্রদর্শনের লক্ষ্যে মূসার গৃহীত প্রাথমিক প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তবে প্রথমবারের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও মূসা পুনরায় ঈশ্বর প্রদর্শনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার এই উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে মূসা পূর্বের তুলনায় কিছুটা কৌশলী হন। ঈশ্বর প্রদর্শনের এই দ্বিতীয় আয়োজনে মূসা পূর্বের ন্যায় ইস্রায়েলের সমস্ত জনগণকে পর্বতের পাদদেশে হাজির না করে ইস্রায়েলের প্রবীণবর্গের মধ্য থেকে শুধুমাত্র সত্তর জন প্রবীণ ব্যক্তিকে হাজির করেন, যাঁরা ছিলেন উঁচু পর্বতে আরোহণের অনুপযুক্ত এবং ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন, যেন পূর্বেকার ন্যায় ঈশ্বর প্রদর্শন নাটক মঞ্চস্থকালে কোনোরকম ত্রুটি ইস্রায়েলের জনগণের গোচরীভূত না হয়। কিন্তু মূসার দ্বিতীয় উদ্যোগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ ইস্রায়েলের সত্তরজন প্রবীণ মূসার ঈশ্বরকে দেখতে গিয়ে তাদের ক্ষীণ দৃষ্টিতে ঈশ্বরের পরিবর্তে শুধু শুভ্র আকাশ দেখতে পান। আর পুনরায় ঈশ্বর দর্শনে ব্যর্থ হয়ে ও সেইসাথে মূসার দীর্ঘ অনুপস্থিতি দৃষ্টে ইস্রায়েলের জনগণ চরম হতাশায় নিপতিত হন। যার প্রেক্ষিতে তারা মূসা ও মূসার পরমেশ্বরের প্রতি আস্থা হারিয়ে বিকল্প দেবতা হিসাবে একটি বাছুরের মূর্তি নির্মাণ করেন; যার বর্ণনা ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে।
আর উক্ত ঘটনা প্রমাণ করে, ইস্রায়েলের জনগণ মূসার পরিকল্পিত পরমেশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। যার প্রেক্ষিতে মূসা তার গৃহীত ঐশী পরিকল্পনা নতুন করে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হন। এতদিন তিনি ইস্রায়েলের জনগণের নিকট পরিকল্পিত এক ঈশ্বরের মূর্তরূপ সুকৌশলে প্রদর্শনের প্রয়াস চালিয়েছেন, যদিও তিনি তা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ যে-ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই, সেই ঈশ্বরের কোনও উপস্থিতিও নিশ্চিত করা সম্ভবপর নয়। বিধায় তেমন পরিকল্পিত ঈশ্বরের অনুপস্থিতি আড়াল করতে মূসাকে বাধ্য হয়ে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করতে হত। আর তা করতে গিয়ে তাকে বিশ্বস্ত অনুচরবৃন্দের সহায়তায় যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে সুউচ্চ পর্বতে আরোহণ করতে হত। পরিকল্পিত ঈশ্বরের ভূমিকায় ধর্মীয় বিধি অতি গোপনে প্রণয়ন করার লক্ষ্যে নিজ জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘকালব্যাপী পর্বতচূড়ায় অবস্থান করতে হত। ঈশ্বরের চরম ভীতিপ্রদ মহিমার গুণকীর্তন করে নিজ জনগণের মাঝে ঈশ্বরভীতি সঞ্চার করতে হত। এত এত কৌশল অবলম্বন করা সত্ত্বেও ইস্রায়েলের জনগণ মূসার পরিকল্পিত পরমেশ্বরের প্রতি পুরোপুরি আস্থা পোষণে সক্ষম হননি। কারণ মূসার পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষরূপে দেখতে না পারার সেই পুরোনো সমস্যা।
(চলবে)
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন