লিখেছেন রুদ্র নীল
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে মতান্তরে নবম অথবা দশম সনে হজ ফরজ হওয়ার আয়াত নাযিল হলে নবী করীম (সা.) এক খুতবায় তার ঘোষণা দিতে গিয়ে বললেন, "হে জনতা, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি হজ্ ফরজ করে দিয়েছেন, তাই হজ আদায় করে নাও।" একজন বলে উঠলেন, "হে আল্লাহর রাসূল, তা-কি প্রতি বৎসরই?" তিনি উত্তর দিলেন না। লোকটি তিন-তিনবার প্রশ্নটি করলো। শেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, "আমি যদি বলতাম হ্যাঁ, (again read & read & think) তাহলে প্রতি বৎসরই ফরজ হয়ে যেতো। আর তোমরা তা পালন করতে পারতে না।" অতঃপর তিনি বললেন, "যেটা আমি বলি না, সেটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করো না। তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছে বেশি বেশি প্রশ্ন করা (Mark it) আর নবীদের সাথে মতবিরোধের কারণে। আমি তোমাদের যা করার নির্দেশ দিই, সাধ্যমত তা করার চেষ্টা করো, আর যে বিষয় থেকে নিষেধ করি, তা বর্জন করো।’’- (বুখারী ও মুসলিম)।
এখন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, "আমি যদি বলতাম হ্যাঁ..." - এর অর্থ কি এটাই নির্দেশ করে না যে, ওহী না বরং "হ্যাঁ"-টা হতো নিজের মন থেকে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে কোনো কথা বলেননি। মহান আল্লাহ বলেন, وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى، مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى، وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوْحَى "শপথ নক্ষত্রের, যখন সেটা হয় অস্তমিত, তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট নয়, বিভ্রান্তও নয় এবং তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। এটা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।" (নাজম ১-৪) যিনি অহি-র মাধ্যম ছাড়া কথা বলেন না, তাহলে কেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, "আমি যদি বলতাম হ্যাঁ..." - কথাটি কি তিনি বললেন?
আসলে খেয়াল করলে অনেক কিছুই দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু আগেই মানা করা আছে :
০১. হে মুমিনগণ, তোমরা সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা তোমাদের কাছে প্রকাশ পেলে তোমরা কষ্ট পাবে। কোরআন অবতরণকালে তোমরা যদি সেই সব বিষয়ে প্রশ্ন করো, তাহলে তা তোমাদের জন্য প্রকাশ করা হবে। অতীত বিষয় আল্লাহ ক্ষমা করেছেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।
০২. তোমাদের আগেও তো এক সম্প্রদায় এ ধরনের প্রশ্ন করেছিল। এরপর তারা (উত্তর পেয়ে) এসব বিষয়ে অবিশ্বাসী হয়ে গেল (সুরা আল-মায়েদা, ১০১-১০২)। (খেয়াল কইরা বুইযেন)!
এবার আসুন হুযূর সাব কী বলেন:
তাফসির : উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে, কিছুসংখ্যক মানুষ আল্লাহর বিধিবিধানে অনাবশ্যক চুলচেরা ঘাঁটাঘাঁটি করতে আগ্রহী হয়ে থাকে এবং যেসব বিধান দেওয়া হয়নি, সেগুলো নিয়ে বিনা প্রয়োজনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলতে থাকে। আয়াতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন অহেতুক প্রশ্ন না করে। কেননা এতে আরো কঠোর বিধান নাজিল হতে পারে।(বাপ রে বাপ!!) ফলে তারা কষ্টে পতিত হবে, কিংবা গোপন রহস্য ফাঁস হওয়ার কারণে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে।
আলোচ্য আয়াতের শানে নুজুল : মুসলিম শরিফের বর্ণনা অনুসারে আলোচ্য আয়াতদ্বয়ের শানেনুজুল হলো, যখন হজ ফরজ হওয়ার বিধান নাজিল হয়, তখন আকরা ইবনে হারেস (রা.) প্রশ্ন করলেন, 'হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের জন্য কি প্রতিবছরই হজ ফরজ?' রাসুল (সা.) এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। প্রশ্নকারী পুনর্বার প্রশ্ন করলেন। তিনি এবারও নিশ্চুপ। প্রশ্নকারী তৃতীয়বার প্রশ্ন করলে তিনি শাসনের সুরে বললেন, 'আমি যদি তোমার উত্তরে হ্যাঁ বলতাম, তাহলে প্রতিবছরই হজ ফরজ হয়ে যেত। কিন্তু তুমি এ আদেশ পালন করতে পারতে না।' অতঃপর তিনি বললেন, 'যেসব বিষয় সম্পর্কে আমি তোমাদের কোনো নির্দেশ দিই না, সেগুলো নিয়ে তোমরা অবান্তর ও অর্থহীন প্রশ্নে লিপ্ত হয়ো না। তোমাদের আগে কোনো কোনো উম্মত বেশি বেশি প্রশ্ন করেই ধ্বংস হয়ে গেছে।'
এবার আমরা সহীহ ভদ্রতা শিখি:
প্রশ্ন করার আদব ও শিষ্টাচার: পবিত্র কোরআন শুধু মানুষের ইমান-আকিদা বিশুদ্ধ করা এবং কিছু আমল ও আইনের কথা জানানোর জন্যই নাজিল হয়নি; বরং একটি জাতিকে সব দিক থেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমাজের প্রত্যেক মানুষকে নৈতিক ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ মানবদল গড়ে তুলতে কোরআন নাজিল হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে প্রশ্ন করার আদব-কায়দা শেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অধিক পরিমাণে কথা বলা ও বাচালতা মুমিন মুসলিমের কাজ নয়। মুমিনদের বিশেষ গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে' (সুরা মুমিনুন : ৩)।
হাদিস শরিফে এসেছে, "মুসলমান হওয়ার একটি সৌন্দর্য হলো, মুসলমান ব্যক্তি অনর্থক বিষয়াদি পরিত্যাগ করে।" তাই প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে আদব ও শিষ্টাচার হলো, অহেতুক প্রশ্ন করা যাবে না। আর অহেতুক ও অর্থহীন প্রশ্ন করা হলে উত্তরদাতাও এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নন। (লেও ঠেলা)! আজকাল অনেকে অনর্থক বিষয়াদির তথ্য অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকে, মানুষের প্রয়োজনীয় কাজের সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই।এতে নিজের ও অন্যের সময় নষ্ট হয়। এর অর্থ এই নয় যে কাউকে কোনো প্রশ্নই করা যাবে না; বরং জ্ঞান অর্জনের জন্য, শরিয়তের ওপর আমল করার জন্য প্রশ্ন করতেও ইসলামে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । আল্লাহ বলেন, 'তোমরা যদি না জানো, তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো' (সুরা নাহল : ৪৩)।
কিন্তু কাউকে অপমান করার জন্য, কাউকে বিব্রত করার হীন উদ্দেশ্যে কিংবা যেসব প্রশ্ন অবান্তর, অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়, সেসব প্রশ্ন করা যাবে না। ছাত্র জানার জন্য শিক্ষককে প্রশ্ন করতেই পারে, কিন্তু তা কখনোই শিক্ষককে পরীক্ষা করা, অপমানিত করার জন্য হতে পারবে না। ইসলামের অন্যতম শিক্ষা হলো, কোনো ধর্মীয় কিংবা জাগতিক কল্যাণ উদ্দেশ্য না হলে যেকোনো জ্ঞানানুশীলন, কর্ম ও কথায় লিপ্ত হওয়া উচিত নয় ।
এবার জাকির নায়েক-এর জন্য: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَحْسَنَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ، وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم، وَشَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا ‘সর্বোত্তম কালাম হ’ল আল্লাহর কিতাব আর সর্বোত্তম পথ নির্দেশনা হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পথ নির্দেশনা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে নব উদ্ভাবিত বিষয়সমূহ।’ (বুখারী হা/৭২৭৭; মিশকাত হা/৯৫৬।) নায়েক সাহেব যেভাবে সব কিছু বৈজ্ঞানিক ভাবে হালাল বলে চলেছেন, ঔ ব্যাটাও দুষ্টু, নিকৃষ্ট!
ও মানব, ধর্ম কীভাবে মানুষকে বিভক্ত করে জেনে নাও:
মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদ বাহক ও ভয় প্রদর্শকরূপে নবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং তিনি তাদের সাথে সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করলেন যেন (ঐ কিতাব) তাদের মতভেদের বিষয়গুলো সম্বন্ধে মীমাংসা করে দেয়। অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের নিকট সমাগত হওয়ার পর পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষবশতঃ তারা সে বিষয়ে বিরোধিতা করত’ (বাক্বারাহ ২/২১৩); এবং এভাবেই মানুষের মধ্যে হানাহানি, মারামারি শুরু হয়...
অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সহীহ প্রমাণগুলো পাবার পর আর কিছু বলার নেই। সংক্ষিপ্ত ভাবে দিলাম, মানব তুমি বুঝে নিও স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞান দিয়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন