লিখেছেন ক্যাটম্যান
মুক্তচিন্তা চর্চা, প্রচার ও প্রসারের কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ফয়সল আরেফিন দীপন ও নাজিমুদ্দিন সামাদ সহ নিহত ও আহত সকল মুক্তচিন্তকের স্মরণে এই লেখাটি অপরিমেয় ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ নিবেদন করছি।
তবে ইস্রায়েল সন্তানদের মাঝে বসবাসের জন্যে মূসার পরমেশ্বর যে নয়া অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তার পশ্চাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিদ্যমান। আর সে কারণটি হলো মূসার বার্ধক্য। অতীতে স্বকপোলকল্পিত পরমেশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ ব্যপদেশে অশীতিপর বৃদ্ধ মূসাকে প্রায়ই সুউচ্চ পর্বতে আরোহণ করতে হতো। এমনকি পর্বতে আরোহণের সময় মূসাকে মাঝেমধ্যে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হারুনও সঙ্গ দিতেন, যা ছিল বৃদ্ধ মূসা ও হারুনের জন্য চরম ক্লেশকর একটি অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতার জন্য তাদের বার্ধক্যজনিত সীমাবদ্ধতা দায়ী। যেহেতু নিজেদের বার্ধক্য এড়িয়ে চলা অসম্ভব, সেহেতু নিজেদের সুবিধার্থে স্বয়ং পরমেশ্বরকে সুউচ্চ পর্বত হতে সমতলে নামিয়ে আনা সমীচীন মনে করেছেন বৃদ্ধ মূসা।
আর মূসা ও হারুন উভয়েই যে ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ, সে বিষয়টি আমরা বাইবেল থেকে জেনেছি। ইস্রায়েল সন্তানদেরকে মিশর দেশ থেকে বের করে আনার পূর্বে ফারাওর সঙ্গে মূসা যখন কথা বলেছিলেন, তখন তার বয়স ছিল আশি বছর এবং তার ভাই আরোনের বয়স ছিল তিরাশি বছর। এ বিষয়ে বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে:
ফারাওর সঙ্গে কথা বলার সময়ে মোশীর বয়স ছিল আশি বছর, ও আরোনের বয়স ছিল তিরাশি বছর। [যাত্রাপুস্তক ৭: ৭]
উপর্যুক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে আমরা নিশ্চিত যে, মিশর দেশ থেকে ইস্রায়েল সন্তানদেরকে নিয়ে বের হয়ে আসার প্রাক্কালে মূসা ও হারুন ছিলেন যথাক্রমে আশি ও তিরাশি বছরের অশীতিপর বৃদ্ধ। তাদের এই বৃদ্ধাবস্থায় পরমেশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ ব্যপদেশে তাদেরকে যেন ঘন ঘন পর্বতে আরোহণ করতে না হয়, সেজন্য মূসা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এখন থেকে তার কল্পিত পরমেশ্বর ইস্রায়েলি শিবির হতে দূরবর্তী পর্বতচূড়ায় অবতরণ ও অবস্থান না করে বরং মূসা ও তার একান্ত বিশ্বস্ত অনুচরবৃন্দের সুবিধার্থে ইস্রায়েল সন্তানদের মাঝে এসে বসবাস করবেন। যেহেতু পরমেশ্বর মূসার আজ্ঞাবহ দাস, সেহেতু তিনি মনিব মূসার হুকুম যথাযথভাবে পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি ইস্রায়েল সন্তানদের থেকে দূরে থাকার সাবেকী নীতি পরিত্যাগ করে মনিব মূসার নয়া অভিপ্রায় অনুসরণপূর্বক ইস্রায়েল সন্তানদের মাঝে বসবাসের নয়া অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মূসার পরমেশ্বর স্বীয় অভিপ্রায় অনুসরণ না করে মূসার অভিপ্রায় অনুসরণ করেছেন, যেন মূসার পরমেশ্বরের নিজস্ব কোনো অভিপ্রায় নেই। বাস্তবিকই মূসার পরমেশ্বরের নিজস্ব অভিপ্রায় বলে কিছু নেই। কারণ পরমেশ্বর হলো সুচতুর মূসার স্বকপোলকল্পিত একটি চটকদার ধারণা। যেহেতু পরমেশ্বর বলে আদতে কেউ নেই, সেহেতু তেমন কল্পিত পরমেশ্বরের নিজস্ব অভিপ্রায় বলে কিছু থাকতে পারে না। তাই কল্পিত পরমেশ্বরের যাবতীয় ঐশী অভিপ্রায় নির্ধারণ এবং পরমেশ্বরের ভূমিকায় ঐশী সিদ্ধান্ত প্রদানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন মূসা। স্বকপোলকল্পিত পরমেশ্বরের ভূমিকায় মূসাকেই অভিনয় করতে হয়। তাই স্বয়ং মূসাই এক্ষেত্রে সর্বেসর্বা ঈশ্বর। আর স্বয়ং মূসাই যে ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বরের নাম ভূমিকায় মূসাকেই যে সার্বিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, এমন স্বীকারোক্তি বাইবেলের বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন:
তখন প্রভু মোশীকে বললেন, ‘দেখ, ফারাওর কাছে আমি তোমাকে ঈশ্বর যেনই করব, আর তোমার ভাই আরোন হবে তোমার নবী। [যাত্রাপুস্তক ৭: ১]
উপর্যুক্ত বর্ণনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূসার পরমেশ্বর ফারাওর নিকট মূসাকে ঈশ্বররূপে উপস্থাপনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং মূসার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হারুনকে নিজের নবী মনোনীত না করে মূসার নবী মনোনীত করেছেন। অর্থাৎ স্বয়ং মূসা যেখানে ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করছেন, সেখানে ঈশ্বরের মনোনীত নবী হওয়ার অর্থ হলো মূসার মনোনীত নবী হওয়া; অথবা মূসার মনোনীত নবী হওয়ার অর্থ হলো ঈশ্বরের মনোনীত নবী হওয়া।
আর স্বকপোলকল্পিত ঈশ্বরের ভূমিকা পালন এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হারুনকে সহযোগী নবী মনোনীত করার দায়িত্ব যে স্বয়ং মূসার কাঁধে বর্তেছে, এ বিষয়টি বাইবেলে আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে নিম্নলিখিত বর্ণনায়:
মোশী প্রভুকে বললেন, ‘হায় প্রভু আমার! আমি তো বাক্পটু নই; এর আগেও কখনও ছিলাম না, এই দাসের সঙ্গে তোমার কথা বলবার পরেও নই; আমি বরং জড়মুখ ও জড়জিভ।’ প্রভু তাঁকে বললেন, ‘মানুষকে কে জিহ্বা দিয়েছে ? কিংবা তাকে কে বোবা, বধির, দর্শী বা অন্ধ করে ? আমি সেই প্রভু, তাই না ? এখন তুমি যাও; আমি তোমার মুখের সঙ্গে সঙ্গে থাকব ও কী বলতে হবে তোমাকে শেখাব।’
মোশী বললেন, ‘প্রভু আমার, দোহাই তোমার, অন্য যার দ্বারা পাঠাতে চাও, পাঠাও!’ তখন মোশীর উপরে প্রভুর ক্রোধ জ্বলে উঠল; তিনি বললেন, ‘তোমার ভাই সেই লেবীয় আরোন কি আছে না ? আমি তো জানি, সে সুবক্তা; এমনকি, সে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছে। তোমাকে দেখে অন্তরে খুশি হবে। তুমি তার প্রতি কথা বলবে ও তার মুখে আমার বাণী দেবে, আর আমি তোমার মুখ ও তার মুখের সঙ্গে সঙ্গে থাকব, ও কি করতে হবে তোমাদের শেখাব। তোমার হয়ে সে-ই লোকদের কাছে বক্তা হবে; ফলে তোমার জন্য সে মুখস্বরূপ হবে ও তার জন্য তুমি ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করবে।’ [যাত্রাপুস্তক ৪: ১০-১৬]
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন