লিখেছেন তসলিমা আক্তার লিমা
ধর্ম যখন মানুষের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি ঘটে একটি জাতির জীবনে। তা-ই হয়ে এসেছে চিরকাল, ইতিহাস তা-ই বলে। অথচ কে না জানে, মানুষের জন্য ধর্ম এসেছিল, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। আজ যেন মানুষ হয়ে গেছে গৌণ আর ধর্ম হয়ে উঠেছে মূখ্য এক শ্রেণীর মোল্লা-পুরোহিতদের কাছে। আর এই ধর্মের নামে তথাকথিত শরিয়ত-এর খাতিরে নারী সমাজকে বলি হতে হচ্ছে মোল্লাতন্ত্র আর পুরোহিতের যাঁতাকলে।
ইসলাম ধর্মে নারীকে যতটা অবরুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা করা হয়েছে, আর সকল ধর্ম মিলেও তার সমান হবে না। ইসলামী দেশ এবং এর রীতিনীতির মধ্যে যা আসে, তার মধ্যে পর্দাপ্রথা বা হিজাব অন্যতম। আমাদের দেশ সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় হলেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও কোরান ও সুন্নাহর শাসন ব্যবস্থা চালু হয়নি, তাই নাগরিকরা কিছুটা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে আসছেন। কিন্তু কোরান ও সুন্নাহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালুর জন্য মরিয়া কিছু উগ্র ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলো ইসলামী বিভিন্ন কট্টরপন্থী নিয়মনীতি চালু করে দিয়েছে। তার মধ্যে হিজাব উল্লেখ্যযোগ্য। কারণ তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নারী। তারা জানে, একটি নারীকে বন্দী করতে পারলে পরিবারকে বন্দী করা সম্ভব। তাছাড়া নারী জাতি সহনশীল এবং তুলনামুলকভাবে কম প্রতিবাদী হওয়ায় তাদেরকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে উগ্র ইসলামী গোষ্ঠীগুলো। আর এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র।
কিন্তু একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমি কখনোই এই আরোপিত হিজাবকে সমর্থন করতে পারি না। বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জনের মত মুসলিম। স্বাভাবিকভাবে জন্মসূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হচ্ছে মুসলিম। নারী-পুরুষের সংমিশ্রণে এই দেশ। আর নারী ও ইসলাম নিয়ে কথা উঠলেই কথা আসে পর্দাপ্রথার অর্থাৎ হিজাবের। ইসলামে নারী ও পুরুষ সবাইকে পোশাকের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া আছে। কিন্তু কাজ ভেদে, খেলাধূলার ধরন ভেদে, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে, ভৌগলিক অবস্থান ও অঞ্চল ভেদে, কখনো বা সময়ের প্রভাবে পোশাক যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাল্টায়, যাতে ঐ বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় মানুষ তার ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু ইসলামে নারীর পোশাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ পোশাকের এই যৌক্তিক কার্যকারণগুলোকে মানে না। তাই এত বিতর্ক।
অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মুসলিম নারীসমাজ এই অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের জন্য কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদ করতে পারেননি। মুসলিম নারীদের মুক্তির সংগ্রামে এই পর্দাপ্রথা হয়ে উঠেছে প্রধান অন্তরায়। দাসত্বের এই প্রতীকের জন্য তারা ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে। পুরুষ আধিপত্যের শেকল ছিঁড়ে নিজ গৃহের বন্দীত্ব থেকেই মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে নারীরা এর বিরোধিতা করেনি তা নয়। মুসলিম রমণীরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন এসব প্রথার বিরুদ্ধে। ১৯২৩ সালে মিশরে প্রথম একটি প্রতিবাদ হয়, মিশরের ফেমিনিস্ট ইউনিয়নের প্রধান মিজ হুদার নেতৃত্বে। তিনি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে তাঁদের পর্দা ছুঁড়ে ফেলে দেন সমুদ্রে। তুরস্কে হিজাবের বিরুদ্ধে সরকার থেকে লড়াই শুরু হয় ১৯২৭ সালে। তখন কম্যুনিস্ট সরকার ছিল ক্ষমতায়। সেই সময় ৭,০০০ মহিলা প্রকাশ্যে তাদের হিজাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের সাথে শত্রুতা করার জন্য তাদের ৩০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আজকের যে কট্টর আফগানিস্তান, সেখানেও বাদশা শাহ-এর সময় স্বাধীনতা উৎসবে, ১৯২৮ সালে পর্দাপ্রথার শেকল থেকে নারীকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি তার স্ত্রীকে জনসম্মুখে পর্দা ছাড়া উপস্থিত হতে বলেছিলেন। পরে মুসলিম মৌলবাদীর ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে নারীমুক্তির সব ধরনের প্রকল্প তাঁকে বাদ দিতে হয়েছিল। ক্ষমতাও ছাড়তে হয় তাকে। ইরানের রেজা শাহ ১৯৩৬ সালে একটি বিশেষ আইন করে 'চাদর' পরা বন্ধের আদেশ দেন। কিন্তু সংস্কৃতির বিপক্ষে তার এই আদেশ জনপ্রিয়তা পায়নি এবং জনপ্রতিবাদের মুখে ১৯৪৬ সালে তিনি আবার তা পুনর্বহাল করেন।
পর্দা নারীর মুক্ত বিচরণকে রুদ্ধ করে দেয়, এটি বলার অবকাশ রাখে না। যদিও মুসলিম রমণীদের অনেকে তাদের প্রয়োজনমত এসব নিয়মকানুনকে একটু মোচড়ে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। কিন্তু খুব একটা সরব প্রতিবাদে তারা সহজে জড়াতে চান না সাধারণত পরিবার, সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্র আরোপিত শাস্তির ভয়ে। কিন্তু ‘হিজাবের’ অর্থ কেবল পোশাকের মাঝে জড়িত মনে করলে ভুল করা হবে। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরো অনেক নিয়ম-নীতি। যদি প্রশ্ন ওঠে যে, মুসলিম নারীর কি ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে? এর উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে, তার নিজের বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটাও হিজাবের বা পর্দাপ্রথার অংশ। ইমাম সূয়ূতী র. বলেন, এটি সকল নারীর জন্য হিজাবের আয়াত। এতে মাথা ও চেহারা ঢাকা ওয়াজিব করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন, আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের স্ত্রীদের আদেশ করেছেন তারা যেন প্রয়োজনের মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ওপর দিয়ে পর্দা ঝুলিয়ে চেহারা ঢেকে রাখে এবং শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৩/৮২৪)
কী জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গী নারীর প্রতি! যারা গোঁড়া/উগ্র মৌলবাদী কিংবা ইসলামী শাসন কায়েমে বিশ্বাসী, তাদের মতে - এই আদেশ সকল মুসলিম রমণীর জন্য। আজকের আধুনিক সমাজে যখন দেখি কোনো সম্প্রদায়ের যাবতীয় ধ্যান-ধারণা এবং চেতনা দিয়ে নারীকে পর্দা বা হিজাবের মধ্যে আবদ্ধ রাখার দলগত এবং ব্যক্তিগত চেষ্টায় লিপ্ত, তখন অবাক এবং প্রতিবাদ না করে পারি না। এই একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের বাংলাদেশে চলছে নারীকে হিজাবের আবরণে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা। পর্দাপ্রথা ও ইসলামের দোহাই দিয়ে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। সময় এসেছে পর্দা ছুঁড়ে ফেলে নিজের সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস-এর মোহ থেকে মুক্ত করে যুক্তি এবং বাস্তবতার আলোকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন