লিখেছেন শেখ মিলন
গ্রামের নাম রামপুর। ভৈরবের তীরে গড়ে ওঠা এই গ্রামে এখন গোটা দশ-বারো হিন্দু ঘরের বাস। পেশা - নদীতে মাছ ধরা, আর সে মাছ হাটে বেচে যা মেলে, তা দিয়ে দু'বেলা দু'মুঠো খেয়ে না-খেয়ে তাদের দিন কাটে। গ্রামে দু'শো বছরের পুরোনো একটা মন্দির আছে। কালী মন্দির। মন্দিরের পুরোহিত দিলীপ ভট্টাচার্য্য দেবীর রক্তরাঙা চরণে রক্তজবা দিয়ে পূজা করেন রোজ সকালে। নিঃসন্তান এই পুরোহিতের দিন গুজরান হয় দেবীর প্রসাদ আধপেটা খেয়ে।
শ্যামল দাস আর তার ছোট ভাই কমল দাস জাল আর বর্শা হাতে নদীর দিকে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে টুকরি হাতে অনুকূল চলেছে বাবা-কাকার সাথে মাছ ধরতে। নদীপাড়ে বেশকিছু মানুষ দেখা গেল। দাড়ি-টুপিওয়ালা পুরুষ, আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত নারী, তারা মুসলিম, ভিন্নগ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু তাদের সঙ্গে গবাদি পশু ও জিনিসপত্র দেখে মনে হচ্ছে, তারা চলে এসেছে গ্রাম ছেড়ে।
দু'দিনের মধ্যেই নদীর বুকে জেগে ওঠা ছোট্ট চরটিতে বসতি গড়ে নবাগত পরিবারেরা। তারা বসত ঘর তোলে, গোয়াল ঘর তোলে, হেঁশেল ঘর তোলে, আর তোলে মসজিদ। নদীর পানি শুকালে চর আর রামপুরের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না। মনে হয় পুরোটাই একটা গ্রাম। সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদ থেকে কোরান পাঠের সুকরুণ সুর ভেসে আসে। হঠাৎ একদিন গুঞ্জন ভেসে আসে, গ্রামের নাম নাকি মুসলিমেরা রহিমপুর করেছে, রামপুর নাম তাদের পছন্দ না। কমল দাস দিলীপ পুরোহিতকে একথা জানালে পুরোহিত বলে, "তাদের চরের নাম তারা রহিমপুর ডাকুক, আমাদের গ্রামের নাম রামপুর। এ তো ঠিকই আছে।"
দু'দিন পর মসজিদের ইমাম খবর পাঠালো আজ পুরোহিতের সাথে বৈঠক হবে বাদ আসর। বিকেল বেলা দাড়িওয়ালা, টুপি-জোব্বা পরা গোটা পাঁচেক লোক এলো, পুরোহিতসহ গ্রামের বেশকিছু মানুষ জমায়েত হয়েছে নদীপাড়ের বটগাছের নিচে। খেজুর পাতার পাটি মাটিতে বিছিয়ে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হলো। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, তিনি তাঁর মেহেদি দিয়ে রঙিন করা দাড়ির মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, "উপস্থিত ভাই ও বোনেরা, আমরা আল্লাহর অশেষ রহমতে এই নদীর ঐ চরে ঘর বেঁধেছি, বসতি গড়েছি আর তার নাম দিয়েছি মহান আল্লাহ তা'লার নামে 'রহিমপুর'।" তার সঙ্গীরে সমস্বরে বলে উঠলো, "সুবহানাল্লাহ!" গ্রামের মানুষেরা চুপ করে রইলো।
এরপর সবার দিকে তাকিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, "মন্দিরের পুরোহিত কে?" দিলীপ ভট্টাচার্য বললেন, "আমি।" তার দিকে দৃষ্টি স্থির করে লোকটি বললেন, "পুরোহিত মশাই, আপনারা সন্ধ্যাবেলায় ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করলে আমাদের নামাযের সমস্যা হয়। তাই সন্ধ্যায় ঘন্টা বাজাবেন না।" তারপর আবারও দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে তিনি আরবিতে কোরানের দু'টি আয়াত পড়ে বললেন, "মহান রব্বুল আল আমিন ইরশাদ করেছেন, তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে।" পুরোহিত বললেন, "আচ্ছা , ঘন্টাধ্বনিতে যদি আপনাদের সমস্যা হয়, তাহলে আমরা ঘন্টা বাজাবো না।" সেদিনের মতো বৈঠক শেষ হলো, যে যার ঘরে ফিরে গেল।
পরদিন থেকে সন্ধ্যায় মন্দিরে পূজোতে ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল না। তার ঠিক একমাস পর চরের মসজিদে ব্যাটারিচালিত মাইক লাগানো হলো এবং প্রতিদিন পাঁচবেলা উচ্চস্বরে আজান দেওয়া শুরু হলো। পুরোহিত দু'জন লোক পাঠালেন বৈঠকের জন্য। সেদিন বিকেলে পুরোহিতসহ আরও তিনজন চরে গেলো বৈঠকের জন্য। শীতল পাটি বিছিয়ে বসার ব্যাবস্থা করা হলো।
পুরোহিত বললেন, "ইমাম সাহেব, পূুজোর সময় আস্তে আজান দিয়েন। আমাদের পুজোতে অসুবিধে হয়।" ইমাম বললেন, "আমরা আল্লাহ তা'লার ঘরে মানুষকে ডাকছি, তাই উচ্চস্বরেই ডাকতে হবে, যেন সে ডাক সবার নিকটে পৌঁছায়।" পুরোহিত বললেন, "আপনাদের অসুবিধার কারণে তো আমরা সন্ধ্যায় ঘন্টা বাজানো বন্ধ করে দিয়েছি, আর আপনারা অকৃতজ্ঞের মতো না বলছেন কেন?"
ইমাম উঠে দাঁড়িয়ে জমায়েতকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, "যারা আল্লাহর সাথে অন্য কারো তুলনা করে, তারা মুশরিক, তারা কাফের। এই হিন্দু পুরোহিত আমাদের আল্লাহর সাথে তাদের ঐ মন্দিরের মাটির তৈরি পুতুলের তুলনা করেছে, আল্লাহকে অপমান করেছে। পবিত্র কোরান পাকে সূরা তওবার ৫নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, " মুশরিকদের হত্যা কর। যেখানে তাদের পাও, তাদের বন্দী কর এবং অবরোধ কর। "
একথা শোনার পর জমায়েত উপস্থিত সকল পুরুষেরা "নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার" বলে তাকবির দিতে দিতে দৌড়ে গেল রামপুরের দিকে, তাদের পেছনে পেছনে ছুটলো পুরোহিতসহ আরও তিনজন। বৃদ্ধ পুরোহিত দৌড়াতে পারছিলো না , বাকি তিনজন দৌড়ে পুরোহিতকে পেছনে ফেলে আগে বেরিয়ে গেল।
পুরোহিত যখন নদীতীরের বটতলায় পৌঁছালো, তখন দেখলো ভাঙা মন্দির, অদূরেই আগুনে জ্বলছে তাদের ঘরবাড়িগুলো, কানে আসছে বৃদ্ধ, শিশু, নারীর চিৎকার আর কান্নার শব্দ। "আল্লাহু আকবার" বলে চিৎকার করে যেন মুসলিমরা সে শব্দ ছাপিয়ে যেতে চাইছে। অবাক, নির্বাক, হতবাক বৃদ্ধ পুরোহিত...
বাতাসে অসহায় অশ্বথের পাতা যেন ভয়ে তিরতির করে কাঁপছে। সূর্যকে আড়াল করে মেঘ জমেছে আকাশে। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ঘন কালো ঐ মেঘ গলে গিয়ে এখনই ভারী বর্ষণ হবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন