লিখেছেন ইত্তিলা ইতু
১.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুসলমানি কার্যক্রম তো সম্পন্ন হল। মুসলমানি উপলক্ষে ব্লগার বলিও হল। বাকি থাকে শরিয়া আইন কায়েম করা, ৯০% মুসলমানের দেশকে ১০০% মুসলমানের দেশে রূপান্তর করা। ১০% এখন হয় আগা কেটে কনভার্ট হও, নতুবা বর্ডার ক্রস করো, তবে গনিমতের মালগুলোকে কোথাও যেতে দেয়া যাবে না। তাদেরকে রেখে দেয়া হবে ঈমানদণ্ডের সেবা করার জন্য।
মুসলমানির পর সরকারের মন্ত্রীরা নাকি বলেছেন, দেশের কোথাও সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হলে সরকার ঘরে বসে থাকবে না। হ্যাঁ, সরকার ঘরে বসে থাকবে না, সরকারও সংখ্যালঘুদের অত্যাচার নির্যাতন করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। এমন সুন্নতি কাজ ফেলে কেউ ঘরে বসে থাকতে পারে?
সামনে পহেলা বৈশাখ। দেশের মুসলমানি যখন হয়েই গেলো, ‘পহেলা বৈশাখকে না বলুন’ কর্মসূচিও শুরু করা উচিত। ফেসবুকে এ জাতীয় একটা ইভেন্টও দেখলাম। যদিও মডারেটরা এর ঘোর বিরোধিতা করছেন। এইসব ইভেন্ট নাকি ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে ভুল ধারণা দিচ্ছে। মডারেটদের মতে, শফি হুজুররা ইসলামের অপব্যাখা দিচ্ছে, আইসিস-বোকো হারাম-আল কায়দা-হামাস জাতীয় ইসলামী জঙ্গি সংগঠন গুলো ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সবাই তো দেখছি ইসলামের অপব্যাখা দিচ্ছে, ইসলাম সম্পর্কে ভুল তথ্য তুলে ধরছে। সঠিকটা তবে কারা তুলে ধরছে? সঠিকটা আসলে কী?
২.
রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে যা কিছু কথাবার্তা-প্রতিবাদ, তার সবকিছুই হচ্ছে অনলাইনে। অনলাইনের নাস্তিকরা ছাড়া এ নিয়ে কেউ কোনো শব্দ করছে না। এটা আমাকে খুব অবাক করেছে। কয়েকজন সেলেব্রেটি মডারেটের আইডি পেইজ ঘেঁটে দেখলাম, তাদের সব কথা তনু হত্যা, তনু ধর্ষণ নিয়ে। রাষ্ট্রধর্ম নিয় একটি বাক্যও নেই। তনু ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি বলা হয়েছে, এ নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ। রাষ্ট্রধর্ম যেহেতু ইসলাম। আর ইসলামের আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে চারজন পুরুষ সাক্ষী অথবা ৮ জন নারী সাক্ষী (যেহেতু ইসলামে ১ জন পুরুষ = ২ জন নারী) জোগাড় না করতে পারলে অভিযোগকারীর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কাজেই তনু ধর্ষণের যেহেতু কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি, কাজেই তনুর ধর্ষণ হয়নি। এটা তারা মেনে নিতে চাইছে না কেন?
৩.
‘ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে দমিয়ে রাখা যাবে না’ - এই জোকটি নাকি নারী দিবসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার এক বক্তব্যে বলেছেন। জোক বলছি এই কারণেই, কারণ শরিয়া আইনে নারীর ঘর থেকে বের হওয়াই নিষেধ।
স্বামী তার স্ত্রীকে পবিত্র আইন শিক্ষার জন্য গৃহের বাইরে যাবার অনুমতি দিতে পারবে। সেটা এই কারণে যে যাতে করে স্ত্রী জিকির করতে পারে এবং আল্লাহ্র বন্দনা করতে পারে। এই সব ধর্মীয় শিক্ষা লাভের জন্য স্ত্রী প্রয়োজনে তার বান্ধবীর গৃহে অথবা শহরের অন্য স্থানে যেতে পারে। এ ছাড়া স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী কোনোক্রমেই তার মাহরাম (যে পুরুষের সাথে তার বিবাহ সম্ভব নয়, যেমন পিতা, ভ্রাতা, ছেলে…ইত্যাদি) ছাড়া গৃহের বাইরে পা রাখতে পারবে না। শুধু ব্যতিক্রম হবে হজ্জের ক্ষেত্রে, যেখানে এই ভ্রমণ বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া অন্য কোনো প্রকার ভ্রমণ স্ত্রীর জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং স্বামীও অনুমতি দিতে পারবে না। - শরিয়া আইন, এম ১০.৩
স্বামীর কর্তব্য হবে স্ত্রীকে গৃহের বাইরে পা না দেবার আদেশ দেওয়া। - শরিয়া আইন, এম ১০.৪
আর নারী নেতৃত্ব তো হারাম আছেই। এখন মডারেটরা সব এসে বলবে, কোথায় ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম বলা হয়েছে? দেখান, ইসলামের অপব্যাখা দেবেন না। এই নিন রেফারেন্স:
সহীহ বুখারী (তাওহীদ) অধ্যায় (হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih): ৯২/ ফিতনা, হাদিস নাম্বার:৭০৯৯--আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একটি কথা দিয়ে আল্লাহ্ জঙ্গে জামাল (উষ্ট্রের যুদ্ধ) এর সময় আমাকে বড়ই উপকৃত করেছেন। (তা হল) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যখন এ খবর পৌঁছল যে, পারস্যের লোকেরা কিসরার মেয়েকে তাদের শাসক নিযুক্ত করেছে, তখন তিনি বললেন: সে জাতি কক্ষনো সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোন স্ত্রীলোকের হাতে অর্পণ করে।... মুসলমানরা যদি সফলতা পেতে চায় তবে তাদেরকে অবশ্যই নারী নেতৃত্ব পরিহার করতে হবে। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬০৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬১৮)
৪.
কলেজে এক ক্লাসমেট ছিল, কথায় কথায় কোরান-হাদিস
নিয়ে আসতো। মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাশ করেছে। সে একবার আমাকে বোঝাচ্ছিল, নাস্তিকতা কতটা খারাপ।
নিয়ে আসতো। মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাশ করেছে। সে একবার আমাকে বোঝাচ্ছিল, নাস্তিকতা কতটা খারাপ।
‘কোরানে কী নাই? সবকিছুই আছে, তারপরও কেন নাস্তিকরা কোরান মানে না? আল্লাহ্ মানে না?’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কলেজের সব ছেলের সাথে তোর যোগাযোগ। তোর এই পোলা-নাচানি স্বভাবের ব্যাপারে কোরানে কিছু নাই?'
সে তখন বলল, ‘আমরা গুনাহগার বান্দা। গুনাহ করি, আমাদেরও শাস্তি হবে।’
বললাম, ‘তাহলে আমাদের শাস্তির ব্যাপারটাও আল্লাহর হাতে ছেড়ে দে, প্লিজ।’
নাস্তিকদের শাস্তির ব্যাপারটা মুমিনরা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন? কারণ আল্লাহ্ নিজে নাস্তিকদের কঠোর শাস্তি দেবেন পরকালে। তবে ইহকালে তাদের জন্য কিছু শাস্তির দায়িত্ব তিনি প্রকৃত মুসলমানদের ওপর দিয়ে গেছেন। জানি মডারেটগণ মানবেন না। তাই রেফারেন্স হাজির:
আর তাদেরকে হত্যা কর যেখানে পাও সেখানেই। (কোরান ২:১৯১)
খুব শীঘ্রই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করবো। (কোরান ৩:১৫১)
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। (কোরান ৫:৩৩)
যুদ্ধ কর ওদের সাথে, আল্লাহ তোমাদের হস্তে তাদের শাস্তি দেবেন। তাদের লাঞ্ছিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জয়ী করবেন এবং মুসলমানদের অন্তরসমূহ শান্ত করবেন। (কোরান ৯:১৪)
তোমরা যুদ্ধ কর আহলে-কিতাবের ঐ লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম। (কোরান ৯:২৯)
হে নবী, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ (ইংরেজি অনুবাদে - strive hard) করুন এবং মুনাফেকদের সাথে তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন। (কোরান ৯:৭৩)
হে ঈমানদারগণ, তোমাদের নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করুক আর জেনে রাখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। (কোরান ৯:১২৩)
আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাট জোড়ায় জোড়ায়। (কোরান ৮:১২)
৫.
নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, নাজিমুদ্দিন সামাদ ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর লেখালেখি করতেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরও বলেছেন, এভাবে মানুষের ধর্মে আঘাত দেওয়া, বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া, পৃথিবীর কোনও দেশেই তা গ্রহণযোগ্য নয়।
অন্যান্য ব্লগার হত্যার পর সাধারণত মন্ত্রীরা বলতেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। যদিও এর কোনোকিছুই বাস্তবে ঘটতো না। তবে রাষ্ট্রের মুসলমানি হওয়ার পর মন্ত্রীর কথাও পাল্টে গেলো। মন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, নাজিমুদ্দিন কী লিখেছে, সেটার ওপর নির্ভর করবে তাকে হত্যা করা ঠিক হয়েছে, নাকি ভুল।
ব্লগার হত্যা ব্যাপারটা কিছুদিন থেমে থাকলেও এতদিন পর ঠিক এই সময়েই ব্লগার হত্যার কারণটা কী হতে পারে? রাষ্ট্র ধর্ম, তনু হত্যা, রিজার্ভের টাকা লুট এইসব ইস্যু নিয়ে যখন অনলাইনে ব্লগাররা প্রতিবাদ করছে, এই মুহূর্তে ব্লগারদের লেখার বিষয় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই কি আরেকজন ব্লগার হত্যা?
আমারও আগে ভাবতে ভালো লাগতো যে, ব্লগার হত্যাগুলো করছে জামাত-শিবির। সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে জামাত-শিবির দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু একের পর এক এতগুলো হত্যার পর কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। বিচারের নাম নেই, ব্লগাররা কী লিখল, সেসব খতিয়ে দেখতে ব্যস্ত। এ থেকে অনুমান করা যায়, প্ল্যান শুধুমাত্র জামাত-শিবিরের নয়। ব্লগার হত্যাগুলোর কোনোটাই, খুব সম্ভব, প্রশাসনের অজান্তে ঘটেনি।
ব্লগার-প্রকাশক হত্যাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, মূর্খরা কলমকে কতটা ভয় পায়। এত কিছুর পরও তাদের অন্ধ বিশ্বাসে আমরা প্রতিনিয়ত আঘাত দিয়ে যাচ্ছি। তাদের বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করছি। মৃত্যু জেনেও করছি। এর কোনো তুলনা হয় না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন