লিখেছেন উজান কৌরাগ
কোনো মানুষের বাল্য-কৈশোরের মানসিক বিকাশকালে তাকে ভুল সূত্র দ্বারা পরিচালিত করলে কিংবা যে কোনোভাবেই হোক তার মস্তিষ্কের ঊর্বর জমিনে ভুল বীজমন্ত্র প্রোথিত হ’লে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের বিদ্বেষ ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে থাকে, এমনকি তার মানসিকতা বর্বরতা-হিংস্রতার পথেও ধাবিত হয়। কবির স্যারের মতো শিক্ষক পেয়েছিলাম বলেই হয়তো আমি রক্ষা পেয়েছি, আমার ভেতরে সাম্প্রদায়িকতা বা বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ শাখা-প্রশাখা মেলে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। এর পেছনে কবির স্যারের যেমনি ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আমার নিজের দৃঢ় প্রচেষ্টাও। কবির স্যার আমাকে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সুবর্ণখনির পথ দেখিয়েছিলেন, আমি তাঁর দেখানো পথ ধ’রে এগোতে এগোতে একসময় সন্ধান পেয়ে যাই সেই সুবর্ণখনির। আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে আমি সেই সুবর্ণখনির মূল্য সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিলাম বলেই দমন করতে পেরেছিলাম বিদ্বেষের বিষবৃক্ষকে। উপলব্ধি করেছিলাম যে, মানুষের জীবনে পারিবারিক পরিবেশ এবং বন্ধুমহল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি হয়তো সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে নিজের এবং পরিবারের সঙ্গে লড়াই ক’রে আমার মানসিক অন্ধত্ব দূর করেছি, কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হ’য়ে ওঠে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধী - নাস্তিক ব্লগারদের বিচার প্রার্র্থী
গণজাগরণ মঞ্চ বিরোধী - হেফাজতে ইসলাম প্রেমী
আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিবাদ সমাবেশে যাই, এটা নিয়েও পরিবারের সঙ্গে আমাকে লড়াই করতে হয়েছে, এখনও করতে হয়। আমাদের পরিবারের কেউ-ই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চায় না। বলে, ‘এতোদিন পর এই বুড়ো মানুষগুলোকে শাস্তি দেবার কী দরকার! দেশে কতো অন্যায়-দুর্নীতি হচ্ছে, তার তো বিচার হচ্ছে না, নবীজিকে নিয়ে নাস্তিক ব্লগাররা কতো খারাপ খারাপ কথা লিখছে, তার তো বিচার করছে না সরকার। এটা একটা রাজনৈতিক চাল।’
আমার দাদীর বড়ভাই একাত্তরে একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। বাঙালি হলেও তিনি পারতপক্ষে বাংলায় কথা বলতেন না, অফিসে-বাড়িতে সব জায়গায় উর্দুতে কথা বলতেন। অন্যদেরকে উর্দু ভাষায় কথা বলার পরামর্শ দিতেন। বিয়ে করেছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানে কর্মরত একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তার মেয়েকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলেন; এমনকি নিরপরাধ মানুষ হত্যায় নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। একাত্তরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানে চ’লে যান। যাবার আগে নাকি জানিয়েছিলেন যে, কাফেরদের এই নাপাক রাষ্ট্রে তিনি আর কখনোই ফিরবেন না। ফেরেনওনি, আশি সালে করাচীর রাস্তায় বোমা বিস্ফোরণে মারা যান তিনি। তার স্ত্রী-সন্তান ওখানেই স্থায়ী হয়েছে। দাদীর ভাই মারা যাবার সংবাদটা জানানোর পর থেকে তারা আর বাংলাদেশে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমার দাদী তার ভাইকে এতো বছর বাদেও ভুলতে পারেননি, তার ভাইয়ের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমান নাকি তিনি জীবনেও দেখেননি। ভাইয়ের কথা উঠলে আজও তিনি চোখের জল ফেলেন আর ভারতকে গালমন্দ করেন, ইন্দিরা গান্ধীর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। দাদীর বিশ্বাস, ভারত অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর চক্রান্তেই পাকিস্তান থেকে ভাগ হ’য়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। দেশটা যদি আজও পাকিস্তান থাকতো, তাহলে তার ভাইকে করাচীর রাস্তায় অকালে প্রাণ হারাতে হতো না। যে ভাই গাছ থেকে আম-আমড়া পেড়ে আদর ক’রে বোনকে খাইয়েছে, সেই ভাইয়ের কবরটাও তিনি দেখতে পেলেন না! এই নিয়ে দাদীর বড় আক্ষেপ; আরো একটি আক্ষেপ এই যে, তিনি তার ভাইপুত-ভাইঝিদের মুখে তিনি ফুফু ডাক শুনতে পান না, আজ তাঁর সংসার ফুলে-ফেঁপে উঠলেও তাদেরকে নিজ হাতে রান্না ক’রে ভাল কিছু খাওয়াতে পারেন না! ভাই বিষয়ে দাদীর সর্বশেষ আক্ষেপ হলো - করাচীতে জন্ম হওয়ায় তার ভাইয়ের শেষ দুটো ছেলেমেয়ের চাঁদমুখ না দেখেই তাকে মরতে হবে!
যে কারণে আমাদের পরিবারের বাংলাদেশ বিরোধিতা, ভারত বিরোধিতা, আওয়ামীলীগ বিরোধিতা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা, তার শিকড় খুব গভীরে প্রোথিত। জামায়াতে ইসলামীর নেতা, একাত্তরের কুখ্যাত খুনি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর যেদিন ফাঁসির রায় হলো, সেদিন সংবাদ দেখার সময় চাচা রিমোট ছুঁড়ে মেরেছিলেন টেলিভিশনে। রিমোট ভেঙে চুরমার হয়েছিল, টেলিভিশনের পর্দায় চিড় ধরেছিল। চাচা সাঈদীর ওয়াজের চরম ভক্ত, সংবাদটা শুনে তিনি সহ্য করতে পারেননি। পরে যেদিন আপিলের রায়ে ফাঁসির বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড হলো, তখন চাচা খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন।
চাচা শুরুতে আইএস-এর ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ছিলেন, বিশ্বাস করেছিলেন যে, একমাত্র আইএস-ই পারবে সারা পৃথিবীর মানুষকে ইসলামী কওমের ছাতার নিচে আনতে। এমন স্বপ্ন তিনি আগেও দেখেছিলেন তালেবান আর আল-কায়েদা নিয়ে। লাদেন বাহিনী যখন আমেরিকার টুইনটাওয়ারে হামলা চালালো, তখন আমি বেশ ছোট হলেও চাচার সেই বুনো উল্লাসের কথা আমার আজও মনে আছে। আফগানিস্তানে তালেবানরা যখন বড় বড় বৌদ্ধমূর্তি ভাঙলো, তখনও চাচাকে উল্লসিত দেখেছি। কিন্তু তালেবান আর কায়েদায় চাচার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, তারা আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি ব’লে। তাই চাচা সর্বশেষ স্বপ্ন বুনেছিলেন আইএসকে নিয়ে। কিন্তু যখন শুনলেন আইএস কাবা শরীফেও আক্রমণ করতে চায়, তারা হজ্ব কিংবা ঈদের জামায়াতে বিশ্বাস করে না, তখন চাচার সেই উৎসাহের মহীরুহে যেন বাজ পড়লো! চাচা হ’য়ে গেলেন ঘোর আইএস-বিরোধী এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে, আইএস ইসরাইলের সৃষ্টি, ইসলাম ধ্বংস করাই আইএস-এর একমাত্র উদ্দেশ্য! তার বিশ্বাস পরে সংক্রামিত হয়েছে বাবার মধ্যেও। তবে বাবা চাচার চেয়ে খানিকটা উদারপন্থী। এই যে আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা হচ্ছে, গলা কেটে জবাই করা হচ্ছে, বাবা এর ঘোর বিরোধী। বাবা চান সংখ্যালঘুরা থাকুক ওদের মতো, ওরা তো আমাদের পায়ের নিচেই আছে, খুনোখুনি করার তো কোনো দরকার নেই। যদিও বাবার সাম্প্রতিক ধারণা - আওয়ামীলীগ সরকার ভোটের লোভে সংখ্যালঘুদের বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান ক’রে ওদেরকে মাথায় তুলছে; প্রশাসনসহ সব সেক্টরে নাকি বড় বড় পোস্টে হিন্দুদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে আমাদের ড্রয়িংরুমে ব’সে বাবা আর চাচা এসব নিয়েই আলাপ করছিলেন। রান্নাঘরে নিজের জন্য চা বানাতে বানাতে আমি তাদের কথা শুনছিলাম এবং এক পর্যায়ে সদ্য বানানো ধোঁয়া উঠা চায়ের মগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে ঢুকে পড়েছিলাম তাদের কথার মধ্যে, ‘জামায়ত-বিএনপি ক্ষতায় থাকাকালীন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হিন্দুদের চাকরি দেয়নি বললেই চলে। ইন্টারভিউ বোর্ডে আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো হিন্দুদের নিয়োগ না দেবার জন্য। আওয়ামীলীগ সরকার সেই নীতি গ্রহণ করছে না, এজন্য আওয়ামীলীগের ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
‘অল্প কিছু নিয়োগ দিলে বিষয়টা মানা যেত, তাই ব’লে প্রশাসনের বড় পোস্টগুলোতে এতো হিন্দু কমকর্তা!’ বাবা বলেছিলেন।
চাচা ফোঁস ক’রে উঠেছিলেন, ‘ইন্ডিয়ার ইশারায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামীলীগ এসব করছে। গোপালঞ্জ থেকে ধ’রে এনে সব নমো-চাঁড়ালগুলোকে বসিয়েছে।’
আমি চাচার চোখে চোখ রেখেছিলাম, ‘চাচা, আমাদের পূর্ব পুরুষও বোধ হয় নমো-চাঁড়াল ছিল, ইতিহাস তা-ই বলে। এমন ভাষা ব্যবহার করলে নিজেদের গায়েই থুথু ছিটানো হয়। আর আওয়ামীলীগ হিন্দুদের বড় বড় পোস্টে নিয়োগ দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করছে। জামায়াতের টাকা খেয়ে মুসলমানদের দেশের সঙ্গে বেঈমানী করার সম্ভাবনা প্রবল, হিন্দুদের সেই সম্ভবনা নেই বললেই চলে।’
চাচা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র শিবির করতেন, এখন রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও জামায়াতে ইসলামীর কট্টুর সমর্থক এবং চাকরি করেন ইসলামী ব্যাংকে। সবসময় নিজের যুক্তিতে অটল থাকলেও সেদিন আর এ বিষয়ে কথা বাড়াননি।
চাচা ক্লাস এইট পর্যন্ত গ্রামে পড়েছেন, তারপরই পুরো পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন দাদা। ঢাকায় নিয়ে এলেও প্রতি ঈদেই গ্রামে যেতেন ঈদ করতে। ছেলেবেলায় আমি, আমার দুই আপু আর ফুফাতো ভাই-বোনেরা চাচার কাছে তার ছেলেবেলার ঈদের গল্প শুনতে চাইলে চাচা তাদের ছেলেবেলার আনন্দ-উৎসবের অনেক গল্পের মধ্যে একটি গল্প বলতে চাচা যেমনি পুলকবোধ করতেন, তেমনি আমরাও মজা পেয়ে হাসতে হাসতে কেউ চাচার গায়ে কেউবা সোফায় গড়িয়ে পড়তাম। চাচার মুখে শোনা আমাদের সেই অতি মজার গল্পটা হলো - কোরবানী ঈদের সকালে গরু কোরবানীর পর চাচা এবং তার বন্ধুরা গরুর হাড় আর নাড়ী লুকিয়ে রেখে দিতেন। তারপর রাত্রিবেলা সেই হাড় আর নাড়ী নিয়ে যেতেন হিন্দুপাড়ায়, হিন্দুপাড়ার যেসব ছেলের সঙ্গে খেলাধূলা বা অন্য কোনো বিষয়ে তাদের বিরোধ ছিল, সেইসব ছেলেদের বাড়ির উঠোনে ফেলতেন গরুর হাড় আর গাছের ডালে গিঁট দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে আসতেন নাড়ী। কখনো কখনো মালার মতো টিউবয়েলের গায়েও নাড়ী পেঁচিয়ে আসতেন। গল্পটা চাচা এমন রসিয়ে রসিয়ে বলতেন যে, মনে হতো আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি! দাদার মুখে নবীজির মক্কা বিজয়ের গল্প শুনে যে আনন্দ পেতাম, তার চেয়েও বেশি আনন্দ পেতাম চাচার মুখে এই গল্পটা শুনে!
আমার বাম কানের ইয়ারফোনটা ফসকে পড়ে যেতেই মেঝের সাথে চেয়ারের ঘর্ষণের শব্দ শুনতে পেলাম। বোধহয়, চেয়ার ছেড়ে উঠছে সবাই, হয়তো সেহেরী খাওয়া শেষ। সবার কথা কানে এলেও কী বলছে তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি না। অল্পক্ষণ পরই মসজিদের মাইক আবার হেঁকে উঠলো, ‘সম্মানিত রোজাদার ভাই ও বোনেরা, সেহেরী খাওয়ার সময় শেষ হয়েছে, সেহেরী খাওয়ার সময় শেষ হয়েছে, সেহেরী খাওয়ার সময় শেষ হয়েছে।’
ঘুম আসছে না ব’লে আমি আবার ইয়ারফোনটা কানে ঢুকিয়ে চিৎ হ’য়ে শুয়ে ফেইসবুক খুললাম। উহ! সেহেরী খাওয়ার ছবিতে ফেসবুকের ওয়াল সয়লাব, বাহারি খাবারের সঙ্গে সেলফি! ভার্চুয়াল জগতের নির্যাতনও শুরু হলো! রমজান মাসে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত এবং অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান সকাল-সন্ধ্যায় সেহেরী এবং ইফতারের সময় সাজগোজ ক’রে বাসার কিংবা ইফতার পার্টির নানা ব্যঞ্জনের খাবারের ছবি, নিজের এবং বন্ধুদের ছবি, পরিবারের লোকজনের ছবি তোলে আর মাসব্যাপী ফেইসবুক-টুইটারে পোস্ট করে। ছবির সঙ্গে ভিন্ন ধরনের ক্যাপশন জুড়ে দেয়; যেমন- ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আরও একটি রোজা পার করলাম’, ‘বন্ধুর বাসায় ইফতার পার্টিতে’, ‘শুটিংয়ে ইফতার পার্টিতে’, মদিনা সাংস্কৃতিক জোটের ইফতার পার্টিতে আমরা কজন’, বখতিয়ার গ্রুপ অফ কোম্পানীর ইফতার পার্টিতে আমি, ‘আবাবিল থিয়েটারের ইফতার পার্টি’, ‘দুলদুল নৃত্য গোষ্ঠীর ইফতার পার্টি শেষে আমরা’ ইত্যাদি ধরনের। গত কয়েক বছর ধ’রে চালু হয়েছে সেহেরীর নতুন সংস্করণ - সেহেরী পার্টি। অনেকেই ইফতারির পর বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যায়, সারারাত আড্ডা দেয়, তারপর ভোরবেলা উদযাপন করে সেহেরী পার্টি। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে কোনো কোনো রেস্টুরেন্ট; তারা সেহেরীর খাবারের আয়োজন করছে আর মানুষ বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে মাঝরাতে ঝলমলে পোশাক প’রে, ভারী মেকাপ নিয়ে পিকনিক মুডে যোগ দিচ্ছে সেহেরী পার্টিতে। আজ প্রথম রোজা ব’লে সেহেরী পার্টির কোনো ছবি ফেইসবুকে দেখতে পাচ্ছি না, প্রথম সেহেরী হয়তো সবাই পরিবারের সাথেই খেতে চায়; তবে দু-চার দিনের মধ্যেই সেহেরী পার্টির ছবি রোশনাই ছড়াবে ফেইসবুকে, আর ইফতার পার্টি তো আছেই! মাত্র কয়েক বছর যাবৎ চালু হয়েছে সেহেরী পার্টি, অথচ এরই মধ্যে নাকি এটা সংস্কৃতির অংশ হ’য়ে গেছে। আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে মূল সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এই সব ভুঁইফোঁড় অপসংস্কৃতি!
ব্যক্তিগতভাবে আমি কেবল সেহেরী বা ইফতারী নয়, ফেইসবুক-টুইটারে যে কোনো খাবারের ছবি প্রদর্শন করা ভীষণ অপছন্দ করি; এটা আমার কাছে অসভ্যতা মনে হয়। আমার টাকা আছে, আমি বাসায় কিংবা কোনো ভাল রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাল খাবার খেতেই পারি, কিন্তু তা মানুষকে দেখাতে হবে কেন! আমি কী খাব বা কী পরবো, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেটা দশজনের সামনে জাহির করার বিষয় নয়, যেখানে আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ একটু ভাল খেতে-পরতে পারে না। আমার কোনো পড়শি হয়তো ভাল খেতে-পরতে পারছে না, আমি কি তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাব যে দেখো আমি ভাল ভাল খাবার খাচ্ছি, দামী পোশাক পরছি। কিন্তু হায়, এই স্বাভাবিক শিক্ষা-সহবতটুকু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের নেই, অথচ এরা ধার্মিক!
একজন নায়িকা সেহেরীর সেলফি তুলে পোস্ট দিয়েছে, সঙ্গে ক্যাপশন - ‘সবগুলো রোজা রাখবো ইনশাল্লাহ, আপনারাও রোজা রাখুন।’ ভোরবেলাতেও তার ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, খোলা চুল বেশ কায়দা ক’রে আঁচড়ানো। প্লাক করা চিকণ ভ্রু; যদিও ইসলামে ভ্রু চাঁছা হারাম! নায়িকা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই, আমার ফ্রেন্ড লিস্টের একজন ধার্মিক পোস্টটায় কমেন্ট করায় পোস্টটা আমার ওয়ালে এসেছে। পেশায় অভিনয়শিল্পী, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পরপুরুষের সঙ্গে অভিনয় করে, স্বল্পবসন প’রে পরপুরুষের কন্ঠলগ্ন হ’য়ে রোমশ বক্ষে নিজের স্ফীত স্তন ঠেকিয়ে মুখে যৌন আবেদন ফুটিয়ে নৃত্য-গীত করে, যা সম্পূর্ণ ইসলামী শরিয়াবিরোধী কাজ; অথচ সুযোগে সেও মানুষকে রোজা রাখার পরামর্শ দিচ্ছে আর মানুষও গদগদ হ’য়ে তার পোস্টে লাইক-কমেন্ট ক’রে তাকে প্রশংসার বন্যায় ভাসাচ্ছে! অথচ এখনই কেউ মওলানা আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ অথবা মওলানা তারেক মনোয়ারের ওয়াজ মাহফিলের স্টিল ফটোগ্রাফির ওপর হাদিস থেকে ক্যাপশন লিখুক - ‘পানি যেরূপ জমিনে ঘাস উৎপন্ন করে “গান-বাজনা” তদ্রূপ অন্তরে মুনাফেকী পয়দা করে’ অথবা লিখুক - ‘গান-বাজনা শ্রবণ করা, গান-বাজনার মজলিশে বসা, বাদ্য-যন্ত্র বাজানো, নর্তন-কুর্দ্দন করা সবই হারাম, যে ব্যক্তি এগুলোকে হালাল মনে করবে, সে ব্যক্তি কাফির’; লিখে পোস্ট দিক ফেইসবুকে, এখন যারা নায়িকার ছবিতে লাইক-কমেন্ট করেছে, তারাই নেকি হাসিলের জন্য ওই মওলানাদের ছবিতে লাইক-কমেন্ট ক’রে সহি মুসলমানিত্ব ঝালাই ক’রে নেবে! এই দ্বিচারিতা অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের চরিত্রে প্রকট।
রমজান মাস এলেই এদেশের অধিকাংশ মুসলমানের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য প্রকট হ’য়ে ওঠে এবং তা রীতিমতো বিরক্তির পর্যায়ে চ’লে যায়। দেশের কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সংগীতশিল্পী, চিত্রকর, নারী নেত্রী, খেলোয়াড়, সরকারি-বেসরকারী কর্মজীবী নারী-পুরুষ, রাজনীতিক, ঘুষখোর পুলিশ-র্যাব-মিলিটারি, মুদি দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, মদ্যপ, মিথ্যাবাদী, প্রতারক, মজুতদার, ধর্ষক ইত্যাদিসহ কে নেই এই দলে! আর এখন এদের ধর্মপরায়ণতা জাহির করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ফেইসবুক-টুইটার। যে কোনোদিন কোরান-হাদিস পড়েনি, সারাবছর বেশরিয়তী কাজতর্মে লিপ্ত থাকে, পুরো রমজানে দুটো-তিনটে রোজা রাখে কি না রাখে, এই ফেইসবুকের যুগে সেও সেহেরী, ইফতার, ঈদের জামায়তে সেলফি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট ক’রে তার সহি মুসলমানিত্ব জাহির করে সমাজের মানুষের কাছে! আর কোরবানী ঈদে তো আরো এক ধাপ এগিয়ে, গুরু-ছাগলের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেইসবুক-টুইটারে পোস্ট করার হিড়িক পড়ে যায়! নানান ভঙ্গিমার বাহারি সেসব ছবি; কেউ গরু-ছাগলের পিঠে হাত বুলাচ্ছে, কেউ ঘাস কিংবা খড় খাওয়াচ্ছে ইত্যাদি। দেখে মনে হয় যেন, আহা! পশুর প্রতি এদের কতো প্রেম! অথচ ঈদের দিন সকালবেলার বাতাসটা ভারী হয়ে ওঠে পশুর পীড়িত আর্তনাদে! অবলা পশুর রক্তে ভেসে যায় অলি-গলি। আর ধার্মিকেরা সেই রক্তমাখা বীভৎস ছবি পুনরায় পোস্ট করে ফেইসবুক-টুইটারে।
সেলফি তুলে এবেলা-ওবেলা ফেইসবুক-টুইটারে পোস্ট করা মুমিন মুসলমানের একটা বড় অংশ জানেও না যে, ছবি আঁকা-ছবি তোলা ইসলামে হারাম, আবার অনেকে জেনেও অমান্য করে। অনেক ধার্মিক চিত্রকরকেও ফেইসবুক-টুইটারে তার ধর্মপরায়ণতার বিজ্ঞাপন দিতে দেখা যায়। অথচ হাদিসে বলা আছে - ‘(কিয়মতের দিন) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি বানায়।” [সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদিস নং ৫৫২৬-ইফা]
আরো বলা আছে - ‘হাশরের দিন সর্বাধিক আজাবে আক্রান্ত হবে তারাই, যারা কোনো প্রাণীর ছবি তোলে অথবা আঁকে।’ (সহীহ বুখারী : ৫/২২২২)
আসলে ইসলাম এতোটাই অকার্যকর, অবৈজ্ঞানিক এবং অশৈল্পিক ধর্ম যে, কোরান-হাদিসের কথা মেনে জীবনযাপন করা অসম্ভব, কোরান-হাদিস অনুসরণ ক’রে জীবনযাপন করতে গেলে হয় মরুভূমিতে ঘর বেঁধে থাকতে হবে, নয়তো বনে বাস করতে হবে। এটা বুঝেই আধুনিক কালের মওলানা কিংবা মুফতিরা কোরান-হাদিসের কোনো কোনো আয়াতের নতুন ব্যাখ্যা এবং ফতোয়া দিচ্ছে। যেমন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান আল্লামা মুফতি আবুল কাসেম নোমানী তার ফতোয়ায় উল্লেখ করেছেন, ‘পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরির মতো একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলামে ছবি তোলা হারাম।’
তারপরও মুমিন মুসলমানদেরকে আমরা এই হারাম কাজটি হরহামেশাই করতে দেখি! ‘নাস্তিক ব্লগাররা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করে’ ‘মুক্তমনারা ইসলামকে অবমাননা করে’ - এসব ব’লে ব’লে মুমিন মুসলমানেরা মুখে ফেনা তুলে ফেলে, অথচ যাপিত জীবনে প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ইসলাম অবমাননা করে এইসব মুমিন মুসলমানরই!
নিচে নামতে নামতে শাশ্বতীদির একটা পোস্ট চোখে পড়লো, শাশ্বতীদি তার ব্লগের পোস্ট শেয়ার দিয়েছে। কমেন্ট বক্সে কেউ কেউ শাশ্বতীদির লেখার প্রশংসা করেছে, আর যথারীতি আছে কিছু মুমিন বান্দার অশ্লীল গালিগালাজ। এই মুমিন বান্দরা যুক্তির ধারেকাছেও নেই, কিন্তু গালাগালিতে তুখোড়! মুমিনরা বোধ হয় সারাক্ষণ মগজের কোষে লিঙ্গ ব’য়ে বেড়ায়, কেননা তাদের অধিকাংশ গালাগালিই লিঙ্গ সম্পর্কিত; বিরোধী মতাদর্শের সব নারীদেরকে হয়তোবা ওরা গনিমতের মাল ভাবে! শাশ্বতীদির অতি নিরীহ পোস্টেও মুমিনদের গালি থাকে, কে জানে মুমিনরা গালি দিয়ে কী সুখ পায়! নাকি ভিন্নমতাদর্শীদের গালিগালাজ করাতেও সোয়াব আছে? কী জানি!
শাশ্বতীদির লেখার মুগ্ধ পাঠক আমি। তিনি মুক্ত চিন্তক, পরিচ্ছন্ন চিন্তার মানুষ। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মতো সমাজের কাছে ভাল থাকার জন্য নিজের বিশ্বাসকে বোরখাবৃত ক’রে রাখেন না। যা বিশ্বাস করেন, অকপটে তা বলেন। কালোকে কালো, ভালকে ভাল বলেন তিনি। আমার মতোই তিনিও বিশ্বাস করেন, শরীরে বোরখা পরা মানুষের চেয়ে নিজের বিশ্বাসে বোরখা পরানো মানুষগুলোও প্রগতির জন্য কম ক্ষতিকর নয়; কারণ শরীরে বোরখা পরা মানুষ দেখলেই আমরা তার বিশ্বাস-দর্শন সম্পর্কে একটা ধারণা পাই, সব জায়গায় তারা একই রকম; কিন্তু বিশ্বাসে বোরখা পরানো মানুষের তল খুঁজে পাওয়া কঠিন, তারা একেক জায়গায় একেক রকম!
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন