লিখেছেন ক্যাটম্যান
মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার ও প্রসারের কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ফয়সল আরেফিন দীপন ও নাজিমুদ্দিন সামাদ সহ নিহত ও আহত সকল মুক্তচিন্তকের স্মরণে এই লেখাটি অপরিমেয় ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ নিবেদন করছি।
এবারে আসি সূরা আন্‘আমের ১০৩ নম্বর আয়াতের ‘দৃষ্টি’ বিষয়ক পর্যালোচনায়। উক্ত আয়াতে মুহম্মদ তার আত্মীকৃত ঈশ্বর ‘আল্লাহকে’ প্রত্যক্ষদর্শনের অসম্ভাব্যতা জ্ঞাপন করেছেন। আমরা জানি, কোনও কিছু দর্শন করার প্রধান মাধ্যম হলো চোখ। তবে শুধু চোখের উপস্থিতি দর্শনের শর্ত যথাযথভাবে পূরণ করে না। দর্শনের শর্ত পূরণের জন্য চোখে দৃষ্টিশক্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই যথাযথ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন চোখের পক্ষেই কোনও দর্শনীয় বিষয়বস্তু যথাযথভাবে দর্শন করা সম্ভব। অথচ আল-কুরআনের উক্ত আয়াত অনুযায়ী, চোখ তো কোন ছার, যথাযথ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন কোনও মানুষ অথবা প্রাণীই আল্লাহকে দর্শন করতে পারে না। কারণ আল্লাহর অস্তিত্ব সমস্ত দৃষ্টির অগোচরে অবস্থিত বিধায় দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন কোনও মানুষ অথবা প্রাণীর পক্ষে তাকে প্রত্যক্ষদর্শন করা দূরে থাক, তাকে কল্পনা বা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করাও সম্ভবপর নয়। উক্ত আয়াতের অনুবাদে আল-কুরআনের অধিকাংশ অনুবাদকগণ ‘দৃষ্টি’ বা ‘দৃষ্টিশক্তি’ শব্দ প্রয়োগ করেছেন। যদিও কিছু অনুবাদে ‘দৃষ্টি’ বা ‘দৃষ্টিশক্তি’ শব্দের পরিবর্তে ‘চোখ’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন— “চোখ তাঁকে দেখতে পারে না, কিন্তু তিনি সব চোখ দেখতে পান।” এ বিষয়ে মৌলভি শের আলী’র ইংরেজি অনুবাদটি নিম্নরূপ:
"Eyes cannot reach Him but He reaches the eyes. And He is the Incomprehensible, the All-Aware."
তবে ‘চোখ’ শব্দের তুলনায় ‘দৃষ্টি’ শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক হওয়ায় আল-কুরআনের সুবিধাবাদী অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারগণ উক্ত আয়াত অনুবাদ ও ব্যাখ্যার প্রশ্নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘চোখ’ শব্দের পরিবর্তে ‘দৃষ্টি’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। তাই তাদের ব্যাখ্যানুযায়ী মুহম্মদের আল্লাহকে চোখ দিয়ে দেখা দূরে থাক, দৃষ্টি অথবা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার ক্ষমতাও কারও নেই। অথচ সেই দর্শনাতীত আল্লাহকে দর্শনীয় আল্লাহয় রূপান্তর করতে পূর্বোক্ত আয়াতের বিপরীতার্থক আয়াত মুহম্মদ তার প্রণীত আল-কুরআনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:
সেদিন কোন কোন মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হইবে, তাহারা তাহাদের প্রতিপালকের দিকে তাকাইয়া থাকিবে। [সূরা কিয়ামাহ: ২২-২৩]”
উক্ত আয়াতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুমিন বান্দাগণ পরকালে আল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকবে। এখানে তাকিয়ে থাকা বলতে চোখের সাহায্যে দেখার প্রক্রিয়াকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মুুমিন বান্দাগণ স্বীয় চক্ষু দ্বারা আল্লাহকে দর্শন করবে এমন প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে কোনো পাপীবান্দা পরকালে আল্লাহকে দর্শন করতে পারবে না, এমন কথাও আল-কুরআনে ব্যক্ত করা হয়েছে:
কখখনো নয়, নিশ্চিতভাবেই সেদিন তাদের রবের দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। [সূরা মুতাফফিফীন: ১৫]
উক্ত আয়াতে পাপীবান্দাগণকে আল্লাহর দর্শন থেকে বঞ্চিত রাখা হবে, এমন কথা বলার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শুধু পুণ্যবানগণ আল্লাহকে দর্শন করতে পারবে, এমন বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে সূরা আন্‘আমের ১০৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত দর্শনাতীত আল্লাহকে সূরা কিয়ামাহ’র ২২ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে প্রত্যক্ষদর্শনের নিশ্চয়তা জ্ঞাপন করা হলেও এক্ষেত্রে নতুন একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। শর্তটি হলো, আল-কুরআনে বর্ণিত দর্শনাতীত আল্লাহকে ইহলৌকিক জীবনে কেউ দর্শন করতে না পারলেও পারলৌকিক জীবনে শুধু পুণ্যবানগণ তাকে দর্শন করার সুযোগ পাবে। এভাবে সূরা আন্‘আমের ১০৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত দর্শনাতীত অবস্থান হতে বিচ্যুত হয়ে সূরা কিয়ামাহ’র ২২ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত দর্শনীয়তার পরিবর্তিত অবস্থান গ্রহণ করেছেন মুহম্মদের কল্পিত আল্লাহ। আর মৃত্যু পরবর্তী জীবন অর্থাৎ পারলৌকিক জীবনে জান্নাতবাসীগণ যে শুধুমাত্র নিজেদের সাধারণ চোখ দ্বারা আল্লাহকে দর্শন করবে, এই মর্মে স্বয়ং মুহম্মদ হাদিসে কুদসি বিবৃত করেছেন:
আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেন, “হে মূসা! তুমি কখনো আমাকে দেখিবে না। কোন জীবিত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করা ব্যতীত আমাকে দেখিবে না। স্থলভাগের কোন অধিবাসী (আমাকে) দেখিবে না, যতক্ষণ উহাকে নীচে নিক্ষেপ করা না হয়। (অর্থাৎ তাহার মৃত্যু হয়)। জলভাগের কোন অধিবাসীও দেখিবে না, যে পর্যন্ত না তাহাকে বিচ্ছিন্ন করা হয় (অর্থাৎ মৃত্যু হয়)। নিশ্চয়ই আমাকে দেখিবে জান্নাতবাসিগণ— যাহাদের চক্ষু দৃষ্টিহীন করা হইবে না এবং যাহাদের শরীর জরাগ্রস্ত হইবে না।
হাকীম ও তিরমিযী ইহা ইবনে আব্বাস (রা)-এর সূত্রে সংগ্রহ করিয়াছেন।
হাদিস নং— ৩৩৭; আল্লামা মুহাম্মদ মাদানী: “হাদীসে কুদসী” (অনুবাদ— মোমতাজ উদ্দীন আহমদ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২০০৪ খৃ., পৃ. ২৮১
তবে উপর্যুক্ত হাদিসে কুদসির প্রথম বাক্য (আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেন, “হে মূসা! তুমি কখনো আমাকে দেখিবে না।) - এর সাথে হিব্রু বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে বর্ণিত নিম্নলিখিত বাণীটির প্রথমাংশের যথেষ্ট মিল রয়েছে:
তিনি আরও বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমার মুখমণ্ডল দেখতে পাবে না, কারণ কোন মানুষ আমাকে দেখলে জীবিত থাকতে পারে না। [যাত্রাপুস্তক ৩৩:২০]
কিন্তু উক্ত বাণীর দ্বিতীয়াংশ (কারণ কোন মানুষ আমাকে দেখলে জীবিত থাকতে পারে না।’ ) - এর সাথে বর্ণিত হাদিসে কুদসির দ্বিতীয় বাক্য (কোন জীবিত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করা ব্যতীত আমাকে দেখিবে না।) - এর সামান্য পার্থক্য রয়েছে। অথবা বাক্য দু'টির মাঝে বিপ্রতীপ মিল বিদ্যমান। যেমন, বাইবেলের বাণীতে পরমেশ্বরকে দেখার পরে কোনো মানুষের মৃত্যুর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, আর হাদিসে কুদসির বাক্যটিতে কোনো মানুষের মৃত্যুর পরে আল্লাহকে দেখার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বাইবেল ও হাদিসে কুদসির বর্ণনায় পার্থক্য যথাক্রমে ‘ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষদর্শনের পরে মৃত্যুর নিশ্চয়তা’ এবং ‘মৃত্যুর পরে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষদর্শনের নিশ্চয়তা।’
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন